Also read in

ডি-ভোটার মুক্ত বরাকের ডিটেনশন ক্যাম্প; "কাউকে দোষ দিচ্ছিনা, এটাই নিয়তি ছিল" ছাড়া পেয়ে বললেন মনীন্দ্র দাস

প্রথমবারের মতো বরাক উপত্যকার ডিটেনশন ক্যাম্প ডি-ভোটার মুক্ত হয়েছে। শনিবার ছাড়া পেয়েছেন শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা শেষ বন্দি মনীন্দ্র দাস। তবে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেলেও ডি-ভোটার তকমা পাওয়া ভারতীয় নাগরিকরা ট্রাইবুনাল আদালত এবং পুলিশ স্টেশনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি। গতবছর লকডাউন শুরু হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশে দুই বছর ধরে বন্দী থাকা ডি-ভোটারদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৪৮ জন লোক এপর্যন্ত ছাড়া পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ জন ডিমা হাসাও জেলার এবং বাকিরা বরাক উপত্যকার তিন জেলার বাসিন্দা।

মুক্তি পাওয়ার পর ৬৭-বছর-বয়সের মনীন্দ্র দাস বলেন, “একজন ভারতীয় নাগরিক হওয়ার পরও এভাবে বিদেশির তকমা গায়ে নিয়ে জেল খাটা অবশ্যই অত্যন্ত অপমানজনক। তবে আমি এজন্য কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। সারাজীবন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছি, বিভিন্ন সরকার গড়তে দেখেছি এবং প্রত্যেকবার ভোট দিয়েছি। হঠাৎ করেই পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এলো এবং দুই বছর জেল খাটতে হল। হয়তো এটাই নিয়তি ছিল তাই হয়েছে, কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। মুক্তি পেয়েছি এবার বাড়ি গিয়ে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবন কাটাতে চাই।”

মনীন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে পরপর দুটো নোটিশ পাঠিয়েছিল ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আদালত। তার মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলে, কিন্তু মাঝপথে তার পক্ষের আইনজীবীর মৃত্যু হয়। তিনি অথবা পরিবারের লোকেরা ততটা শিক্ষিত নয় যে এব্যাপারে নিজেদের তরফে কিছু করবেন, ফলে আদালতে হাজিরা দিতে পারেননি। এতেই একতরফা রায়ে তাকে বিদেশি ঘোষণা করে আদালত এবং ২০১৯ সালের ৮ মে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এবার তার দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর শুরু হয় জামিনদার খোঁজার পালা। সমাজসেবী কমল চক্রবর্তীর সহায়তায় শেষমেষ তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

কমল চক্রবর্তী এর আগে প্রায় ৪৫ জন ব্যক্তির জামিনদার খুঁজে দেওয়ার ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি বলেন, “আগে নিয়ম কিছুটা আলাদা ছিল, কেউ গ্রেফতার হওয়ার পর ন্যূনতম তিন বছর জেল খেটে জামিনের জন্য আবেদন করতে পারতেন। দুজন জামিনদার প্রয়োজন হতো এবং এক লক্ষ টাকা দিতে হতো। যারা এই ডি-ভোটার নামের যন্ত্রণার শিকার, প্রত্যেকে অত্যন্ত গরিব পরিবারের। গতবছর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ দিয়েছেন তাতে নিয়ম গুলো সহজ করে দেওয়া হয়েছে। জামিনদার একজন হলে চলে এবং পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। একে একে অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন এবং প্রত্যেকের নিজস্ব একেকটা কাহিনী রয়েছে। শুধুমাত্র ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়ে তারা মুক্ত হয়ে যাননি, এখনো ট্রাইবুনাল আদালতের চক্কর কাটতে হচ্ছে। চন্দ্রধর দাসের মতো লোক নাগরিকত্ব না পেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন যা আমাদের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তবু যখন কেউ জেল থেকে বেরিয়ে নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন, সেই মুহূর্ত চোখে দেখলে আনন্দ পাই। কেউ খুশিতে হাসেন আবার কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন, সাধারণ মানুষের এই কথাগুলো অবশ্যই জনপ্রতিনিধিদের কানে গিয়ে পৌঁছায়না। তবে সমাজের অনেকেই এদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। নাট্যকর্মী থেকে শুরু করে পুলিশ, অনেকেই জামিনদার হয়েছেন। এমনকি শিলচরের প্রাক্তন বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল সীমা বর্ধনের জামিনদার হয়েছিলেন। এই কাজের জন্য তাদের অনেককেই মাশুল দিতে হয়েছে, তবু তারা সৎসাহস দেখিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আদালতের নামে কোটি কোটি টাকা নষ্ট না করে সেগুলো ব্যবহার করে স্বাস্থ্যপরিসেবা উন্নত করলে ভালো হয়। ট্রাইব্যুনালে আজ পর্যন্ত কোনও মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, অনেকেই আদালতে মামলা জেতার পরও আবার নোটিশ পাচ্ছেন। দিনের পর দিন সরকার পক্ষের আইনজীবী অনুপস্থিত থাকেন এবং সাধারণ মানুষকে আগামী তারিখ জেনে ফিরে আসতে হয়। তারা যখন এই মামলাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ, তাহলে কেন এত টাকা খরচ করে তাদের রাখা হয়েছে। আদালত কাউকে বাংলাদেশি হিসেবে ঘোষণা করলেও তাকে গ্রহণ করবে না বাংলাদেশ, এটা সবাই জানেন।”

শিলচর কেন্দ্রীয় কারাগারের ইনচার্জ সত্যেন্দ্র বৈশ্য জানিয়েছেন, কারাগারের ভেতরে থাকা ডিটেনশন ক্যাম্পে এখন ট্রাইবুনাল আদালতের তরফে পাঠানো কোনও ব্যক্তি নেই। ২০১৯ সালের পর ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আদালতের তরফে কোনও লোককে এখানে পাঠানো হয়নি। কিছু লোক রয়েছেন যারা আদতে বাংলাদেশ, মায়ানমার বা অন্যান্য দেশের নাগরিক। অপরাধমূলক কাজে বিনা অনুমতিতে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়েছিলেন এবং তাদের আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককেই দফায় দফায় নিজের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিছু লোক এখনও রয়ে গেছেন যাদের সময় এলে ফেরত পাঠানো হবে। গতবছর অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তবে এবার সেটা হয়নি।

Comments are closed.