Also read in

“প্রাইভেট টিউশন, যা কিনা চামচ দিয়ে খাওয়ানোর মতো, অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন” : উপাচার্য দিলীপ চন্দ্র নাথ

শিক্ষাকে উন্নতির অন্যতম প্রাথমিক স্তম্ভ হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে,শিক্ষাই একটা সমাজকে উন্নততর করে তুলতে সক্ষম । বরাক উপত্যকার শিক্ষার অবস্থা একই সাথে মহিমান্বিত এবং দুঃখজনক । এখানে মাঝারিদের সমুদ্রে দ্বীপের মতো উজ্বল মেধাও অবস্থান করছে ,কারণ এরা বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ থেকে আসছে। যদিও কিছু ছাত্র সুবিন্যস্ত পরিবার থেকে আসছে , কিন্তু অনেক  ছাত্রদের  অভিভাবকরা  এখনো  নিরক্ষর ।   

হাতেগুনা কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া (দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত) সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সরকার  দ্বারা পরিচালিত। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডি সি নাথ মনে করেন, সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা  দিনে দিনে নিম্নগামী হচ্ছে ।    

শ্রী নাথ এর উজ্বল শিক্ষা জীবন কাটিগড়ার এক গ্রাম্য বিদ্যালয় বলেশ্বর স্কুল থেকে শুরু হয়েছিল। এরপর তিনি গুরুচরন কলেজ, কটন কলেজ হয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হন । তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক্ট্রেট গবেষণা সম্পন্ন করেন।

বরাক উপত্যকায় শিক্ষার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে   তিনি কি ভাবছেন এবং উন্নতির জন্য কি কি করা দরকার সে সম্পর্কে আমরা তার সাথে কথা বলি। বরাক বুলেটিন.কম এর সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে, উপাচার্য শিক্ষার্থীদের মানসিকতা, ত্রুটি এবং এক্ষুনি কি করনীয়   সে সম্বন্ধে বলেছেন…   

সাক্ষাৎকারের  সম্পাদিত অংশ তুলে ধরছি :

আসুন আপনাকে স্কুল জীবনে নিয়ে যাই, আপনার সময়ের স্কুল থেকে আজকের স্কুলের ফারাক টা কি?

আমি গ্রামের স্কুলে পড়েছিলাম, বর্ষার সময় স্কুলের ছাঁদ থেকে জল পড়ত, প্রায়ই জল জমে যেত,  তবুও কোনও ছাত্র তাদের ক্লাস  কামাই করত না। কারন হচ্ছে  আমরা তখন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক পেয়েছিলাম।  তাই   যখনই পার্থক্যের কথা আসে, তখন আমি বলব পরিকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে কিন্তু শিক্ষকের নিবেদিতপ্রাণতা কমে গেছে। আজকের শিক্ষকেরা আমাদের  সময়ের মতো উৎসর্গীকৃত নন …

এই অবনমনের কারনটা কি?

আমি মনে করি শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষের ভিতরের শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেননা; তাদের অধিকাংশই স্কুলের পরই প্রাইভেট টিউশনে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়াও, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে শুধুমাত্র পেশাগতভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকদেরকই শিক্ষাদানের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।

কিন্তু  আপনার স্কুলজীবনের দিনগুলোতে তো প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছিলেন না …

হ্যাঁ, তা সত্যি ; মনে রাখবেন আমি একটি ভেঞ্চার স্কুলে পড়াশুনা করেছি, যার কোনও সরকারি সহায়তা ছিল না। শিক্ষকরা অত্যন্ত উৎসর্গীকৃতপ্রাণ ছিলেন তাই শিক্ষাদান করতে করতেই নিজেরা প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন এবং সময়ের সাথে নিজেদেরকে উন্নত করে নিয়েছিলেন। ভাষা ছাড়া, অন্য সব বিষয়ে আমরা উচ্চমানের শিক্ষক পেয়েছিলাম; বরাক উপত্যকায় শুধুমাত্র ভাষা বিষয়ে উচ্চ মানের শিক্ষকের অভাব ছিল

ছাত্রদের মান সম্পর্কে কি বলবেন? আমরা কি আগের তুলনায় এখন ভাল মানের ছাত্র তৈরি করতে পারছি?

আজকাল, প্রত্যেক ছাত্রকেই প্রাইভেট টিউশন নিতে হচ্ছে, যা কিনা চামচ দিয়ে খাওয়ানোর মতো, তাই তা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। প্রাইভেট টিউশন নানাভাবে একটি শিশুর ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়, যা আসলে দীর্ঘমেয়াদী অপূর্ণতার সূচনা করে। এই ভাবে চিন্তা করুন, আপনি একটি অঙ্ক সমাধান করতে পারছেননা;  আপনি বসুন, এটি কিভাবে সমাধান করবেন তা নিয়ে চিন্তা করুন, আরেকটু  চেষ্টা করুন, ব্যর্থ হলেন – আবার চেষ্টা করুন এবং তারপর অবশেষে আপনি এই অঙ্ক সমাধানের একটি উপায় পেয়ে  যাবেন। এই ভাবে আপনি আপনার  চিন্তাশক্তি বিকাশ করবেন, যা জীবনের অত্যন্ত অপরিহার্য। প্রাইভেট টিউশনগুলি শিশুর মেধাকে সীমিত করে দেয়।

ঠিক আছে, কিন্ত যারা ক্লাসে ঠিক মতো নিতে পারছেনা, তাদের সঙ্গে মেধাবীদের ফারাকটা কি থেকেই যাবে ?

