"হ্যাপি বার্থডে আংকেল, ভালো থেকো তুমি, আমরা সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করছি"
পীযূষ, পীযূষ দা, বড়দা, পী কা দা, পীযূষ দাস” অনেক নামেই পরিচিতি ছিল, যদিও আমি ও আমার ছোটভাইটির কাছে, উনি হলেন আমাদের ” চকোলেট আঙ্কেল” । এই আজগুবি নামটির পেছনে রয়েছে mango bite এর লোভ। শৈশবে হিট ওই হলুদ সবুজ প্যাকেটে মোড়া “চকোলেট”টা। আমার জীবনে তাই যে কোনো ভদ্রলোককে প্রজন্মের ব্যতিক্রম হলেও আর যাই হোক ,” আঙ্কেল” সম্বোধনটা পারতপক্ষে করতামনা, সেটা ফিক্সড্।
সব কিছুর সমাধান হলো এই পিপ্পীপ হর্ণ ওয়ালা হিরো হনডা বাইকের দাড়িওয়ালা ডেনাইট গ্লাস পরা পাইলট। রকমারি গাদা গাদা গ্ৰীটিংস্ কার্ড, কতরকম চটী বই, আঁকা ছবি, ফিলাটেলী কালেকশনে আরো কত কি! তার সঙ্গে আরও কত কৌতুহলের সম্ভার ছিল তার কাছে, বললে তো একদম হিরো। মাথা ধরেছে বললে বাম লাগিয়ে মাসাজ করে দেওয়া ছিল বাঁধাধরা। জ্ঞান হবার পর থেকেই পারিবারিক সূত্রে পরিচয় হলেও অন্যরকম ছিল সম্পর্কটা, ঠিক কথায় প্রকাশ করাটা যাচ্ছে না, লোভী ছোট্টো মেয়ে আমি তখন চিউইঙ গাম চিবিয়ে বাইকের সামনে বসে একটু আধটু বেড়িয়ে আসাটাই ছিল ইউরেকা!
ক্লাস টু থেকে কত্থক নৃত্য দিয়ে শুরু হয় আমার সংস্কৃতি চর্চা, মোটামুটি মাধ্যমিক পাশ করা পর্য্যন্ত বিভিন্ন কোর্সের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চলেছে। আর ইতিমধ্যেই এই আঙ্কেল সব ক্ষেত্রেই আমায় উৎসাহ দিয়েছে, তা নাটকই হোক আর নাচ ই হোক আর গান ই হোক। অনুষ্ঠানের শেষে আমার বেস্ট ক্রিটিক্ তিনিই। একবার নাচের সাজের মুকুটের জন্য শ্মশানের পাশের ভাঙা প্রতিমা থেকে খুলে নিয়ে আমায় দিয়েছিলো, বলেছিল টিকসোই হবে। সে কি কাণ্ড! দিদার রাগ কে দেখে!
