Also read in

ভ্যাকসিন স্ক্যাম!! ডোজ পেতে নাজেহাল জনগণ; অথচ সিভিল হাসপাতাল চত্বরেই স্বাস্থ্যকর্মীরা চালাচ্ছেন গোপন সেন্টার

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রায় প্রতিদিন নতুন রেকর্ড গড়ছে এবং সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছেন। জেলার বিভিন্ন সেন্টারে ভ্যাকসিনের অভাব রয়েছে বলে প্রতিদিন শতাধিক লোককে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ সিভিল হাসপাতাল চত্বরে গোপনে একটা সেন্টার চলছে যেখানে কোনও ধরনের রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে ভ্যাকসিন। যেসব লোকেরা ভ্যাকসিন পেয়েছেন, তাদের কোনও তালিকা লিখে রাখা হয়নি। উপস্থিত আধিকারিকরা একেকজন একেক ধরনের যুক্তি দিচ্ছেন। তারা পরিষ্কার বলছেন, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ১০ শতাংশ ভ্যাকসিন নষ্ট হতেই হবে।হয়তো এই ১০ শতাংশের অজুহাতে চলছে বিরাট ভ্যাকসিন স্ক্যাম।

সেখানে উপস্থিত আধিকারিকরা একটা মেসেজ দেখিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন প্রদান কেন্দ্রে যেসব ভাইলে কিছু ডোজ থেকে যাবে তখন সেগুলো আগে থেকে নাম লেখানো কিছু কিছু ব্যক্তিদের দেওয়া যাবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ভ্যাকসিন ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট। তবে সিভিল হাসপাতালের গোপন ভ্যাকসিন সেন্টারে সোমবার এবং মঙ্গলবার মিলিয়ে মোট আটটি নতুন ভাইল খুলে ডোজ প্রদান করা হয়েছে। একটি ভাইল থেকে দশজনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত এএনএম সর্বানী রায় কথাটি স্বীকার করেছেন। তবে তিনি জানেন না কোথা থেকে ভাইল এসেছে এবং তিনি কাকে কাকে ভ্যাকসিন দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমি মূলত উধারবন্দের সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করি। ভ্যাকসিন প্রক্রিয়ার জন্য আমাকে সম্প্রতি এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। শনিবার প্রথম এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সোমবার এবং মঙ্গলবার মিলিয়ে প্রায় ৮টি নতুন ভাইল খুলে ডোজ প্রদান করা হয়েছে। তবে আমি শুধুমাত্র আরেক আধিকারিকের কাছ থেকে সেটা পেয়েছি, তারাই দেখিয়ে দিয়েছেন কাকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। কোনও নাম লিখে রাখার প্রক্রিয়া ছিলনা, আমি কতজনকে ভ্যাকসিন দিয়েছি সেটা জানিনা।”

সিভিল হাসপাতালে কোভিড ওয়ার্ড সংলগ্ন অতিরিক্ত মুখ্য চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য আধিকারিকের কার্যালয়ে একটি কক্ষে এদিন ভ্যাকসিন প্রদান প্রক্রিয়া চলছিল। সেখানে দেখা গেছে ডাস্টবিনে প্রায় শতাধিক ব্যবহার করা সিরিজ রয়েছে। এছাড়া বারান্দার পাশে ঘাসে অনেকগুলো সিরিঞ্জ এবং ভ্যাকসিনের খালি কৌটো ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে সোমবার ৫০ জনের বেশি লোক ভ্যাকসিন পেয়েছেন এবং মঙ্গলবার প্রায় এর কাছাকাছি সংখ্যায় লোক উপস্থিত ছিলেন। ৩০ জনের মতো লোক ভ্যাকসিন পেয়েছেন এবং বাকিরা পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকায় ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে গেছেন।

যে কক্ষে ভ্যাকসিন দেওয়া চলছিল, এর পাশেই আরেকটা কক্ষে বসেছিলেন স্বাস্থ্যকর্মী স্বর্ণজিত পাল। তিনিই ঠিক করছিলেন ভ্যাকসিন কারা পাবেন এবং সেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন নার্স সর্বানী রায়কে। তাকে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে তিনি বলেন, অতিরিক্ত জেলাশাসক সুমিত সত্যওয়ান তাকে ১৮ জন বিএসএনএল কর্মীর নাম পাঠিয়ে বলেছিলেন তাদের ভ্যাকসিন প্রদান করতে। তিনি সেভাবেই কাজ করেছেন। ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়ার আওতায়, অর্থাৎ বিভিন্ন ভ্যাকসিন সেন্টারে যেসব ভাইলে বেশিরভাগ ডোজ থেকে গেছে, সেগুলো এনে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি একটি মেসেজ দেখান যেখানে বলা হয়েছে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করা ব্যক্তিদের এই প্রক্রিয়ায় ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।

 

 

