বরাক উপত্যকার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে ব্যর্থ ইতিহাসবিদরা, অভাব পূরণে আমার কলম হাতে নেওয়া: ইমাদ উদ্দিন
বরাক উপত্যকার ইতিহাস সম্পর্কে এবং এর ঐতিহ্য নিয়ে লেখালেখি কিংবা গ্রন্থ প্রকাশের সংখ্যা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়, অভিযোগ করেন অনেকেই। অভিযোগে এও সংযোজিত হয়, লিখিত ইতিহাস সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয় কিংবা সঠিক ইতিহাস সর্বক্ষেত্রে লেখকের কলম বন্দী হয়নি। কখনো বা কলম বন্দী হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠে নি। বরাক উপত্যকার ইতিহাস বিষয়ে এই ধরনের অভাব পূরণ তথা এই উপত্যকার অনেক অজানা ইতিহাসকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কলম হাতে নিয়েছেন বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট লেখক তথা বিশিষ্ট আইনজীবী ইমাদ উদ্দিন বুলবুল।তারই ফসল ‘বরাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে’ বইটি।লেখক এর আগে কবিতার বই সহ অনেকগুলো বই লিখেছেন। তার উপন্যাস “সুরমা নদীর চোখে জল” বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও স্পেশাল পেপারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য দেশে এবং বিদেশে তাকে সম্মানিত করা হয়েছে। বরাক উপত্যকাকে ঘিরে অন্যান্য ঐতিহাসিক বই থেকে তার বই ‘বরাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে’ কিভাবে আলাদা, আগের ইতিহাসবিদদের প্রতি লেখকের অভিযোগ কিংবা অভিযোগের কারণ উঠে এসেছে এই কথোপকথনে। জানতে চেয়েছি আরো অনেক কিছু………. কথার সূত্র ধরে জানা গেল এই উপত্যকার আরও অনেক অজানা তথ্য। যারা এখনও বইটি পড়ে উঠতে পারেননি এই কথোপকথনের হাত ধরে হয়তোবা তাদের মনে বইটির প্রতি আগ্রহ বাড়বে। ‘বরাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে’ বইটিকে উপলক্ষ্য করে দূরাভাষে লেখকের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বরাক বুলেটিনের পক্ষ থেকে অর্চনা ভট্টাচার্য।
“বরাকের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে”র লেখকের কাছে বইটি নিয়ে নানা কথা অবশ্যই জানতে চাইবো।তবে সবচেয়ে প্রথমে জানতে চাইছি বইটি লেখার কিংবা প্রকাশের পেছনের গল্প। কিভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন বরাকের ইতিহাস লিখতে?
প্রথমত দেশভাগের পর বরাক উপত্যকা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পর্যবসিত হয়েছে। এর ফলে এখানের উন্নয়ন রীতিমত স্তব্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া এখানের যে ইতিহাস, সেই ইতিহাস চর্চাও তলানিতে এসে ঠেকে। যেমন কাছাড় জেলার ইতিহাস নিয়ে ১৯১০ সালে উপেন্দ্র কুমার গুহ ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’ প্রকাশ করেছিলেন। একইভাবে বর্তমান করিমগঞ্জ জেলার মৈনা গ্রামের অচ্যুতচরণ চৌধুরী বর্তমান করিমগঞ্জ জেলা সহ শ্রীহট্টের ইতিহাস নিয়ে ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১০ সালে প্রথম খন্ড অর্থাৎ পূর্বাংশ এবং ১৯১৭ সালে অপরাংশ প্রকাশ করেছিলেন। তারপর দেশভাগের ফলে এই গ্রন্থের আর কোনও পুনর্মুদ্রণ বিংশ শতাব্দীতে হয়নি।