ঈদুল ফিতর : পাপমুক্তি ও দানের আনন্দ
কাজি নজরুল লিখেছেন, “শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো, কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো, বরষের পরে আনিলে ঈদ”। এ কবিতায় নজরুল বোঝাতে চেয়েছেন যে অসংখ্য মরুভূমি, বালুচর আর অনাবিল আঁখিজল পেরিয়ে এসেছে ঈদ। তিনি বলতে চেয়েছেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সুখ-দুঃখের সমভাগী হয়ে অধিকার ভোগ আর দায়িত্ব পালনের মধ্যে যে প্রকৃত আনন্দ আছে, সে শিক্ষাই নিহিত হয়ে আছে ঈদের প্রকৃত উদযাপনে।
আরবি ‘আওদ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের উৎপত্তি। এটি সাধারণত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়, প্রথম অর্থে আনন্দ বা খুশি ও দ্বিতীয় অর্থ বারবার হাজির হওয়া বা ফিরে আসা প্রভৃতি। আবার রমজান মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘রমজানুল মোবারক’ মানে বরকতময় রমজান। শাওয়াল মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘শাওয়ালুল মুআজ্জম’ অর্থাৎ মহিমাময় শাওয়াল। আরবি ‘রমজ’ শব্দ থেকে রোজা শব্দের উৎপত্তি। ‘রমজ’ অর্থ পোড়ানো বা জ্বালানো। প্রত্যেক মানুষের স্বভাবে দু’টি বিপরীতমুখী প্রবণতা রয়েছে, একটি সৎ, অন্যটি অসৎ। আগুনে পুড়িয়ে কোনো ধাতুকে যেমন নিখাদ করা হয়, ঠিক তেমনি রোজা মানুষের সেই অসৎ প্রবৃত্তি নাশ করে তার মধ্যে সৎ প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটায়। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র একটি মাস একনিষ্ঠভাবে সিয়াম সাধনার পর মহান প্রভুর দরবার থেকে প্রতিজন রোজাদারের জন্য যে দিনটি সুসংবাদ নিয়ে আসে সেই দিন হচ্ছে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। পৃথিবীব্যাপী মুসলিমরা এই ঈদের দিনের আনন্দকে অঙ্গীকার হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ঈদের অর্থ যেমন খুশি তেমন ‘ফিতর’ এসেছে ফিতরা থেকে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের অর্থ দাঁড়ায় দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার (দান) মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। এভাবেই এক মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ, সুচিন্তিত ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় সাদা-কালো, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ সবার জন্যই ঈদের দিনটি হয় একটি নির্মল আনন্দের দিন, একটি মহামিলনের উৎসব। ঈদের শিক্ষা হলো সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্প্রসারণ।
একমাস গভীর সাধনার সঙ্গে সিয়াম পালনের পর ঈদ আমাদের যে অনুভূতি প্রদান করে তা হচ্ছে নিজের মনের হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহংকার, অহমিকা, আত্মম্ভরি, আত্মশ্লাঘা, রাগ-ক্রোধ, বিদ্বেষসহ যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার আনন্দ। তখন দীর্ঘ এই একমাসে অর্জিত আদর্শবাদিতা, মার্জিত রুচিবোধ আর শালীনতার প্রকাশ ঘটে এই উৎসবে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সামাজিকতা এবং মানবতাবোধকে সমুন্নত করাই ঈদের মূল তাৎপর্য হয়ে উঠে। ছন্নছাড়া ও বিকৃত আনন্দ ও খুশি কিন্তু ঈদের অর্থের সমার্থক হতে পারেনা কারণ অতি করুণা প্রবর্তিত একটি মাসে আমাদের পালনকর্তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমরা ইবাদত করার সুযোগ পেয়েছি বলে মহাখুশি; তাই তাঁর শোকর বা কৃতজ্ঞতা আদায় করার জন্য ঈদের দিনে ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত নামাজ আদায় করে থাকি। এজন্যই ঈদের নামাজকে ‘সালাতুশ শুকর’ তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামাজ বলা হয়। এতেই মোমিন বান্দার জন্য ঈদের সমস্ত আনন্দ নিহিত আছে। কারণ, ইসলামে আনন্দ উৎসব সবই মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্য বা ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের দিকে চেয়েই করা হয়।
