শিলচর ছেড়ে করিমগঞ্জে গেলেন 'সোনার ছেলে' শুভম, পরিবার চালাতে করছেন যোগালীর কাজ, যোগাযোগ করেননি শিবব্রত - অতনু
ভালো সুযোগ সুবিধা ও পরিকাঠামোর জন্য বদরপুর ছেড়ে শিলচর পাড়ি দিয়েছিলেন রাজ্যের সেরা জেবলিন থ্রোয়ার শুভম ঘোষ। গত ৪-৫ বছরে রাজ্য তথা জাতীয় স্তরে শিলচরের স্টার পারফর্মার তিনি। তবে এখন আর তিনি শিলচরের অ্যাথলিট নন। সম্প্রতি নীরবেই তিনি চলে গেছেন করিমগঞ্জে। ৭ আগস্ট জ্যাভলিন ডে উপলক্ষে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় করিমগঞ্জের জার্সি গায়ে সোনাও জিতেছেন।
বদরপুরের বাসিন্দা হবার সূত্রে শুভমের করিমগঞ্জ জেলা দলের হয়ে খেলাটাই স্বাভাবিক। এমন অনেকেই আছেন যারা অতীতে অন্য জেলার বাসিন্দা হয়েও শিলচরের হয়ে দীর্ঘ সময় খেলে গেছেন। অথবা এখনো খেলছেন। বিভিন্ন ইভেন্টে এমন উদাহরণ রয়েছে। মূলত এক্সপোজার এবং উন্নত পরিকাঠামোর জন্যই ভিন্ন জেলার ক্রীড়াবিদরা অফিসিয়ালি শিলচর হয়ে খেলতে পছন্দ করেন। তবে শুভম এর ক্ষেত্রে তো উল্টোপূরাণ!
গত পাঁচ বছরের শিলচরের জার্সি গায়ে যেখানেই অংশ নিয়েছেন পদক জিতেছেন শুভম। গত পাঁচ বছরে আন্তজেলা আসরে টানা পাঁচটি সোনা জিতেছেন। সেই শুভম জ্যাভলিন ডেতে সোনা জিতলেন করিমগঞ্জের জার্সি গায়ে। আসলে প্রচন্ড আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন শুভম। এমনিতেই পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তার মধ্যে শুভমের বাবা ও দিদি গুরুতর অসুস্থ। কদিন আগেই অসুস্থ দিদিকে নিয়ে শিলচর মেডিকেল কলেজে দিন রাত কাটিয়েছেন। এর মধ্যে নিজেও কোনো চাকরি পাচ্ছেন না। তাই অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে যোগালির কাজ করতে হচ্ছে তাকে। পরিবার চালাতে এখন এটাই তার একমাত্র ভরসা। অর্থের অভাবে ভালো প্র্যাকটিসও করতে পারছিলেন না। এমন সময় শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার পালাবদল হয়। দায়িত্বে আসে নতুন কমিটি। তবে নতুন কমিটি আসার পর সভাপতি শিবব্রত দত্ত অথবা সচিব অতনু ভট্টাচার্য কেউই শুভমের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি শুভম যখন শিলচর ছেড়ে করিমগঞ্জ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তখনও নয়। মাইনোর গেমস সচিব সত্যজিৎ দাস যোগাযোগ করলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কিছুটা আক্ষেপের সুরেই শুভম বলেন, ‘নতুন কমিটি দায়িত্বে আসার পর আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেনি। শুধু সত্যজিৎ স্যার যোগাযোগ করেছিলেন। তবে সেটাও অনেক দেরিতে।’ শুভম জানান প্রাক্তন সচিব বিজেন্দ্রপ্রসাদ সিং ও ক্রীড়া সংগঠক চন্দন শর্মা তাকে সবসময় আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিজেন্দ্র স্যারের কাছ থেকে সব সময় প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। যখনই আমার টাকার দরকার হয়েছে তিনি সাহায্য করেছেন। চোট গ্রস্ত হবার পর ডিএসএর ফান্ড থেকে মদত করেছেন। আবার ব্যক্তিগতভাবেও আর্থিক সাহায্য করেছেন। চন্দন স্যার ও কোনদিন না বলেননি। যখনই গেছি তার কাছে সাহায্য পেয়েছি। তবে এখন তো তারা দায়িত্বে নেই। এর মধ্যে নতুন সচিব ও সভাপতি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে বিজেন্দ্র স্যার ও চন্দন স্যার কিন্তু আমায় শিলচর না ছাড়তে বলেছিলেন। কিন্তু তাদের কথা রাখতে পারলাম না।’
শুভম বলেন, ‘শিলচর আমায় অনেক দিয়েছে। আন্তজেলা স্তরের ভালো পারফর্ম করে পুরস্কৃতও হয়েছি। তবে এটা আমার স্থায়ী সমাধান নয়। আর এক দুজনের কাছে আমি কতবারই বা যাব। বিশ্বাস করুন খুব কষ্টে আছি। বদরপুর এলে দেখবেন আমার ঘরের কি অবস্থা। করিমগঞ্জ আমায় কথা দিয়েছে ওরা আমাকে প্র্যাকটিসের জন্য প্রতি মাসে টাকা দেবে। তাই সেখানে গেছি। দেখি কি হয়।’ শুভমের মা নেই। বাবার ছোট্ট একটা দোকান ছিল। তবে এখন আর সেটা নেই। এর মধ্যে তার বাবা ও দিদি দুজনেই গুরুতর অসুস্থ। পরিবারের পুরো খরচ বহন করতে হচ্ছে শুভমকে। আর সেই খরচের জোগাড় করতে তাকে কখনো মাটি কাটতে হচ্ছে। আবার কখনও বা করতে হচ্ছে যোগালির ডিউটি। অথচ শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থা ইচ্ছা করলে এতটা কঠিন হত না শুভমের পরিস্থিতি। কিন্তু খেলোয়ারদের স্বার্থে কথা বলবে কে?
ছোট থেকেই অনেক লড়াই করতে হয়েছে শুভমকে। লড়তে হয়েছে আর্থিক দুরাবস্থার সঙ্গে। দোকানে কাজ করে ক্যারিয়ারে প্রথম জেবলিন কিনেছিলেন। সেই সংগ্রাম আজও চলছে। অথচ ছেলেটার রেকর্ড দেখুন-পাটনায় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে সিলভার পদক। আসাম অলিম্পিকে সিলভার। অনূর্ধ ১৭ জেবলিন চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা। টানা ২ বছর ন্যাশনাল জেবলিন ডে তে সোনা। টানা পাঁচবার অনূর্ধ্ব ১৬, ১৭ ও ১৮ বিভাগে সোনা। এ বছরও শিলচরের জার্সি গায়ে স্টেট গেমসে সোনা। এত কিছুর পরও এই সোনার ছেলেটাকেই আর্থিক সংকটে ভুগতে হচ্ছে। পরিবারের চালাতে করতে হচ্ছে যোগালির কাজ। এটাই ক্রীড়াঙ্গনের ট্রাজেডি।
Comments are closed.