তেমন  ছাত্রদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা উচিত।

Vice Chancellor, Dilip Chandra Nath in his office

কিন্তু আলাদাভাবে কিছু একটা করা প্রয়োজন?

হ্যাঁ, এর জন্য আমাদের কিছু সংস্কার প্রয়োজন।আমি আবার বলব প্রত্যেক ছাত্রের কিছু ক্ষমতা আছে,  কেউ অঙ্কে ভাল হবে, কেউ ইংরেজিতে  আবার কেউ কেউ  দুটো বিষয়েই ভাল হবে। একজন শিক্ষক হিসাবে আপনার দায়িত্ব হল ভালোকে আরও ভালো করা এবং যারা  দুর্বল তাদেরকে সবল করে তোলা  ।

মেধাবী ছাত্র তৈরিতে বরাক উপত্যকার  বেসরকারি স্কুলগুলোর অবস্থানই কি সবচেয়ে ভালো ?  

 বেসরকারি স্কুলের তুলনায় সরকারী স্কুলগুলিতে  অনেক বেশী যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক আছেন । ছাত্রদের প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই  যে হ্যাঁ  শিলচর ও করিমগঞ্জে বেশ  কয়েকটি ভাল স্কুল আছে এবং তারা মেধাবী ছাত্র তৈরি করছে । কিন্তু সামগ্রিক বিচারে তারা মুষ্টিমেয়।  আমরা যদি সরকারি স্কুলের উন্নতি করতে পারি তবেই আমরা সার্বিক উন্নতি ঘটাতে পারব ।

উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন  ?

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করে সকল ছাত্রছাত্রীর স্নাতক  ক্লাসে ভর্তি হওয়া অনুচিত ।  তাদের পেশাদারি এবং দক্ষতা উন্নয়ন কোর্সের জন্য অবশ্যই যেতে হবে; শুধুমাত্র যারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে  ইচ্ছুক তারাই স্নাতক হওয়ার জন্য ভর্তি  হওয়া উচিত। সেভাবে আমরা শুধুমাত্র যোগ্য ছাত্রদেরকে  স্নাতক ক্লাসে পাব এবং একটা মান বজায় থাকবে ।

আপনি কি ধরনের প্রতিযোগিতার কথা বলছেন, একটু ব্যাখ্যা করতে পারেন?

ঠিক আছে, বিএইচইউ, এনআইটি বা অন্য কোনো উচ্চ  মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক  পরীক্ষার মাধ্যমে হয়ে থাকে ;  কোন শিথিলতা থাকেনা । এইভাবে শুধুমাত্র ভাল ছাত্ররাই ওই সব প্রতিষ্ঠানে  পড়াশুনা করছে । এখন উদাহরণস্বরূপ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে পারি , আমরা স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের ভর্তি প্রক্রিয়া শিথিল করি। আমরা তাদের এখানে অধ্যয়ন করার সুযোগ দিতে চাই, যা কিছুটা সঠিক। কিন্তু  ভর্তি প্রক্রিয়া শিথিল হওয়ায়  ভাল এবং সাধারনের একটি মিশ্রণ থেকে যায় শেষ পর্যন্ত।  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে মিশ্রণটি একটি বড় পার্থক্য তৈরি করে দেয়  …

কেন মিশ্রণটা   সমস্যা হচ্ছে কি করে  ?

উজ্জ্বল সবসময় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে চায়, তাই ভালো ছাত্ররা যখনই সুযোগ পায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়  ছেড়ে চলে যায়। এখানে আমদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ইঞ্জিনিয়ারিং  কোর্স আছে কিন্তু ভাল ছাত্ররা সুযোগ পেলেই  বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ভাল এনআইটিতে চলে যায় ।   অন্যান্য বিভাগে ও একই ঘটনাটছে। শুধুমাত্র এমবিএ  ভর্তির ক্ষেত্রে কোনও শিথিলতা  নেই, তাই ছাত্ররা এই বিভাগে থেকে যাচ্ছে এবং তাদের নিয়োগ খুব ও ভালো ।

ছাত্রছাত্রীদের  বাইরে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেকদিন ধরেই চলছে , কেন এমন হয়?