ক্লাস ফাইভে থাকতে ইনি আমার মেসো হলেন। আমার প্রিয় ছোট মাসিটির বর। অবশেষে “চকোলেট” বাদ পরে এবার হলেন শুধু “আঙ্কেল”, “মেসো” ডাকটা সুবিধের ঠেকলোনা ঠিক, এতদিনের অভ্যেস কি না। ভারি রাগ হয়েছিল আজ বলছি, ভাগ বসালো বলে। বুঝতেই পারছেন ওই বয়সে যা হয় আর কি। অনেক দিনের সম্পর্ক তাদের, এবং দুজনের কাছে আমি হলাম ভেনিটি ব্যাগ। চাট খাওয়া, পকোরা, ঘটি গরম, বারো মজা, যা কিছু সেকেলে ফাস্ট ফুড, তাতেই ভাগ;চাতলা , খাসপুরে ডকুমেন্টরি, বৃষ্টিতে ভিজে ফুচকা খাওয়া ইত্যাদি সবেতেই রেশমী বিরাজমান।
এরপর এক অন্য রূপ, পারিবারিক , মানে ফ্যমিলি ম্যান। মাসিকে ঘরে পেতাম না বলে সুযোগ পেলেই তার শশুর বাড়ি দৌড়। প্রত্যেক পূজোয় বাঁধাধরা উপহার, অটোতে চেপে নিয়ম করে ঘুরতে যাওয়া, সবাই মিলে হৈহৈ। তারপর ছোট্টো “মানি”কে নিয়েও এদিক ওদিক। সাংবাদিক হবার সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেছেন। যা কিছু ব্যতিক্রমী – মণিপুরি সাজে দূর্গা, নৌকা দৌড়, বরাকের নদীদ্বীপ নারায়ণ ডহর আরো অনেক। খাদ্য রসিক বলা যাবেনা যদিও কিন্তু বাজার রসিক বলতে হবে, আমার প্রিয় মৎস বাঁশপাতা বা কাজলি জানার পর, খুব কম দিনই গেছে যে ওই মাছ ছাড়া তাদের বাড়িতে খেয়েছি।
আপনা থেকেই কেমন যেন নীরবে বাবা মেয়ে সুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। আমি আর ভাই এর মধ্যেই বাবাকে হারিয়েছিলাম, তখন অতটা বুঝে উঠতে পারিনি যদিও , ক্রমশঃ উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে আশ্রয়টা আর নেই। কিন্তু পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে আঙ্কেলের প্রাণপন আন্তরিকতায় আমরা আজ সবল, শক্ত, আশ্রয়হীন নই। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলোতে আঙ্কেলের পরামর্শ অনিবার্য। আমার পেশা ও উচ্চ শিক্ষা নির্বাচনেও আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে আঙ্কেলের সহমত প্রকাশে ও বলেছিল “যা চাকরি একটা পাইবেই” ।মধ্যবিত্ত, একা চাকুরিরত মার পক্ষে কোনোমতে শখ আল্লাদ ত্যাগ করে , সরকারি কলেজে পড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না ঠিক ই, কিন্তু মেয়ের নিশ্চিত চাকরির লোভ ছিল বটে। ব্যাস। দশটা বছরের জন্য পরদেশি হলাম, আশীর্বাদে চিকিৎসক হলাম।
এটাই হয়তো টুইস্ট। আমি যখন জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে গৌহাটিতে কাজ করি, সেই অভিশপ্ত দিনটি আমার আজও মনে পড়ে।
দৈনন্দিন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আলোচনায় পেশার জন্য হামেশাই যোগাযোগ হতো, আমি বললাম, মানে সহমত। ডাক্তার নয় যেন পার্সোনাল কাউন্সেলর।কোনো কারণে ইউরিন , ক্রিয়েটিনিন্, ইউরিক এসিড রুটিন টেস্ট করতে বলেছিলাম একদিন। ছোট্টার ফোন -” ইউরিন রিপোর্ট পাঠিয়েছি, দেখে বল”। দেখে কেমন যেন একটা পেটে কামড় পড়ল, রিপোর্টৈ ইউরিন প্রোটিন বেশি, ক্রিয়েটিনিনও বেশি। ছোট্টাকে বলেছিলাম ” কিডনিতে অনেক পাথর হলে,ভাল ছিল গো” ,অবাক হয়ে বলেছিল, ” পাগল হয়েছিস্?” বুঝতে পারেনি সে। ওই যে শুরু হয়েছিল আজ তার শেষের পর বসে লিখছি।
