Also read in

মহড়ায় কারোর প্রক্সির মাধ্যমে যাত্রা শুরু, চার দশক ধরে মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্কটা গাঢ় থেকে গাঢ়তম হয়েছে; অভিজ্ঞ নাট্যশিল্পী সুব্রত রায় শম্ভুর সঙ্গে কিছুক্ষণ

থিয়েটারের কথা যখন আসে তখন কেউই একটা সত্যকে অস্বীকার করতে পারবেন না যে এই শিল্প খুবই প্রভাবশালী এবং শিল্প-কলার ক্ষেত্রে অন্যতম চাহিদাপূর্ণ মাধ্যম। সংলাপ নিক্ষেপ, অভিনয়, অনুভূতি, আবেগ সবকিছুর সমন্বয়ে যখন মঞ্চে সুষ্ঠুভাবে থিয়েটার উপস্থাপিত হয় তখন এর থেকে চোখ ফেরাবার উপায় থাকে না দর্শকদের।

থিয়েটার এমনই একটা শিল্প মাধ্যম যেখানে এই শিল্পের পাশাপাশি প্রয়োজন আরো কয়েকটি শিল্পের, যেমন অভিনয়, কখনও নাচ, কিছুটা সঙ্গীত এবং পাশাপাশি আবৃত্তি। এই সবকিছুর কারণেই থিয়েটার তার নিজস্ব জায়গায় অনন্য হয়ে উঠতে পারে, বললেন শিলচর তথা আসামের একজন প্রবীণ নাট্যশিল্পী ৫৪ বছর বয়সী সুব্রত রায় সম্ভু।

পেশায় প্রথমে একজন ইঞ্জিনিয়ার থেকে বর্তমানে ব্যবসায়ী সুব্রত রায় বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক থিয়েটার জগতে যেমন নিজের এক অনন্য জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছেন, তেমনি সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য নাটক অভিনয় করে মঞ্চ মাতিয়ে দিয়েছেন। গণসুর নাট্যদলের পরিচালক তথা প্রযোজক সুব্রত রায় যিনি সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে এই নাট্যশিল্পে যুক্ত হয়েছিলেন, চার দশক পেরিয়ে গেলেও এই শিল্প এবং শিল্পকর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা গাঢ় থেকে গাঢ়তম হয়েছে। “আমি মনে করি এটা আমার রক্তে রয়েছে। এটি আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। থিয়েটার ছাড়া আমি আমার নিজের জীবনটাকে কোন ভাবেই দেখতে পারিনা। গত কয়েক বছরে বরাক উপত্যকা জুড়ে থিয়েটার বিপ্লবে থিয়েটারের জন্য উৎসর্গীকৃত এই শিল্পী তারই মতো আরো অনেক শিল্পীদের মধ্যে এক অনন্য অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছেন।

যৌবনে এই শিল্পের প্রেমে পড়ার ঘটনাটাও অনন্য।গণসুরের রিহার্সেলে কারো প্রক্সি দিতে গিয়েই সুব্রত রায়ের নাট্য যাত্রার শুরু এবং এই শিল্পের প্রেমে পড়া। এরপর থেকে আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যখন তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং করছিলেন এবং তারও পরে যখন বিআরও’তে কাজ করছিলেন, তখনও যে সময়ই তিনি সুযোগ পেতেন কিংবা বিরতি পেতেন নিজের আবেগ প্রকাশ করতে, অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে নিঃসংকোচে নাট্য পরিবেশনায় নিজেকে সপে দিতেন। “প্রথমদিকে আমি শিলচরে এবং পরে মনিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, রাজস্থান এবং আরো অন্যান্য অঞ্চলে চাকরি করেছি। কিন্তু কখনও হাল ছাড়িনি এবং জয়সালমারের মতো জায়গা থেকে ফিরে এসেও থিয়েটারের মহড়ায় আসতে কখনও ভুল হয়নি।”

 

 

থিয়েটারের প্রতি তার উৎসাহ এবং ভালোবাসা এতটাই যে থর মরুভূমির প্রচন্ড উত্তাপ হোক কিংবা লাদাখের ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মারাত্মক ঠান্ডা হোক না কেন তিনি সব সময়ই নিজেকে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত রাখার একটা উপায় খুঁজে নিতেন। “আমার সেরা নাটকগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের শেষ সময়ের ‘শেষ সংলাপ’ অবলম্বনে লিখিত নাটকটি। আর সেই নাটকের মহড়া রাজস্থানের মরুভূমিতে দেওয়া হয়েছিল, যা কিনা শিলচরে আমাকে প্রথম পুরস্কারে ভূষিত করেছিল।”

গর্বিত মেয়ের পিতা, প্রায় চার দশক ব্যাপী নাট্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে সঁপে দেওয়া তার জীবন তাকে অভিনয় এবং নাটক পরিচালনা- উভয় ক্ষেত্রেই দুহাত ভরে দিয়েছে। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘কাল বা পরশু’, ‘সুন্দর’, ‘সিদ্ধিদাতা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেবতা’র গ্রাস’, মনোজ মিত্রের ‘অমি মদন বলছি’, ‘স্মৃতি সুধা’ তাঁর বহু পরিচালিত নাট্যকর্মের মধ্যে অন্যতম। এরমধ্যে ‘আমি মদন বলছি’ নাটকটি বরাক উপত্যকায় এখন পর্যন্ত সর্বাধিক মঞ্চস্থ হওয়া নাটক হিসেবে রেকর্ড করেছে।