তবে তারা আসলে সব ধরনের নিয়ম লঙ্ঘন করে নতুন ভ্যাকসিন ভাইল খুলে ডোজ প্রদান করেছেন। যাদের ডাকা হয়েছিল, তারা শুধুমাত্র বিএসএনএল কর্মী নন, বিভিন্ন সাধারন মানুষও এতে ছিলেন। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসায় স্বর্ণজীত পাল সহ অন্যান্য আধিকারিকরা ঘাবড়ে যান। স্বর্ণজীত পাল বলেন, “আমরা অতিরিক্ত জেলাশাসক সুমিত সত্যওয়ানের নির্দেশে এখানে ভ্যাকসিন প্রদান করছি। আমাদের বলা হয়েছিল প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে এই ধরনের ভ্যাকসিন প্রদান চলবে। এতে সাধারণ মানুষ এসে ভ্যাকসিন নিতে পারেন। তবে এই খবরটি জনসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের ডিএমই সুমন চৌধুরীর। তিনি কেন জনগণকে এব্যাপারে জানালেন না, এর উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব তার অথবা সুমিত সত্যওয়ানের।”

সংবাদমাধ্যমের লোকেরা প্রশ্ন তোলার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণজিত পাল উপস্থিত লোকদের চলে যেতে বলেন। এতে কিছুটা বিরক্ত হন অপেক্ষারত ভ্যাকসিন প্রত্যাশীরা। পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয় এবং সামাল দিতে মাঠে নামেন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য আধিকারিক পিকে রায়। তিনি বলেন, “ডিস্ট্রিক্ট ইমুনাইজেশন অফিসার ডাঃ সুমনা নাইডিংয়ের বাড়িতে এক ব্যক্তি মারা গেছেন, ফলে তিনি দুদিন ধরে ছুটিতে। সোমবার আমার ডায়ালাইসিস ছিল, ফলে আমি ছুটিতে ছিলাম। এই সুযোগে এখানে ভ্যাকসিন নিয়ে একটা কালোবাজারি হয়েছে। এটা অবশ্যই নিন্দনীয় এবং এর বিরুদ্ধে বিভাগের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের জেলায় ভ্যাকসিনের অভাব রয়েছে এবং প্রত্যেকে আরও বেশি করে ভ্যাকসিন চাইছেন। সম্প্রতি কাটিগড়ার নবনির্বাচিত বিধায়ক আমাকে ফোন করে বলেছেন তার এলাকায় আরও বেশি ভ্যাকসিন পাঠাতে। এমন একটা সময়ে এভাবে ভ্যাকসিন নিয়ে ছেলেখেলা করা উচিত হয়নি।”

 

(L-R) Empty Covaxin vial thrown on the ground violating medical waste management guidelines. Also these vials needs to be stored for bookkeeping. Empty Covishield vial that was opened today.

 

গুয়াহাটি থেকে তিন জেলার জন্য একসঙ্গে ভ্যাকসিন পাঠানো হয়। একটা সেন্ট্রাল কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে, সেটা দেখার দায়িত্বে একজন আধিকারিক রয়েছেন। কাছাড় জেলার ডিস্ট্রিক্ট ভ্যাকসিন স্টোর ইনচার্জ প্রভাত সিনহা বলেন, “সিভিল হাসপাতালে এই কার্যালয়ের নামে ভ্যাকসিনের নতুন ভাইল ইস্যু করা হয়নি। সোমবার এবং মঙ্গলবার আরবান হেলথ সেন্টারের নামে ভ্যাকসিন ইস্যু করা হয়েছিল এবং সেটা ব্যবহার হয়েছে সিভিল হাসপাতালে গোপন ভ্যাকসিন সেন্টারে। তবে কার নির্দেশে এটা হয়েছে সেটা তিনি জানেন না, তার দায়িত্ব হচ্ছে ভ্যাকসিন ভাইল ইস্যু করা।”

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় সিভিল হাসপাতালে উপস্থিত হন অতিরিক্ত জেলাশাসক সুমিত সত্যওয়ান। তিনি প্রথমে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও শেষমেশ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হন। সাদামাটা ভাষায় তিনি বলেন, “পুরো ঘটনার তদন্ত হবে এবং যারা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছেন, যদি কোনও অন্যায় করে থাকেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তিনি আরও জানান, এই সেন্টারে একেবারে ইমারজেন্সি প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে। পুলিশ, স্বাস্থ্যকর্মী সহ অনেকেই আলাদাভাবে এখানে ভ্যাকসিন পেয়েছেন। সম্প্রতি বিএসএনএলের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং তিনি কয়েকজন লোককে ভ্যাকসিন প্রদানে অনুমতি দেন। তবে এই ফাঁকে অনেক বেশি লোক ভ্যাকসিন নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, সেটা তদন্ত করবে প্রশাসন।

 

It is in this office the chamber is located

 

সিভিল হাসপাতালের সুপার ডাঃ জিতেন সিংহ আক্ষেপের সুরে বলেন, হাসপাতালে প্রায় শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী এখনও ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পাননি। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগে এমন একটা কার্যকলাপ চলছে। তিনি জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হাসপাতালে প্রত্যেক কর্মীর নাম তালিকাভুক্ত করে পাঠানো হয়েছে, তবে এখনও ভ্যাকসিনের অভাব রয়েছে বলে অনেককেই দেওয়া হয়নি।

Comments are closed.