ওরা এখনও নিখোঁজ- হলিউডের সিনেমা, শিলচরের তিন সন্তান আর কিছু উপলব্ধি
১৯২৮ এর ১০ মার্চ। আমেরিকার লস এঞ্জেলেস এর টেলিফোন কোম্পানিতে কর্মরতা ক্রিস্টিন কলিন্স এর জীবনটা ওলটপালট হয়ে যায় সেদিন। তাঁর ন’ বছর বয়সী পুত্র ওয়াল্টার নিখোঁজ হয়ে যায়। সিঙ্গেল মাদার ক্রিস্টিন। লস এঞ্জেলেসের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর সঙ্গে একা এক মায়ের অসম লড়াই চলতে থাকে বছরের পর বছর। লড়াইটা তীব্রতর হয় ‘ছেলেকে’ ফিরে পাবার পরই! পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাদের কর্ম দক্ষতা প্রমাণ করতে কয়েক মাসের মধ্যে ক্রিস্টিনের সামনে একটি ছেলেকে এনে হাজির করে। ক্রিস্টিন যখন সেই ছেলেকে নিজের ছেলে বলে মানতে নারাজ, তখন পুলিশের ক্যাপ্টেন তাঁকে বলে, “এই তোমার হারানো ছেলে। কয়েকমাসে চেহারায় বদল এসেছে, তাই চিনতে কষ্ট হচ্ছে।” আশ্চর্যের কথা, ছেলেটিও জোর দিয়ে বলে সে ওয়াল্টার। ক্রিস্টিন এ কথা কিছুতেই মেনে নেয় না। একে একে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে থাকে, নতুন ছেলেটি যে তার ছেলে নয়, আদালতে তা প্রমাণ করবার জন্য। পুলিশও নিজেদের ভুল স্বীকার করা সর্বাবস্থায় এড়িয়ে যেতে চায়। ক্রিস্টিনের ওপর চাপ দেয়া হয়, এই ছেলে যেমনই হোক, ক্রিস্টিনকে তাকে মেনে নিতে হবে। পুলিশের ভাবটা এমন যেন, ছেলে নয়, কোনো টুথপেস্টের টিউবে বদল হয়েছে! ক্রিস্টিনের সন্তান হারানোর রহস্য ঘনীভূত হয় আর লস এঞ্জেলেসের পুলিশ ডিপার্টমেন্টতাদের অপদার্থতার, ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির গড়ে চলে। তারই মধ্যে একদিন জানা যায় নতুন ছেলেটি সত্যিই ক্রিস্টিনের ছেলে ওয়াল্টার নয়, সে আর্থার হাচিন্স, সিনেমা জগত হলিউড দেখার স্বপ্নে সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, সুযোগ পেয়ে ওয়াল্টারের ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছে এতদিন। ক্রিস্টিনের চেষ্টায় পুলিশের ব্যর্থতা জনসমক্ষে প্রকাশ হয়, কিন্তু ওয়াল্টারের কোনো খোঁজ মেলে না। একসময় সন্তান হারা মা’কে মুখোমুখি হতে হয় তাঁর হারানো ছেলের সঙ্গে হওয়া ভয়াবহ ঘটনার।
ঘটনার ঘনঘটায় মোড়া ক্রিস্টিন কলিন্সের অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘চেঞ্জলিং’। সিনেমার কাহিনী যেন কাফকার কলম নিঃসৃত কোনো উপন্যাস। কিন্তু সিনেমার শুরুতেই লেখা রয়েছে, কল্পকাহিনী নয়, এটি সত্যি ঘটনা। সিনেমাটি দেখতে শুরু করেছিলাম স্টোরি লাইন না জেনেই। টাইটেলকার্ডে ছবির নির্দেশক ও অভিনেত্রী যথাক্রমে ক্লিনট ইস্টউড ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলির নাম দেখেই ছবিটি দেখতে বসে গেছিলাম। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, লস এঞ্জেলেসের ছোট্ট ছেলে ওয়াল্টারের হারিয়ে যাওয়ার কথা নিয়ে কেন সিনেমা করতে গেলেন এক বিশ্ব বন্দিত চিত্রপরিচালক? ঐ ঘটনাটি যদি কেবল একটি শিশু অপহরণের ঘটনা হতো তাহলে তা হয়তো দু একটি স্থানীয় সংবাদপত্র আর পুলিশের খাতাতেই বন্দী থেকে যেত চিরকাল। কিন্তু তা হলো না, কারণ এ স্রেফ ছেলে হারানোর ঘটনা নয়। এতে আছে রুদ্ধশ্বাস সাসপেন্স, শক্তিশালী এবং দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসনের বিরুদ্ধে এক মায়ের রোমাঞ্চকর লড়াই, নৃশংস অপরাধ। তাছাড়া ক্রিস্টিন আধুনিক যুগের শিক্ষিত, স্বনির্ভর এক মা। তাঁকে দর্শক সহজেই নিজেদের মধ্যে খুঁজে পান। ক্রিস্টিন কলিন্সের ঘটনা কাজেই সিনেমার পর্দায় উঠে আসে। আর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হিট ছবির কথা আমাদের মুখে মুখে ফেরে।
‘চেঞ্জলিং’ সিনেমাটি দেখতে গিয়ে কেন কে জানে আমার মনে ঘুরেফিরে আসতে লাগলো তিনটি মুখ। লস এঞ্জেলেসের ওয়াল্টার এর বদলে কখন যেন মনের পর্দায় ভেসে উঠলো শিলচরের সৌরভ দাস, সুপ্রিয়া দাস ও নেহা বাগতি।
২০১৭ সালের ৫ জুন থেকে নিখোঁজ নেহা। সেইদিনই নিখোঁজ হয়েছিল তৃষা। তাকে পাওয়া গেলেও, নেহাকে পাওয়া যায়নি। নেহা যদি তৃষার অপহরণকাণ্ডে জড়িত হয়েও থাকে, তাহলেও কি তাকে খুঁজে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো জরুরি নয়? ২০১৯ এর ৯ জুন থেকে নিখোঁজ দুই শিশু- সৌরভ, সুপ্রিয়া। পুলিশ ওদের খুঁজে পায়নি। প্রশাসন, সরকার এ বিষয়ে চুপ। কেন? সে জবাব তাঁরা দিন। আমরা নিজেদের সামনে আয়না ধরি। বরাক উপত্যকার তিন জন সন্তান নিখোঁজ, অথচ নাগরিক সমাজ, মানে আমরা আশ্চর্য রকম নীরব। কারণটি খোঁজা যাক।
সময় ত্রস্ত পায়ে পেরিয়ে যায়। দিন যায়, ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে যায়, বছর ঘুরে যায় দ্রুত। আমরা উদযাপন করি নারী দিবস, মাতৃ দিবস, পিতৃ দিবস, শিশু দিবস। সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখি নারীর লড়াইয়ের কথা, লিখি মা হওয়া মুখের কথা নয়, লিখি ভালো বাবাদের কথা– যারা নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে সন্তান মানুষ করেন, শিশু দিবসে পোস্ট করি নিজেদের শৈশবের ছবি, নিজের শিশুর ছবি। অথচ আমাদের একবারও মনে পড়ে না সুনধন, সোমবালাও বাবা, মা। তাদের দুটি সন্তানই হারিয়ে গেছে। সৌরভ দাস, সুপ্রিয়া দাসের জন্যে আমাদের দু মুহূর্ত সময় থাকে না। নেহা বাগতির জন্যেও না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা তৃষা রায় চৌধুরীর জন্যে কিন্তু আমরা জান লড়িয়ে দিয়েছিলাম ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, টুইটারে। জনগণ, সরকার, পুলিশ, প্রশাসন সর্বশক্তি দিয়ে আমরা সবাই সে সময় তৃষার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের সম্মিলিত চেষ্টা ব্যর্থ হয় নি। এটা অত্যন্ত সুখের যে তৃষা তার মায়ের কোলে ফিরে এসেছিল ৮০ ঘণ্টার মধ্যে।
সৌরভ, সুপ্রিয়া, নেহাদের মায়ের কোল আজও রিক্ত।