২০০২ সালে বাংলাদেশের ঢাকার উৎস প্রকাশন এই দুই খন্ড আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশ করে। এর কয়েক বছর পর কলকাতার একটি অখ্যাত প্রকাশনী এই দুই খন্ড ভারতের জন্য প্রকাশ করে। ঠিক একইভাবে কাছাড়ের ইতিহাস নিয়ে একমাত্র বই ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’ বিংশ শতাব্দীতে আর পুনর্মুদ্রণ হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এর সংস্করণ বের হয়। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ইতিহাস চর্চা বরাক উপত্যকায় থমকে দাঁড়ায়। কাছাড় জেলার ইতিহাস চর্চায় বিশেষ করে একটা রাজন্য বর্গের বিস্তারিত বিবরণ কাছাড়ের ইতিবৃত্তে তুলে ধরা হয়েছে।এই বরাক উপত্যকায় কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষ বসবাস করছেন। বিশেষত খাসিয়া এবং কুকি জনগোষ্ঠীর পরেই বাঙালিরা হচ্ছেন এই উপত্যকার আদি অধিবাসী। কিন্তু ইতিহাসে এসব কথা এখনও স্পষ্ট ভাবে বলা হয় নি। অনেক কথা এখনো না বলা রয়ে গেছে। এই অভাব গুলো পূরণ করার জন্য আমি এই বই লেখার প্রয়াস হাতে নিয়েছি।
বরাক উপত্যকার ইতিহাস নিয়ে যারা লিখেছেন যেমন ধরুন উপেন্দ্র কুমার গুহ, তাদের বই থেকে আপনার বইটি কিভাবে আলাদা?
উপেন্দ্র কুমার গুহ যখন লিখেছিলেন তখন তাদের সময় মানুষের জানার সুযোগটা কম ছিল। উপেন্দ্র কুমার গুহ কিংবা অচ্যুত্ব চরণ তত্ত্বনিধি আমাদের কাছে নমস্য ব্যক্তি। তারা আমাদের অনেক ঋণী করে গেছেন, কারণ তারা ইতিহাসকে প্রথম একটা পরিকাঠামো দিয়েছেন।
উপেন্দ্র কুমার গুহ সাইকেলে করে অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে এসব ইতিহাস সংগ্রহ করেছেন। তিনি ঘটনাগুলো সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় উপস্থাপনা করেছেন। এখানে কিছু ব্যাপার আমাদের কাছে বিস্ময়কর। তিনি ঢাকা বিক্রমপুরের লোক, চাকরির সুবাদে এখানে এসেছিলেন স্কুল পরিদর্শক হিসেবে। বিস্ময় এই যে, তিনি এখানের লোক না হয়েও কিভাবে সঠিক ঘটনা সঠিক উপায়ে সঠিক জায়গায় লিখতে পারলেন!তবে আমরা তাকে দোষারোপ করি অন্য বিষয়ে। তিনি একটা রাজন্যবর্গকে এমন ভাবে দেখিয়েছেন, যাতে মনে হয় কাছাড় জেলায় এর আগে এছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না। এটা ঐতিহাসিক ভাবে একটি ভুল বার্তা। কারণ এখানে চিলা রায়ের রাজত্ব কিংবা ত্রিপুরার রাজত্ব সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারও আগে যখন সিলেটে সমতক রাজত্ব চলছিল, যে রাজত্বগুলো কাছাড় জেলাকে আলিঙ্গন করে চলছিল সেগুলোর কথা কিন্তু আগে ঐতিহাসিকদের লেখায় আসেনি। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করে। সুজিত চৌধুরি বা অন্যান্যরা এ কথাগুলো আনতে শুরু করেন। এবং এখন আমরা ক’জন জোর দিয়ে বলছি যে এটা সঠিক ইতিহাস নয়।
এখানে আপনাকে থামাতে বাধ্য হচ্ছি এবং তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আমি এখানে জানতে চাইবো এই যে আপনি ‘আমরা কজন’ উল্লেখ করলেন, সেই কজন কারা কারা?
আমরা ক’জন হলাম, ডঃ অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেব লস্কর, তুষার কান্তি নাথ, আবিদ রাজা মজুমদার ও আমি।
এবার আবার ফিরে যাচ্ছি পুরনো প্রসঙ্গে। জানতে চাইবো, কিভাবে এটি সঠিক ইতিহাস নয়?