দুটো কারণে ছাত্ররা বাইরে চলে যান, এক: উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দুই: প্রবনতা। উচ্চতর শিক্ষাতে বরাক উপত্যকায় গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাই উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা সব সময়ই বাইরে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন ।  তারপর আছে বাইরে যাবার প্রবনতা – আপনি যদি উচ্চবিত্ত পরিবারের হন তাহলে এমন একটা কোর্স করবার জন্য বরাক  উপত্যকার বাইরে চলে যাবেন,  যা আপনি সহজেই  এখানে করতে পারতেন । এছাড়াও, কোর্স করবার  পর প্লেসমেন্ট ও একটি বড় সমস্যা যার জন্য ছাত্ররা  বরাক উপত্যকা ছেড়ে বাইরে  চলে যায় , তাই এটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং প্রবনতার একটি মিশ্রণ।    

আপনি দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যয়ন করেছেন এবং কিছু সময়ের জন্য বিএইচইউ-তে  শিক্ষাদান ও করেছেন ।  বরাক উপত্যকা থেকে যাওয়া ছাত্র এবং দিল্লী মুম্বাই বা পুনে থেকে  যাওয়া ছাত্রদের মধ্যে ফারাকটা কোথায় ?

দেখুন, শুধু ভাল ছাত্রই বিএইচইউ, ডিইউ অথবা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন, তাই প্রতিভা একই। পার্থক্য হচ্ছে ভাষার দখল, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব এবং  পেশাদারিত্ব  এবং এর কারন হচ্ছে আমরা এখানে এভাবেই বড় হয়েছি । আমি আপনাকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি এখানে (অসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে) বা গুয়াহাটিতে (গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে), আপনি লাইব্রেরিতে  ছাত্রদের  গল্পগুজব করতে দেখবেন, পড়াশুনা করতে কমই দেখবেন ; কিন্তু  BHU তে  আপনি বসার   জায়গা পাবেন না, ছাত্র এবং শিক্ষকদের  গ্রন্থাগারে নিঃশব্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় দেখতে পাবেন – ফারাকটা এইখানেই ।

আজকাল ছাত্ররা  AIEEE   বা AIPMT (অল ইন্ডিয়া প্রি মেডিক্যাল টেস্ট)  এবং কোচিং ক্লাসগুলির ব্যাপারে খুবই  সচেতন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আমি মনে করি যে আমাদের স্কুলগুলির সিলেবাস   এমনভাবে  তৈরি করতে হবে যে, শিশুটি  বিদ্যালয়ে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সে JEE বা AIPMT বা অন্য কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যাবে,এখনই হচ্ছে  এর উপযুক্ত সময় । স্কুল তাদের এমনভাবে গড়ে তুলবে যাতে এক বছর স্কুল বাদ দিয়ে বিভিন্ন বেসরকারী কোচিং সেন্টারগুলিতে যোগদান করতে না হয়।

কিন্তু আমদের কি প্রাক স্নাতক স্তরে এমন শিক্ষক আছেন  যারা বাচ্চাদের এমন ভাবে গড়ে তুলতে পারবেন?

  সরকারি স্কুলগুলির শিক্ষকদের(একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণীর) মধ্যে এটা করার যথেষ্ট  ক্ষমতা রয়েছে। এই একই শিক্ষক  কোচিং সেন্টারগুলিতে শিক্ষা দেন এবং ছাত্রদের পাশ ও করান । তারা এখানে কেন করতে পারবেন না? কারণ তারা চান না। কোচিং সেন্টারগুলি কি? এগুলো শুধু  অতিরিক্ত ক্লাস যেখানে কোন একটা বিষয়ের উপর গভীর ভাবে বোঝান হয় । প্রাক স্নাতক স্তরের স্কুল গুলোতে কি এমনটা হতে পারে না ? হ্যাঁ পারে, কিন্তু আপনি একজন সরকারি শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত অর্থ চাইতে পারবেন না, তবে কোচিং সেন্টারগুলিতে আপনি তা অনায়াসে পারেন ।তাই এমন এক শিক্ষা নীতি চাই যাতে শিক্ষকরা উপযুক্ত রোজগার করবেন এবং ছাত্রদের ও কোচিং ক্লাসে যেতে হবেনা ।

সবশেষে, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এই মুহূর্তে সঠিক কি  প্রয়োজন অর্থাৎ সময় কি দাবী করছে ?         

চারটি স্তম্ভ আছে, যাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এক: সরকার, যা পরিকাঠামো  প্রদান করবে, নীতিগুলির  সংস্কার  করবে । দুই: মাতাপিতা, শিশুকে স্কুলে পাঠানোই যথেষ্ট নয়; বাবা-মা দুজনেরই  ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ের  সঙ্গে সম্পর্ক রাখা  প্রয়োজন। তিন: শিক্ষক – আমরা শিক্ষা দানের  জন্য শুধুমাত্র  পেশাগতভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকই চাই । এবং চার: ছাত্র

আমরা যদি এই  চারটি স্থম্ভকে একসাথে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারি , তাহলে চমৎকার ফল বের করে আনতে পারব।

 

আমাদের সংবাদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন: editorial@barakbulletin.com

 

Comments are closed.