কিন্তু পরিস্থিতি সাপেক্ষে আজ কিছু প্রশ্ন বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, “কৃষকের ঈদ” কবিতাতে নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন “জীবনে যাদের হররোজ/রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিদ/মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে/এসেছে কি আজ ঈদ? আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে ঈদ উদযাপন যেন বড়ই অনুষ্ঠানসর্বস্ব ও ভোগসর্বস্ব হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল তাৎপর্যই যেন অনুপস্থিত থাকছে। মুসলিম বিশ্বের একাংশে যেমন ঈদকে নেহাৎ প্রথাগত, অপসংস্কৃতি ও জাগতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পালিত করা হচ্ছে। অপসংস্কৃতির সয়লাব যেন এ পবিত্র উৎসবটিকে গ্রাস করে ফেলছে। ‘ঈদ’ শব্দ শুধু কৃত্রিম আনন্দের বহি:প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে, যেথায় স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ ও আনুগত্য প্রকাশ অতি ক্ষীণ হয়ে যায় ঠিক তেমনি ‘ফিতর’ শব্দের তাৎপর্য ও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যেখানে দান খয়রাত দরিদ্র মানুষের ঘরে নিয়ে পৌঁছানোর কথা সেথায় গরীব লোকগুলো ধনীদের ঘরে এসে ধর্ণা দিতে হয়! এমন চিত্র দান খয়রাতের প্রকৃত অর্থকে ধূলিস্যাৎ করে দেয়। একাংশ যুবপ্রজন্ম এই পবিত্র দিনে মেতে উঠে লাগামহীন বিকৃত আনন্দ উপভোগে, আল্লাহের আদেশ ও নবী (স:) এর সুন্নতের দিকে বিমুখ থেকে নিজস্ব ধারায় আনন্দ উপভোগে মেতে উঠা এই প্রজন্ম ঈদের আবির্ভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তারা জানেই না যে আল্লাহর আদেশে নবী (স:) মুমিন বান্দাদের জন্য বিকৃত আনন্দের বদলে ইবাদত স্বরূপ আনন্দ ও খুশির জন্যই বছরে দুটো ঈদ উপহার দিয়েছেন। তবে এবার যুবপ্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে, ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করে আমাদেরও নতুনভাবে জাগতে হবে। সমাজের অভাবী-দুঃখী মানুষগুলোকে সুখী-স্বাবলম্বী করে তুলতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হয় এমন সব কর্ম করতে পারলে তবেই এই ঈদ পালন সার্থক ও সুন্দর হবে। হতাশার মধ্যে আমাদের বরাক উপত্যকায় মুসলিম যুবসমাজে কিছুটা আশার আলো পরিলক্ষিত হচ্ছে, ঈদের প্রারম্ভে বিভিন্ন স্থানে ‘ঈদ কিট’ প্রদান করে গরিব অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রচেষ্টা শুধু প্রশংসনীয় নয় বরং বেশ আশাব্যঞ্জক, এই মানসিকতা যদি যুবপ্রজন্মে বিস্তার ও ব্যাপকতা লাভ করে তবে স্রষ্টার বিধান মতে একদিন আমরা ঈদের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে সক্ষম হব। মূলত রমজান হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি প্রশিক্ষণের মাস, আর ঈদ হচ্ছে সেই প্রশিক্ষণের ফলাফল বা পুরস্কার পাওয়ার দিন। আর এই প্রশিক্ষণের প্রভাব যাতে আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে প্রতিফলিত হয় এবং তার মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবার উপর যাতে সন্তুষ্ট থাকেন সেটাই হচ্ছে রমজান ও ঈদের আসল পাওনা।
Comments are closed.