করোনার আগ্রাসী থাবায় লকডাউন: লন্ডন থেকে লিখেছেন সোমাভা বিশ্বাস
২৫ মার্চ, ২০২০। ঘুম থেকে উঠেই দেখি রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে গাছের ডালে ডালে। গাছের পাতাহীন ডালগুলি থরথর করে কাঁপছে না। অর্থাৎ হুহু বাতাসের দাপাদাপি নেই। লন্ডনে এমন শুভ যোগ বিশেষ মেলে না। এমন দিন ঘরের বাঁধন ছেড়ে, কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ঘাসে শুয়ে বই পড়ার, পার্কে পিকনিক করার, ঠাণ্ডা বিয়ার হাতে খালের ধারে বসার, সঙ্গী সাথী, ছানাপোনা নিয়ে হুটোপুটি করার দিন। শীতকালে প্রায় ছ মাস ধরে কনকনে বাতাস, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, হাড়কাঁপুনি ঠাণ্ডা সহ্য করার পর, রোদ্দুরের উত্তাপে শরীর,মন ঝরঝরে তরতরে করে তুলতে কে না চায়? রোদ এ দেশে অতি মহার্ঘ বস্তু। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন এখানে কেউ নষ্ট করতে চায় না। এমন দিনে তাই কাজে ফাঁকি দেওয়াই যায়, এমন দিনে তাই লন্ডনের রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাজারহাট, মাঠঘাট, পার্ক, পানশালা–সর্বত্র মানুষের ঢল নামে।
চুম্বক যেমন আলপিনকে আকর্ষণ করে, তেমনি রোদ আমায় আকর্ষণ করতে লাগলো। ওদিকে রয়েছে করোনা অঙ্কের আতঙ্ক। যুক্তরাজ্যে এ যাবত ৯০,৪৩৬ মানুষকে পরীক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৮,০৭৭ মানুষ ‘পজিটিভ’, ৪২২ জনের মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যে- এসব নম্বর সারাক্ষণ চোখের সামনে, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। রয়েছে আত্মীয় সজন, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী, এ দেশের সরকার, সকলের ‘নেহাত প্রয়োজন না হলে বাড়ি থেকে না বেরনো’-র সাবধানবাণী। কিন্তু কেবল গায়ে রোদ মাখব বলে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে বাড়ির বাইরে পা রাখলাম আমি। রোদটাও আমার বড়ই প্রয়োজন যে।
প্রায় দিন পনেরো পর বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। এই পনেরো দিনে ব্রিটেনে করোনা ভাইরাস সৃষ্ট রোগ সংক্রান্ত পরিস্থিতিতে, আইনকানুনে বদল এসেছে। গত মাসেও অন্যান্য আরও অনেক দেশের মতোই করোনা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশ ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে আসেনি। তারপর রোগের ভয়াবহতা যখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে লাগল, তখন বরিস জনসনের সরকারের পক্ষ থেকে এক অভিনব বার্তা এল। তারা যুক্তরাজ্যের জনগণকে ‘herd immunity’ বা যূথ-প্রতিরোধক ক্ষমতা, অর্থাৎ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর শরীরে নিজে থেকে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে রোগ প্রতিরোধের প্রক্রিয়ার পথে নিয়ে যেতে চায়। যুক্তরাজ্যের ৬০% মানুষ করোনা আক্রান্ত হবে, তারপর নিজে থেকেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শরীরে বিশেষ কোষ তৈরি হবে এবং অসুখ সেরে যাবে এমন আশা করে সরকার থেকে স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত, দোকান বাজার, রেস্তোরাঁ- সবকিছু যেমন চলছিল তেমনি চালিয়ে যাবার নির্দেশ থাকল। বাস, ট্রেন, প্লেন–সব স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করতে লাগলো। আর রোগীর সংখ্যা, মৃত্যু মিছিল দ্রুত বেড়ে চলল। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে শেষমেষ যুক্তরাজ্য সরকার থেকে জারি করা হল সোশ্যাল আইসোলেশন, অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ রোখার নির্দেশ। লন্ডন বইমেলা ও ম্যারাথন আগেই বাতিল হয়েছিল, এবার সব ধরণের জনসমাবেশ- সিনেমা, থিয়েটার, রেস্তোরাঁ, পানশালা, জিম, নাইটক্লাব বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হল। বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, অফিস বন্ধ। ওষুধ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য সব দোকান বন্ধ। বাড়ি থেকে খুব প্রয়োজন ছাড়া বেরনো মানা। অসুস্থ বোধ হলেও বাড়িতে থেকেই স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা, বাড়াবাড়ি হলে ডাক্তারখানায় ফোনে যোগাযোগ করার নির্দেশ রয়েছে। আপাতত ভারতের মতোই যুক্তরাজ্যেও তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে ব্যস্ত শহর লন্ডনকে এক ঝলক দেখার কৌতূহল হলো।
বাড়ির বাইরের লন টুকু পেড়িয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়তেই ভীষণ অবাক হলাম। এ কোন শহর! রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। সপ্তাহের মাঝের একটি দিনের শুরু, এ সময়েও কারো অফিস কাছারি যাবার তাড়া নেই, তাই রাস্তা গাড়ি শূন্য। টুকটুকে লাল রংয়ের দোতালা বাস যাত্রী তুলতে তুলতে হেলে দুলে যাচ্ছে না। ব্যস্তসমস্ত পথচারীদের দেখা নেই। ট্রাফিক সিগন্যালেরও তাই কাজ নেই, চুপচাপ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার পাশে, দোকানের ধারে কম্বল বিছিয়ে বসে নেই গৃহহীনেরা, ফিসফিস করে ‘চেঞ্জ প্লিজ’ বলে ভিক্ষা চাইছে না কেউ। বড় বড় শপিং মল এর বেশিরভাগ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। জামাকাপড়ের দোকানের ম্যানেকুইন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে কাঁচের বন্ধ দরজার ওপার থেকে। ক্রেতা নেই, বিক্রেতা নেই। জিনিষপত্র সব তালা বন্ধ, স্তব্ধ। অবাক হয়ে দেখলাম ভোগবাদের বিরাট দৈত্য হেরে ভূত হয়ে গেছে অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে!