বরাক উপত্যকার ছোট্ট মেয়ে তৃষার অপহরণ কেন ‘বিখ্যাত’? আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন থেকে শিশুর হারিয়ে যাওয়া আমাদের সোচ্চার করে কারণ এই ঘটনা আমাদের অবাক করে দেয়, ভয় ধরায়; নিজেদের সন্তানের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন জাগে আমাদের মনে। হারানো তৃষার ছবি তাই নিজ দায়িত্বে আমরা ভাইরাল করি। তৃষা ফিরে এলে তাই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
সৌরভ, সুপ্রিয়া, নেহাদের অপহরণের ঘটনায় হয়তো রোমাঞ্চের গন্ধ নেই। তাদের বাবা-মায়েরা শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, প্রভাবশালী নন। ঐ তিনজনের হারিয়ে যাওয়া আমাদের কাছে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু নয়। তপোবন নগরীর সবজি বিক্রেতা এক পিতা আর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা এক মায়ের দুই সন্তান হারালেই কী আর বছর ঘুরে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের খোঁজ না পাওয়া গেলেই বা কী, নেহা বাগতির বাবা হারানো মেয়ের শোক বুকে নিয়ে মরে গেলেও আমাদের কীই বা যায় আসে?– এসব চিন্তা আমাদের মনের জানালা দিয়ে গলতে পারে না, এসব চিন্তা আমাদের ভার্চুয়াল দেয়ালে ঠাই পায় না।
হ্যাঁ, অতিমারির সময়ে এখন আমরা সকলেই বিপর্যস্ত। নিজেদের সুরক্ষিত রেখে দিন গুজরান করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্য কিছু নিয়ে এখন ভাবার সময় কোথায়? এ কথা যেমন ঠিক, তেমনই এ কথাও সত্যি যে আমরা অনেকেই এই সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকার অবকাশ পেয়েছি। আমরা ওয়েবিনারে যোগদান করছি, ফেসবুকে লাইভ অনুষ্ঠান করছি, নাচ, গান ইত্যাদির মাধ্যমে আপ্রাণ ভালো থাকার, অন্যকে ভালো রাখার চেষ্টা করে চলেছি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ভুলে কেবল নিজেদের নিয়েই যে মত্ত আমরা তাও নয়। হিন্দি ছবির তারকার অকালমৃত্যুর রহস্য ভেদ করা নিয়ে আমরা সোচ্চার হতে পারি। মানসিক অবসাদের ব্যাপারে আমরা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে পারি। হাতির মৃত্যু থেকে কোভিড-১৯ এর নিরাময় নিয়ে কারচুপি–কোনো বিষয়েই চুপ করে নেই আমরা। তাহলে সৌরভ, সুপ্রিয়া, নেহার কথাও মনে করি এইবার? বাড়ি না ফেরা শিলচরের তিন সন্তানকে স্মরণ করা, তাদের অপহরণের তদন্তের দ্রুত, সুষ্ঠু মীমাংসার দাবিতে সোচ্চার হওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
শিশু অপহরণ নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘চেঞ্জলিং’ এ দেখেছি, সন্তান হারা মায়ের পাশে দাঁড়ানো একজন মানুষের ভূমিকাও কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। লস এঞ্জেলেসের এক নিখোঁজ শিশুর মায়ের লড়াইয়ের কাহিনী দেখতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, দর্গাকোণা, তপোবন নগরীর সন্তানহারা বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য।
Comments are closed.