হ্যাঁ, আগের কথার সূত্র ধরে আমি বলতে চাই, আগেকার দিনের ইতিহাসবিদদের প্রতি এবং তাদের কাজ নিয়ে আমাদের একটা প্রচণ্ড অভিমান কিংবা দুঃখ রয়েছে। দুঃখটা হচ্ছে, দেবব্রত দত্ত কিংবা জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য, তারা বরাক উপত্যকার যে সিপাহী যুদ্ধ, তাকে কোনোভাবে গুরুত্ব দেননি। তারপর আমাদের যে ভাষা আন্দোলন, সেটাকেও কোনো গুরুত্ব দেননি। বরাক উপত্যকার জন্য এই দুটি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই তাদের প্রতি আমাদের এটা ন্যায্য অভিযোগ।
আগের ইতিহাসবিদরা এগুলো বলেননি। এই যে সিপাহী বিদ্রোহ, যাকে নিয়ে বরাক উপত্যকাবাসী কিভাবে উদ্বেলিত হয়েছিল, গান রচনা করেছিল, প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল, এগুলো তারা উল্লেখ করেন নি। অথচ তারাই তো আমাদের পূর্বপুরুষ, তারাই তো স্বাধীনতার জন্য সত্যি কারের স্পৃহা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আমার বইয়ের প্রথমেই রয়েছে”গুলু নওয়াবের করুণ মৃত্যু ও শহিদদের মর্যাদা”।কাছাড়ের শেষ রাজা, তার প্রতিদ্বন্দ্বী একজনকে হরিটিকরে ২৯ দিন না খাইয়ে জেলে মেরেছেন। এই মানুষটার কবর দুশো বছর ধরে সেখানের মানুষ রক্ষা করে চলেছে। যে রক্ষা করে চলেছে সে হচ্ছে শিলচরের বেরেঙ্গার দুলামিয়া ও পরবর্তীতে তার বংশের অন্যান্যরা। এই কবরকে রক্ষা করার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়, মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কতটা রুখে দাঁড়াতে চায়! স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য কিভাবে রুখে দাঁড়ায়! এটা হচ্ছে আমাদের বরাক উপত্যকার সঠিক ইতিহাস।
এই যে ভাষা আন্দোলনের সময় সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেই স্পিরিটটা কিন্তু দুশো বছর আগেও ছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও ছিল। কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিকরা এগুলোকে গুরুত্ব দেননি।
আপনার এই বইটি প্রকাশের পরও কি মনে হয়, কাছাড়ের ইতিহাস নিয়ে আরও বই লেখার কিংবা অনুসন্ধান করার সুযোগ রয়ে গেছে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই রয়েছে। আমার বর্তমান বইটি ২১৪ পৃষ্ঠার। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে একই সাইজের আরো দুটো খন্ড পর পর প্রকাশিত হবে। আমার ধারণা বাকি দুই খন্ড প্রকাশ করার পর ইতিহাস কিছুটা পূর্ণাঙ্গতার দিকে ধাবিত হবে। প্রত্যেকটা বিষয় আমাদের ভালোভাবে গবেষণা করে বিশ্লেষণ করে লেখার সময় হয়েছে। আগের দিনে যেমন গতানুগতিক ভাবে ইতিহাসকে লেখা হতো, বর্তমান যুগের যারা লেখক তারা সেই ধারায় বিশ্বাস করেন না।
তারা যেকোন ঐতিহাসিক ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করতে চান। সেই হিসেবে বলতে পারেন, আমার এই তিন খন্ড প্রকাশের পরও প্রচুর সুযোগ থেকে যাবে আরো অনুসন্ধান করার। বিশেষ করে এই উপত্যকার মানুষের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এখনো হয়নি। যা সত্যি কারের ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য খুবই প্রয়োজন।
এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করতে চাই, এই যেমন ধরুন বদরপুরের সিদ্ধেশ্বর শিববাড়ির কপিলমুনির আশ্রম, এটি হচ্ছে এখানের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। কিংবা ধরুন, ভুবন পাহাড়ে যে শিব মন্দির রয়েছে এসব নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে চর্চা করার প্রয়োজন রয়েছে। এর ফলে উপত্যকার জনবসতি সঠিকভাবে প্রমাণিত হবে।
এর আগেও উপত্যকার ইতিহাস নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে যা আপনি নিজেই উল্লেখ করেছেন।আমার প্রশ্ন হচ্ছে,এই ধরনের ঐতিহাসিক বইকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ কতটা উৎসাহী? তাদের কাছে কি পৌঁছাচ্ছে বইগুলো?