হাঁটতে হাঁটতে, গায়ে রোদ মাখতে মাখতে খেয়াল হল, বেরিয়েছি যখন টয়লেট টিস্যু রোল কিনে নিয়ে গেলে হয়। পত্রিকায় পড়েছি আতঙ্কিত ক্রেতাদের কথা- গ্রসারির দোকানের বিশেষ কিছু জিনিষ কিনে বাড়িতে জমানো যাদের লক্ষ্য। যদিও নিয়ম করা হয়েছে কেবল নির্দিষ্ট সংখ্যায় কেনা যাবে সে সব জিনিষ, তবু দোকান থেকে সেসব মাল স্রেফ উড়ে যাচ্ছে। সে তালিকায় রয়েছে চালের প্যাকেট, পাস্তার প্যাকেট, ডিম, রান্নার তেলের বোতল আর টয়লেট রোল। শেষোক্ত জিনিসটি এ দেশে অপরিহার্য। যে ক’টা দোকান খোলা তাতে টয়লেট রোল’য়ের দেখা মিলল না। কিন্তু দোকানের বাইরে সাজিয়ে রাখা পত্রিকার পাতায় চোখে পড়ল লড়ি ড্রাইভার আল্যান ওল্ডকর্ণের কথা– যুক্তরাজ্যের ল্যাঙ্কাশায়ারের মানুষ আল্যান দোকানে দোকানে টয়লেট রোল পৌঁছে দেয়ার কাজ করতেন। তাঁর নিজের শহরে মেলা বসলে, সেখানকার সাজ সজ্জার জন্য কাগজের ফুল তৈরি করতে হলে যত টয়লেট রোলের দরকার পড়ত, সেসব জোগান দিতেন আল্যান। স্বাস্থ্যবান এই মানুষটি ৭৪ বছর বয়সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।
বাড়ির পথ ধরলাম। এবার একটা অন্য রাস্তা নিলাম। বাড়ি ফেরার শর্টকাট রাস্তা। ক্যানালের ধার ঘেঁষে কাঁকর বিছানো পথ। রাস্তার ধারে একজায়গায় চোখ পড়তে দেখি ড্যাফোডিলের ঝোপ। ঘন সবুজ পাতার মধ্যে দিয়ে মুখ বার করে খিলখিল করে হাসছে যেন মিষ্টি হলুদ ফুলগুলি। ব্যাধি, মহামারী, ভয়, আতঙ্ক, ত্রাস, দুঃখের মধ্যেও ফুল ফোটে। বসন্ত আসে, প্রেম আসে। রুক্ষ, শুষ্ক, কঠিন হয়ে ওঠে সজীব, সতেজ, স্নিগ্ধ। ফুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল, ড্যাফোডিলের পাপড়ির বেষ্টনীর থেকে যে ট্রাম্পেটের মতো অংশটি বেরিয়ে থাকে, উদ্ভিদবিজ্ঞানে কমলা রঙের সেই অংশটির নাম, করোনা! তবে কী ভাইরাসের নামকরণের পেছনে রয়েছে কোমল, রূপসী এই পুষ্পটি? ফোনে গুগল খুলে দেখলাম লাতিন শব্দ ‘করোনা’র অর্থ পুষ্পমাল্য ঠিকই। তবে ফুল থেকে নয়, মনুষ্য জীবন স্তব্ধ করে দেয়া এই ভাইরাসের নামকরণ নাকি হয়েছে এর সঙ্গে রাজার মুকুট বা ক্রাউনের সাদৃশ্য থেকে। রাজমুকুটের ওপর থরে থরে সাজানো যে দণ্ড থাকে, দেখতে অনেকটা সে রকম বলেই প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের নাম করোনা। করোনা নামের উৎসের কথা পড়ছি, ঠিক তক্ষুনি ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল খবরঃ যুক্তরাজ্যের রাজপরিবার বিপদগ্রস্থ, রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী, প্রিন্স চার্লস করোনায় আক্রান্ত।
Comments are closed.