গৌহাটি , হাদেরাবাদ, চেন্নাইতে প্রায় চার চারটা বছর যুদ্ধ করে চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। সঙ্গে কাজের চাপ, কিন্তু শেষে তিনি অসুস্থতার বশে বৌয়ের বকায় বাইরের দৌড় কমিয়ে দিলেও সারাটা দিন মুঠোফোনেই সব কাজ চুকিয়ে নিতেন। খাওয়া নেই, বিভিন্ন সমস্যায় দৈনন্দিন জীবন ক্রমশঃ দুর্বিষহ হচ্ছে। “ডাক্তারনি” বলেই ডাকতো, ঠাট্টা না গর্বে বোঝা দায়। দায়িত্ব নেবার পালা এবার আমার ছিল। গৌহাটি ছিলাম বলে ফোনে খবর নিতাম, ছোট্টার গলা শুনেই বুঝতাম, ঘরের পরিবেশ কেমন। মাঝে মাঝেই ফোন করতাম না দুতিন দিন , মন খারাপ লাগতো যে। রিপোর্টের নিম্ন গতি বুঝলেও, কাউকে কিছু না বলে দুজনকেই কাউন্সেলিং করতাম, মনে মনে তিলমাত্র আশাতো রয়েই যেত, পরিবার বলে কথা, খারাপ ভাবতে ইচ্ছে করেনা।ডাক্তারি পেশার ডিমেরিট বুঝতে পারছিলাম, চোখের সামনে সব জেনে শুনে কিসসু করতে না পারাটা যে কতটা অসহ্যকর, অথচ সবাইকে বলা যাবেনা। ঘরটার ছিরি বদলে গেল। দিল্লিতে ট্রান্সপ্লান্ট করে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ছোট্টা ডোনার হলো। বেশ শান্তি এখন। ছোট্টার সারাদিনের পথ্যের সাপ্লাইয়ের সঙ্গে সাবধানতা , সঙ্গে সাংবাদিকতা, সমাজসেবা। একটু যেন অক্সিজেন পেলাম আমরা।
আমার বিয়ে নিয়ে কত মাথা ব্যথা, ভেনু ভাল লাগেনি, আরো ভালো হওয়া চাই, সাড়ম্বরে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে যে। দিল্লিতে থাকাকালীন ছ’মাস আগেই বিয়ের প্রথম বাজার তাঁর হাত দিয়েই। অসুস্থ শরীরে বাজারে তিনি, এই জুতো, এই চুরনি, এই ব্যাগ আরো কত কি! পরবর্তী সবকিছুও নখদর্পণে।
শেষ ভাল ছবিটা আমার বিয়েতে দেওয়া সাবেকি পাঞ্জাবিতেই, উপহারটি দেখেই বলেছিল,” এর সঙ্গে ধুতি আছে তো সোমা?” অট্টহাসি……..।
বরাবরই সাহসী মেয়ে ভাবতো আমায়, তাই বলে নিজের বিয়ের আসরে গান গাওয়ার বায়নাটা রাখা গেলনা। ওই ইচ্ছে পূরণ করতে পারলামনা।
বিয়ের পর লকডাউন। আসা যাওয়া কম। কিন্তু তার মধ্যেই এক সন্ধ্যের ভিসিটে আঙ্কেলের লেখা লকডাউন প্রসঙ্গে কবিতায় সুর দিয়ে, দেড় দু ঘন্টায় গানের ফেবু পোস্ট। যে না গায়িকা আমি -মানি তাতে সুরকার! অর্থাৎ শান্তি যে কপালে আমাদের নেই ভুলে গেছিলাম।
