কোভিড যোদ্ধার ডায়েরি : চলাই জীবন, তাই এতসব কিছু পেছনে ফেলে চরৈবেতি, চরৈবেতি
আমার মনে বদ্ধমূল একটা ধারণা ছিল যে আমাকে কোভিড কিছু করতে পারবে না। আমি প্রতিদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ করি, প্রায় আধঘণ্টা প্রাণায়াম করি, আদা- তুলসী পাতা সহ অন্যান্য ‘কারা’ নিয়মিত গ্রহণ করি, সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। সর্বত্র দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি ।
কিন্তু বাস্তবটা হল অন্যরকম। ১৭ আগস্ট, রোববার; ঘুম থেকে উঠেই একটু জ্বর জ্বর ভাব, সাথে শ্বাস নিতে একটু একটু কষ্ট হচ্ছিল। আমার করোণা হতে পারে না, এই আত্মবিশ্বাস হারালাম । অক্সিমিটার আনিয়ে দেখলাম, অক্সিজেন লেভেল স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। কিন্তু শরীর অন্য কথা বলছিল। মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম, ঘরের সবাইকে জানালাম। এ যেন, বিনা মেঘে বজ্রপাত!
টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে এক বেসরকারি হাসপাতালে দ্বিপ্রহরে উপস্থিত হলাম। পরীক্ষা হলো এবং যথারীতি কোভিড পজিটিভ। বাড়িতে আইসোলেশনে থাকবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন কর্তৃপক্ষ। জানালাম, আমার শ্বাসের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, বাড়িতে থাকা চলবে না। ভর্তি হলাম বেসরকারি হাসপাতালে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেন গেলাম না। মনের কথা খুলে বলি, ভয় হচ্ছিল। শুনেছিলাম ওখানে ডাক্তারের দেখা পাওয়া যায় না। সংকটজনক মুহূর্তে চিকিৎসা বিভ্রাট ঘটার আশঙ্কা করছিলাম, তাই অনেক ভেবেচিন্তে ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলাম। সামাজিক মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম ব্যাপারটা। পরবর্তীতে আমাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ও কোভিড পজিটিভ হয়েছেন, তবে তার সংক্রমণ আমার থেকে হয়েছে কিনা তা নিয়ে ধন্দে আছি । পজিটিভ হওয়ার আগে কয়েকদিন আমার আশেপাশে সবচেয়ে কাছে এসেছিল পাপলু, বিপ্লব – ওদের কিন্তু এই সংক্রমণ ঘটে নি। দুই মিটার দূরত্ব, মাস্ক এইগুলো বিধি-নিষেধ সম্পূর্ণভাবে মেনে চলে ছিলাম, অফিসের সবাই ভাবতো আমি বাড়াবাড়ি করি। নিজে কিভাবে সংক্রমিত হলাম, সেটা এখনও একটা রহস্য।
হাসপাতালের ভেতরে আঁটোসাঁটো, দমবন্ধ পরিবেশ। চিকিৎসা পদ্ধতি মোটামুটি সব জায়গায় একই রকম ওষুধপত্তর ও একই । প্রতিদিন ভিটামিন সি ট্যাবলেট, জিংক ট্যাবলেট, সপ্তাহে একটা ভিটামিন ডি, অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস অম্বলের ব্যামো থাকলে তার ওষুধ, মোটামুটি এগুলোই দেওয়া হয়। আমাদের সবাইকে অধিকন্তু ফেবি ফ্লু দেওয়া হয়েছিল । অনেক দামি ওষুধ, কিন্তু এটা খুব একটা উপকারিতা আছে, আমার অন্ততঃ মনে হয় নি। তবে, আমাদের ওয়ার্ডের তিনজনকে রেমডেসিভির দেওয়া হয়েছিল । এই ওষুধ টা বেশ কার্যকরী মনে হল। যার অক্সিজেন লেভেল ৮৯-৯০ চলছিল, এই ওষুধ নেওয়ার একদিন পরেই তা স্বাভাবিক পর্যায়ে এসে যায়।
সেদিন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। টয়লেটে যাব বলে দরজা খুলে বেরিয়েছি, দেখি সামনেই ট্রলিতে রাখা কালো পলিথিন দিয়ে মোড়া এক নিথর দেহ, তাতে সাদা কাগজ সেটে দিয়ে কি একটা লেখা আছে (হয়তো বা নাম ঠিকানা বা হয়ত নিছকই একটা সংখ্যা)। দূরে থাকা সিস্টার জোরে জোরে বলল, ভেতরে যান, ভেতরে যান। ছুটে ভেতরে গিয়ে কি জানি কেন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম । দুজন স্বাস্থ্যকর্মী আমার কাছে ছুটে এলো, আশ্বস্ত করল ভয় পাওয়ার কিছু নেই, হাসপাতলে এরকম হয়েই থাকে। ভয় আমি পাইনি কিন্তু বুঝতে পারলাম, সত্যিই খুব দুঃসময় চলছে। এমন মৃত্যু ! আত্মীয়-পরিজন কেউ কাছে থাকবে না, মৃত্যুর পরও কাছে আসবেনা। যে চলে গেল, সে তো গেলোই; যারা রইল তারা একান্ত আপন হয়েও অনেক দূর ! কালো পলিথিন মোড়া দেহটা আমাদের যে কারোর হতে পারে, এটাই বাস্তব সত্য । পরে নার্সকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম ঐ কোভিড ওয়ার্ডের আইসিইউতে চারজন মারা গেছেন। তবে ভয় পেলে চলবে না, গতিই জীবন। মন থেকে দুশ্চিন্তা সরিয়ে দিতে কয়েকটা ভিডিও কল করলাম।
