
লকডাউনে নিঃস্ব! মেয়ের চিকিৎসার জন্য ছেলেকে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন রিক্সাচালক, এবার হবে বিনামূল্যে চিকিৎসা
কাজের সন্ধানে এক বছর আগে ত্রিপুরার আমবাসা থেকে শিলচর চলে আসেন শ্যামল দাস। তারাপুর এলাকায় রিক্সা চালিয়ে উপার্জন করেন। তবে সম্প্রতি জানা যায় তিনি তাঁর এক সন্তানকে বিক্রি করতে চেয়ে ছিলেন। ১৮ দিন আগে তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। কন্যাসন্তানটি জন্ম থেকেই একটি অসুবিধায় ভুগছে এবং তাকে নিয়ে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছেন মা-বাবা। তবে একসময় চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারছিলেন না, এমনকি রোজকার খাবারটাও জুটছিল না। অনেকের কাছেই আবদার জানিয়েছেন সাহায্যের জন্য, তবে তখন কেউ এগিয়ে আসেনি। অত্যন্ত হতাশা এবং ক্ষোভ নিয়ে হাসপাতালে সুরক্ষা কর্মীদের কাছে বলেছিলেন, কেউ যদি তার ছেলেকে কিনে নেয়, তিনি দিতে রাজি আছেন। তবে ভবিষ্যতে ছেলের জন্য মন টানবে কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এবার তার পাশে দাঁড়িয়েছেন শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ বাবুল বেজবরুয়া, বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল সহ এলাকার সমাজসেবীরা।
ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর প্রথমে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্মীরা এগিয়ে আসেন, নিজেদের সাধ্যমত টাকা জোগাড় করে শ্যামল দাসের হাতে তুলে দেন। এতে যোগ দেন উপত্যকার কিছু সমাজসেবীরা। খানিকটা টাকা জোগাড় হলেও সমস্যা থেকেই গেছিল। ছোট মেয়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছেন গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। শ্যামল দাস কিভাবে এই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে গুয়াহাটি যাবেন, কে তাদের সাহায্য করবে, চিকিৎসায় কত টাকা লাগবে, এসব প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না। এতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ বাবুল বেজবরুয়া। শিলচর থেকে ফোন করে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। শিলচর থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার জন্য বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্সও পাইয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। শ্যামল দাসকে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, নিজেকে একা না ভাবতে।
শিলচরের বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল খবর পেয়ে শুক্রবার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হন এবং বাবুল বেজবরুয়ার মতোই শ্যামল দাসের মেয়ের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, “আমাদের সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে এই পরিবারকে সাহায্য করা সম্ভব। আমরা সবাই মিলে প্রাথমিকভাবে তাকে সাহায্য করলেও আগামীতে যাতে চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া যায় সেদিকে লক্ষ্য থাকবে।”
শিলচরের হাইলাকান্দি সম্মিলনীর সদস্যরা প্রথমে শ্যামল দাসের পাশে দাঁড়ান। তারা বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। এতে অনেকেই খবরটি জানতে পারেন এবং এগিয়ে এসে পরিবারটির পাশে দাঁড়ান। সম্মিলনির পক্ষ থেকে পল্লবীতা শর্মা বলেন , “যেখানে আজকের সমাজেও কন্যা সন্তানকে আপদ মনে করা হয়, রোজ কন্যা ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে, মেয়ে জন্মের পর রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেওয়া হয়। সেই যুগে নিজের কন্যা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য এক অশিক্ষিত দরিদ্র দম্পতি নিজের পুত্র সন্তানকে বিক্রি করে দিতে চাইলেন।
তারা আমাদের সভ্য সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে নিজের মেয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো আবর্জনা নয়। এই অসহায় মা বাবাকে আমার সহস্র প্রণাম। আমরা তাদের পাশে আছি।”
অনেকেই পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাই এবার মেয়েকে নিয়ে গুয়াহাটি যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন শ্যামল দাস। তবে তার মনে একটাই ভয়, হয়তো এখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। বরাক বুলেটিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেছে, আদৌ সন্তানকে বাঁচাতে পারবেন তো? তিনি বলেন, “এখন অনেকেই সাহায্য করছেন এবং তারা আগামীতেও পাশে থাকার কথা দিচ্ছেন, এতেই আমি আশ্বস্ত। তবে আমার মনে একটাই ভয়, হয়তো অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। মেয়েকে বাঁচাতে পারবো কিনা জানিনা তবে শেষ চেষ্টা আমি করব। একসময় অবস্থা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের খাবার যোগার হচ্ছিল না। হাসপাতালে অন্য রোগীর জন্য যে খাবার আসতো, সেটা থেকে আমাদের কিছুটা দেওয়া হতো।”
কেন তার এই অবস্থা? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এক বছর আগে ত্রিপুরার আমবাসা থেকে শিলচর এসেছি, এখানে রিক্সা চালাই। তবে এই অবস্থার জন্য দায়ী লকডাউন। আগে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা রোজগার করতাম, লকডাউনে সেটা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও রোজগার হচ্ছে না, দিনে ২০০ টাকার বেশি পাইনা। কোনওদিন এর থেকে অনেক কম রোজগার হয়। অথচ জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। এক সন্তান রয়েছে এবং আরেকজনের আগমন হচ্ছে। আমরা মনের জোর নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তবে ঈশ্বর আমাদের জীবন আরেকটু দুর্বিষহ করে দিলেন। আমার ছোট্ট কন্যা সন্তানটি একটি অসুবিধা নিয়ে জন্মেছে যার চিকিৎসা শিলচরে করা যাচ্ছে না। অনেকের কাছেই কথাগুলো বলেছি কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না, একসময় রাগে-দুঃখে মনে হয়েছিল সব শেষ করে দিই। কথায় কথায় দু’একজনকে বলেছিলাম, অনেকেরই তো সন্তান থাকে না, এমন কোনও পরিবার পেলে আমার ছেলেটাকে দিয়ে দেব। এতে তার জীবনও ভালো থাকবে আর আমি আমার মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারব। পরিস্থিতি আমাকে এভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল, না হলে কোন বাবা নিজের সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা করতে চায় বলুন?” কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই সন্তানের বাবা শ্যামল দাস।
Comments are closed.