ছাত্র-ছাত্রী এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছে ‘শম্ভু কাকু’ হিসেবে যিনি সম্মোধন পান তিনি জানালেন, থিয়েটারের ব্যাপারে তাকে হতাশায় ডুবে যাওয়ার মত ঘটনা কিংবা তেমন কোন সংগ্রাম করতে হয়নি। তিনি বললেন, ” আমি ভাগ্যবান যে আমার পরিবার সব সময় আমার পাশে ছিল যখন আমি থিয়েটারে আসি। আমার প্রিয় বড় ভাই শংকর রায় আমাকে এদিক থেকে অনুপ্রাণিত এবং সমর্থন করার মাধ্যমে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকে ছাড়া আমি কখনোই নাট্য যাত্রার কথা ভাবতে পারিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ২০১৯ সালে তার বড় ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পর তাদের পারিবারিক ব্যবসার অতিরিক্ত দায়িত্ব সহ অন্যান্য সব বিষয়গুলো তার কাছে আগের চেয়ে যেন বেশি জটিল হয়ে উঠেছিল।” তবে এর পরেও তিনি তার প্রথম প্রেমের সঙ্গে গাঁটছড়া ঢিলে হতে দেননি। “এমনকি এই মর্মান্তিক বিয়োগান্তের পরও আমি অরিজিৎ আদিত্যের দুটি নাটক এনআরসি নিয়ে লিখিত বিখ্যাত নাটক ‘লিগেসি কোড” ও অন্যটি ‘নুরি’ মঞ্চস্থ করতে পেরেছি।”

 

 

থিয়েটার কেন কিংবা অন্য কিছু নয় কেন? বেশিরভাগ মানুষই এক্ষেত্রে বড় বড় কথা বলবেন। তারা বলবেন যে এটি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য বা পৃথিবীকে পরিবর্তনের জন্য করছেন। “তবে মূল বাস্তব যেটা সেটা হচ্ছে আমরা আমাদের নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য এটি করে থাকি। এটা মোটেই এমনটা নয় যে এই শিল্পের মাধ্যমে পৃথিবী বা সমাজকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। তবে মনের গভীরে এই শিল্পকে মঞ্চস্থ করার তাগিদ এই সত্য থেকেই উঠে এসেছিল যে ভিড়ের মধ্যে দুজন লোকও যদি বসে থাকে যারা আমাদের কাজ ও প্রচেষ্টার প্রশংসা করবে।”

মিস্টার রায় জোর দিয়ে বলেন যে এটি অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের মত নয়, বরং থিয়েটার সম্ভব হয় তখনই যখন অন্তত দু ধরনের লোক এই শিল্পমাধ্যমে জড়িত থাকেন।”আপনি নিজেই গান গাইতে পারেন এবং একই সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।নাচের ক্ষেত্রেও একই। কিন্তু নাটক কমপক্ষে দুজন অংশগ্রহণকারী দাবি করে, অভিনেতা বা পারফর্মার এবং দর্শক। দর্শক,শ্রোতা ছাড়া থিয়েটারের অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যাবে।”

 

থিয়েটারকে কি এই অঞ্চলের মানুষ ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবতে পারে?

প্রবীণ অভিজ্ঞ নাট্যশিল্পী মুহূর্ত বিলম্ব না করে উত্তর দিলেন, না, তারা নিজেরাই থিয়েটারকে ক্যারিয়ারের বিকল্প হিসেবে দেখছেন না। “বরাক উপত্যকায় থেকে পেশাদারী থিয়েটার করা সহজ ভাষায় বলতে হয়, সম্ভব নয়। এমনকি ভারতের প্রেক্ষাপটে, অন্ততপক্ষে বাংলায় যদি আপনি সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় বা এধরনের সরকারি সংস্থার অধীনে কাজ না করেন তাহলে ক্যারিয়ার হিসেবে বিষয়টি ভাবা মোটেই সহজ নয়। আপনি এক্ষেত্রে মেকআপ আর্টিস্ট, লাইট টেকনিশিয়ান বা এমনকি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একবার চিন্তা করে নিতে পারেন, কিন্তু কোনভাবেই নাট্য অভিনেতা বা পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে নয়।

তরুণ প্রজন্মের কাছে তার একমাত্র পরামর্শ, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের যুগে কয়েক শতাধিক ফেসবুক মন্তব্যে সহজেই বিস্মৃত হবেন না। “এই শিল্প মাধ্যমকে ভালবাসতে হবে এবং এর আবেগকে অনুভব করতে হবে। আজকের প্রজন্মের জন্য ইন্টারনেটে একটি বড় সুবিধা রয়েছে, যেখানে তারা প্রচুর ভিডিও এবং নির্দিষ্ট শব্দগুলোর যথাযথ উচ্চারণের জন্য অনেক ভিডিও হাতের কাছে পেতে পারে। তাই এই প্রাপ্তিটা এখন তুলনামূলকভাবে সহজ, তবে থিয়েটারের সাফল্য এবং স্বীকৃতি পেতে অনেক সময় লাগে। এক্ষেত্রে একজনকে এই শিল্পের পেছনে লেগে থাকতে হবে এবং একের পর এক কাজ করে যেতে হবে।”

প্রবীণ নাট্যশিল্পী বর্তমানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সুভাষিনী’ এবং মনোজ মিত্রের ‘স্মৃতি সুধা’ র কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।

Comments are closed.