আরেকটা ঘটনা না বললেই নয়। কাবুগঞ্জ এলাকার ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ দুদিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ছোটখাটো
ফিগারের মানুষ, হাসপাতালে উঁচু বেড থেকে নামতে হলেও একজন সাহায্যকারী লাগে । তার ওপর ডায়াবেটিসের রোগী। উনি ঘন্টায় ঘন্টায় সিস্টারকে যতটুকু সম্ভব উচ্চস্বরে ডাকতে থাকেন। কিন্তু ওদের দিক থেকে সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না বাধ্য হয়ে নিজেকে উঠে গিয়ে সিস্টারকে বলতে হয়। সেদিন সিস্টারকে বললাম যে, এই বয়স্ক লোকটা আপনাদেরকে এত ডাকে আপনারা সাড়া দেননা কেন। হেসে জবাব দিল, আপনার কথাও আমি এখনো ঠিকমত শুনতে পাচ্ছি না, আন্দাজ করে নিচ্ছি। পিপিই কিট পরলে কানে ও একেবারেই কম শোনা যায়। রহস্য উদঘাটন হল, পিপিই কিটের আরেক মাহাত্ম্য প্রকাশ পেল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পিপিই কিট পরে থাকা সবাইকে একই রকম দেখতে মনে হয়। কে ডাক্তার, কে নার্স, কে সাফাই কর্মী, কে পুরুষ, কে মহিলা, এমনিতে দেখে বোঝার উপায় নেই। ডাক্তার এলে বুঝতে পারতাম কারন সাথে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ফাইল নিয়ে হাজির থাকত। সেদিন এক স্বাস্থ্যকর্মীকে সিস্টার বলে ডেকেছিলাম, তিনি হেসে হেসে বললেন ‘আমি ব্রাদার’। ঐ হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে করোনা বিজয়ী, তাই তাদের ভয় ডর অনেকাংশেই কম।
গতকাল রেপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে আমার ‘কোভিড পজিটিভ’ থেকে মুক্তি ঘটেছে। যাবার সময় ছোট্ট একটা হ্যান্ড ব্যাগ ছিল, অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি ফেরার সময় সাথে কিছু কাগজপত্র আর ওষুধপত্র যোগ হলো মাত্র। আমি তো সেই একই আছি, তবে এখন কিছুটা হলেও অন্য মানুষ।
লক ডাউনের কল্যানে শহরের রাস্তা প্রায় শুনশান, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। অনেকদিন পর আলো-বাতাস পেলাম, এ যে কত বড় প্রাপ্তি তা বলে বুঝাবার নয়। হাসপাতালে থাকার সময় টয়লেটের অ্যাক্সহস্ট ফ্যানের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করে ও বিফল হয়েছি। সব দিকে শুধু পাঁচিল আর পিপিই কিট।
আমার কোভিড হয়েছে জানতে পেরে যথেষ্ট উদ্বেগ হয় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মহলে। যার সাথে অনেক বছরের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই, সেও এই খবরটা কোথাও জেনে আমার মোবাইল নাম্বার জোগাড় করে ফোন করে আমার খবরা খবর নিচ্ছিল। প্রথম দিন প্রায় দুই শত ফোন কল রিসিভ করেছিলাম, মনে পড়ে। আমি ভাবতেই পারিনি আমার এত হিতৈষী রয়েছে। সবাই আন্তরিক ভাবে আমার সুস্থতা কামনা করছিল। বাড়ি ফেরার পথে ভাবছিলাম, এটা ও জীবনে অনেক বড় প্রাপ্তি।
আরেকটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। আমি প্লাজমা দান করব, অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথেই ভেবে রেখেছি, যদি সুস্থ হয়ে উঠি তাহলে অবশ্যই প্লাজমা দান করব। আমার রক্তের গ্রুপ হচ্ছে এ বি পজিটিভ । বর্তমানে সব গ্রুপের ই প্লাজমা প্রয়োজন। বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ সামাজিক মাধ্যম খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি। সাথে সাথে আমি আবেদন রাখছি যারা এই অতিমারির সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন , তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ে প্লাজমা দান করে আরো দুটো জীবন রক্ষা করেন।
তবে সব শেষে যেটা বলতে চাই, তা হল মানসিক শক্তি বজায় রাখা সর্বাবস্থায় প্রয়োজনীয়। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব (যারা পজিটিভ এনার্জি দিতে পারে) তাদের সাথে ফোন করে, ভিডিও কল করে যোগাযোগ রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। এতে নিজেকে কম বিচ্ছিন্ন মনে হয় এবং মানসিক শক্তি বাড়ে।
মানবসভ্যতা এই অতিমারিকে অতিক্রম করে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব আবার হেসেখেলে উঠুক, এই প্রার্থনা করি সর্বশক্তিমান ঠাকুরের কাছে।
Comments are closed.