
ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেলেন দীপালি দাস, তবে দু'বছরে তছনছ হয়ে গেছে তার সংসার
সোমবার শিলচর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছেন দীপালি দাস নামের এক মহিলা। একজন লোক যখন ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী হিসেবে দিন কাটিয়ে ফেরেন, শুধুমাত্র সেই মানুষটি বিধ্বস্ত হয় না, তার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো পরিবার। ২০১৯ সালের ৫ মে গ্রেফতার হয়েছিলেন ৫৩ বছর বয়সের দীপালি দাস। তিনি একটি খাবারের দোকান চালাতেন এবং এর মাধ্যমে ঘর-সংসার চলতো, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হত। ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার পর সেই দোকান বন্ধ হয়েছে। তার স্বামী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে, তার পরিবারের সুখ-শান্তি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। যখন ডিটেনশন ক্যাম্পে গেছিলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, এবার লকডাউনে কি করে নিজের পরিবারকে আবার স্বাভাবিক জায়গায় নিয়ে আসবেন তিনি জানেন না।
গতবছর সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে দুই বছর কাটিয়েছেন তাদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক। এতে একে একে শিলচর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অনেকেই মুক্ত হয়েছেন, তবে তাদের যন্ত্রণা কাটেনি। সাপ্তাহিক পুলিশের কাছে হাজিরা দিতে হয় এবং তাদের স্বাধীনতা আর পাঁচটা সাধারণ লোক থেকে অনেক কম। দুঃসময়ে বাড়ি ফিরলেও রোজগারের রাস্তা খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে এদের। আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই রয়েছেন।
ধলাই বিধানসভা সমষ্টির অধীনে ধলছড়া এলাকার সিঙদুয়ার গ্রামের বাসিন্দা দীপালি দাসের বাবা একজন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন এবং এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র দাস ১৯৬৫ সালে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ভোট দিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশনের তালিকায় এখনও সেই কথা স্পষ্ট লেখা রয়েছে। ১৯৬৬ সালে দীপালি দাসের জন্ম হয়, তখন অসমে জন্মের সার্টিফিকেট সরকারিভাবে ইস্যু করা হতো না, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ১৯৭৮ সালে। দীপালি কোনও বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি এবং বিয়ের ক্ষেত্রেও তখন কোনও কাগজপত্র বানানো হয়নি। ফলে বাবার মেয়ে হয়েও তার কাছে এমন কোন কাগজ নেই যেটা তার সঙ্গে তার বাবার সম্পর্ক দেখাতে পারে, এতেই মামলা হেরে গিয়ে গ্রেফতার হন দিপালী।
দীপালি দাসের মেয়ে অর্পিতা দাস একটি কলেজে পড়াশোনা করে, তবে তার জন্য অনেক লড়াই করতে হচ্ছে। তার ছোট বোন উচ্চমাধ্যমিক পড়াকালীন মা গ্রেফতার হয়েছিলেন, এরপর তার পড়াশোনা হয়নি। আরেক বোন মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সবথেকে করুণ অবস্থা হয়েছে দীপালি দাসের স্বামী অভিমুন্য দাসের। স্ত্রীর গ্রেফতার হওয়ার অপমান সহ্য করতে পারেননি এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং এখন তার কিছুই মনে থাকেনা। একেবারে শিশুর মতো ব্যবহার করছেন। দুই বছর পর তার স্ত্রী বাড়ি ফিরে এলেও স্বামী কতটুকু সুস্থ হয়ে উঠবেন এটা নিয়ে সন্দেহে রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
দীপালি দাস ধলাই বিএনএমপি বিদ্যালয়ের সামনে পোলাও সহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি করতেন। এতেই সংসারের প্রায় পুরোটা বোঝা নিজে সামলে নিতেন। একদিন দুপুরে তিনজন পুলিশ আধিকারিক এসে তাকে বললেন থানায় যেতে হবে, এনআরসির কিছু কাজ রয়েছে। স্থানীয় থানায় যাওয়ার পর তাকে বলা হল শিলচর যেতে হবে, এতে তার সন্দেহ হয়। শেষমেষ যখন তার মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো হচ্ছিল তিনি বুঝে গেছিলেন, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে। তবু পুলিশের আধিকারিকরা বলেন, আপনাকে জেলে পাঠানো হবে না, একটা কাজে শিলচরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেদিন রাতেই তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হয়।
দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন মুক্তি পাওয়ার সুযোগ আসে তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় জামিনদার পাওয়া। তার সন্তানরা অনেক খুঁজেও কাউকে জামিনদার হিসেবে রাজি করতে পারেননি। শেষমেষ সমাজসেবী কমল চক্রবর্তীর অনুরোধে বীক্ষণ সিনে কমিউনের সদস্য মলয় দাস জামিনদার হতে রাজি হন। এতেই সোমবার দুপুরে জেল থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পান দীপালি দাস।
যাওয়ার আগে আক্ষেপের সুরে বলেন, “যে অবস্থায় আমাকে নিয়ে আসা হয়েছিল, এই দুই বছরে আমি এবং আমার পরিবার যা হারিয়েছে সেটা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমার পরিবার যেভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সেটা কিভাবে সামাল দেব জানিনা। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল, এখন কতটুক রোজগার জুটবে সেটাও অজানা। তবে সবথেকে কঠিন দিক হচ্ছে আমার স্বামীর অসুস্থ হওয়া। দুই বছর পরিবারের থেকে দূরে থাকতে হয়েছে এবং তারা একাই কষ্ট করেছেন। এবার সবাই মিলে আবার পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করতে হবে।”
সমাজসেবী কমল চক্রবর্তী বলেন, “গত এক বছরে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ডি’ভোটাররা মুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এখন আর একজন ব্যক্তি ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন, তার মুক্তি হলে আপাতত শিলচরের ডিটেনশন ক্যাম্পে কেউ থাকবেন না। তবে জামিনে মুক্তি পেলেও তাদের যন্ত্রণা কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। যারা বাড়ি গেছেন তাদের লাগাতার আদালতের চক্কর কাটতে হচ্ছে এবং এক্ষেত্রেও আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। প্রায় প্রত্যেকের কাছেই পর্যাপ্ত নথিপত্র রয়েছে, কিন্তু ছোটখাটো গোলমালের ফলে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারছেন না এবং ভুগতে হচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণা। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এব্যাপারে আরেকটু নজর দেওয়া উচিত তাহলে অনেকেই সুরক্ষা পাবেন।”
Comments are closed.