শেষ যুদ্ধের প্রথম সংকেত, লকডাউনের মধ্যেই অনিয়মের পর রিপোর্টৈ হেমগ্লোবিন আশ্চর্যরকম কম। ডাক্তার বললেন রক্ত দিন। সে কি কান্ড! দু দুটো নার্সিং হোমে কমপ্লিকেশনে বিফল হয়ে মেডিক্যাল কলেজে আইসিইউ তে সম্ভব হলো। ” আপনার দেউতা হয় নিকি?” এখানেও ব্যতিক্রম হলোনা। আমি তখন মায়ের ঘরে কদিন থাকতে এসেছিলাম। হাইয়ার সেন্টারে যাবার উপদেশে সোজা ঘরে ফিরবার পালা, তবে চার তলাতে নিজের ফ্ল্যাটে নয় ,ডাক্তারনির ঘরে যাওয়াই স্থির, দাবি আছে যে। ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে শরীর এখন এই, তখন সেই, তবুও রঙ্গ তামাসা হাসি মুখে লেগেই থাকতো। আমার ঘরে এটাই প্রথম এবং শেষবারের মত রাত যাপন । তারপরই পাড়ি দিতে হলো গৌহাটি, একা ওরা দুজন,আমার যাওয়া হলনা । এই আপসোসটা হয়তো রয়েই যাবে জীবনে। গৌহাটিতে প্রথম ডাইলাইলিস আমার রুমে থেকে হয়েছিল। লকডাউনে কোভিড কালে কতরকম কাঠখড় পোড়াতে হবে আঁচ করতে পেরেছিলাম শিলচর থেকেই। গেলেও কতটুকু করতে পারতাম জানিনা, তবু পাশে থাকতে পারতাম, পাশে থেকে চিরবিদায় দেওয়ার সুযোগটুকু পেতাম অন্তত। শেষ দেখা এম্বুলেন্সে যাবার বেলায়, বলেছিলাম ” আঙ্কেল সব ঠিক হবে , ডোন্ট ওয়ারি”। একিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া বুড়ো আঙুল দেখালো আমায়।
ভালো লাগছিলো না , উজ্জ্বল শক্ত আঙ্কেলটা আমার দুর্বল নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। ভিডিও কলিং এ শেষ দেখা। খেতে না পারা, নিরন্তর ইনজেকশনের খোঁচা একই হাতে বারবার, জ্বর ,তারপর গা, হাত পা ব্যথা, কালো কালো রক্ত জমাটের দাগ, যখন তখন মুখে, গামে রক্তক্ষয়..
শারীরিক দু্র্ভোগের অন্ত হলো, হঠাৎ যেন কালো মেঘ, খারাপ খবর, ফোনটাই সম্বল কিন্তু বাকি আর কিছুর আশা নেই। বুঝতে পেরেছি যে শেষটা শুরু হচ্ছে।
শেষ দেখা না পাওয়ার ক্ষোভ জমে আছে, তবু শান্তনা দিই যে চরম শারীরিক ভোগান্তির চেয়ে না ফেরার দেশের শান্তির তৃপ্তি ঢের ভালো।
আজ তোমার জন্ম দিন, শিলচরেই আছি , কিন্তু দোসা ,দৈ বড়া , হসপিটাল রোডের চিকেন চপ কিছুই আনবেনা আজ তুমি তবু বলি” হ্যাপি বার্থডে আঙ্কেল, ভাল থেকো তুমি, আমরা সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করছি, তবে ছোট্টা মানি তোমায় খুব মিস করে,তবু ভাল রাখার চেষ্টা করছি আমরা সবাই। বলি তো , যে তুমি ভাল আছো, শুধু ওপারে আছো, তবু বোঝেনা। সবাই তোমার বরাককে ভালবাসলে , তোমার ইচ্ছে গুলো পূর্ণ করলে হয়তো তুমি খুশি হবে। যখন দেখা হবে, আর হয়তো বকুনি পড়বে না তোমার, গর্ব করবে আমাদের ওপর।
আসলে দু’দুবার বাবা হারানোর শোকে সহজে সহজ হওয়া যায়না। আর প্রিয় মাসিটির মনমরা মুখটাও ভাল লাগেনা, ওর কষ্টের চাপটা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
আঙ্কেল সঙ্গেই আছে, তার বৌদ্ধিক চিন্তা ভাবনায়, তার আদর্শে , তার অসম্পূর্ণ সামাজিক কর্মে, চিরদিন রয়ে যাবে তার চিহ্ন।
” ….. হয় যেন মর্তের বন্ধনক্ষয়, বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়–
পায় অন্তরে নির্ভয়, পরিচয় মহা অজানার।।”
The author of this article, Dr. Deepmala Dev is an Ayurvedic Surgeon, currently practicing in Barak Valley.
Comments are closed.