বর্তমান যুগের মানুষ মানসিক দিক দিয়ে অনেক উন্নতি করেছেন। কিন্তু বরাক উপত্যকার মানুষের সেই মানসিক উন্নতিটা হচ্ছে না। তার অনেক কারণ আছে, এর মধ্যে একটা কারণ হল যে সত্যিকারের ইতিহাস চর্চার অভাব।
ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে কিছু কিছু বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেই বইগুলোর অনেক বেশি দাম ধরা হয়। আসলে যারা বইগুলো প্রকাশ করেন তারা ভাবেন এগুলো শুধু গবেষণার কাজেই লাগবে। সাধারণ মানুষের জন্য এগুলো নয়। ফলে সাধারণ মানুষ এই বইগুলো পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এজন্য সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে আমার এই বইয়ের দাম নির্ধারিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, লেখার ফন্ট সাইজ চৌদ্দ রেখেছি আমরা। যাতে করে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে বয়স্ক এবং কম শিক্ষিত মানুষ এই বই পড়ার সুযোগ পান।
এই মুহূর্তে খুব সহজেই আরও একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে, বরাকের ইতিহাস জানতে এই প্রজন্ম কতটা ইচ্ছুক কিংবা উৎসাহী?
আমি মনে করি,যদি সঠিকভাবে এদের কাছে সবকিছু তুলে ধরা হয় তাহলে তারা জানার জন্য একশো ভাগ প্রস্তুত। কিন্তু তাদের সামনে সবকিছু অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাবে তুলে ধরতে হবে। অস্পষ্টতা ওদের পছন্দ নয়। আর যাদের বর্তমানে ইউটিউব থেকে শুরু করে ইন্টারনেটে সবকিছু তৈরি পেয়ে অভ্যাস, তাদের কাছে সবকিছু সঠিকভাবে তুলে না ধরলে কাজ হবে না।তাই বরাকের ইতিহাসও তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিংবা উৎসাহজনক যদি সেটা সুন্দরভাবে পরিবেশন করা হয়।
সেই সঙ্গে আরও একটি কথা এখানে উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি, এখন বরাক উপত্যকায় ইতিহাসের বই- ভালো হোক, মন্দ হোক, পূর্ণ হোক, অর্ধ হোক মানুষ খুব বেশি পড়ছে। কারণ এনআরসির মাধ্যমে বা অন্যান্য রাষ্ট্রকাঠামোর কার্যাবলীর জন্য মানুষ ইতিহাসকে খুব ভালোভাবে জানতে চায়।
আর বরাকের ইতিহাস তাদের কাছে খুবই প্রয়োজনীয়।আবার বলছি, যদি সঠিকভাবে তাদের কাছে তুলে ধরা না হয় তাহলে তারা পড়তে মোটেই উৎসাহী হবে না।
বইটা তো আপনি বাংলায় লিখেছেন। কাজেই এর ইংরেজি অনুবাদ না থাকায় আপনার কি মনে হয় এই প্রজন্মের জন্য ব্যাপারটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ হওয়া খুব প্রয়োজন। কারণ হিসেবে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি, এই বইয়ের ১০ নম্বর পাতায় চরগোলা এক্সোডাসের শতবার্ষিকীর কথা লেখা আছে। চরগোলার বাগানগুলো থেকে ৩০০০০ শ্রমিক তাদের পরিবার সহ ইংরেজ মালিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে স্বদেশ অভিমুখে রওয়ানা দেয়। এটাকে তারা নাম দিয়েছিলেন ‘মুলুক চলো অভিযান’।
৩০ হাজার মানুষ করিমগঞ্জের স্টেশনে এসে জড়ো হন। করিমগঞ্জের মানুষ তাদের খাবার দাবার দেয়। তারপর ট্রেনে তারা কলকাতা যাওয়ার জন্য চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছান। সেখানে ৩-৪ দিন থাকার পর ব্রিটিশ মিলিটারি এবং পুলিশ তাদের ওপর রাতের অন্ধকারে গুলি চালায়। তখন অনেক শ্রমিক মারা যান। পরদিন তারা গোয়ালন্দে যাবার জন্য জাহাজে উঠেন। সেখানেও ইংরেজ মিলিটারি এবং পুলিশ তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। জাহাজের মধ্যেই তাদের হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ড সারাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ছুটে এসেছিলেন। চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীরা এদের সাহায্য করার জন্য ছুটে এসেছিলেন।এই ঘটনা আর জালিওনাবাগ’র ঘটনার মধ্যে চরিত্রগত কোন তফাৎ নেই। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, যেহেতু আমরা এই ইতিহাসের ঠিকমতো চর্চা করিনি তাই চরগুলো এক্সোডাসের কথা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রচারিত হয় নি। তাই আমি বলব, প্রচুর সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছার জন্য এবং আমাদের আত্মপরিচয় সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য ইংরেজি অনুবাদ খুবই জরুরি। তার কোনো বিকল্প নেই।
বইটা প্রকাশের পর মানুষের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া কি রকম আসছে?
আপনিও হয়তো কথাটা মানবেন, একজন লেখকের প্রথম পাঠক হচ্ছেন কম্পোজিটর। দ্বিতীয় পাঠক হচ্ছেন প্রুফ রিডার। দিগন্ত প্রকাশনী’র প্রুফরিডার বিপ্লব বিশ্বাস বলেছেন, ‘আপনি যতটা বই ছাপিয়েছেন, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কম, কাজেই আপনাকে আরো ছাপাতে হবে। আর ইতিহাস বিষয়টা এমন এক ধরনের, যা নিয়ে সব ধরনের মানুষের পড়ার উৎসাহ থাকে, জানার আগ্রহ থাকে। শিলচরে ডিস্ট্রিবিউটার অর্থাৎ বাতায়ন প্রকাশনীর গোবিন্দ কংস বণিকের কাছে একজন ডিস্ট্রিবিউটর এবং বুকসেলার হিসেবে জানতে চেয়েছিলাম বইটির বিষয়ে। সে তখন উত্তর করে, এই সময়ে এ ধরনের বইয়ের খুব প্রয়োজন ছিল। আর আপনাকে এর আরো খন্ড ছাপতে হবে।
হ্যাঁ, এটা আমারও জিজ্ঞাস্য ছিল, এই বইয়ের পরবর্তী খণ্ড প্রকাশের বিষয়ে কী ভাবছেন, কবে পর্যন্ত পাঠকরা পরবর্তী খণ্ড পাবেন?
এ নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করার ইচ্ছে রয়েছে।
আপনার লেখা বইটি কি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত?
হওয়া উচিত কিনা তা পরের কথা। তবে আমি মনে করি না আসাম বিশ্ববিদ্যালয় বইটি পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করবে বলে। কারণ আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়গুলো নিয়ে কখনো ভাবে নি। বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় বিষয় কিংবা ইতিহাস নিয়ে কোনো কাজ করেনি কিংবা করতে চায়ও না। আপনি নিশ্চয়ই জানবেন, আমার উপন্যাস “সুরমা নদীর চোখে জল” ইতিমধ্যেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত এবং সেইসঙ্গে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়েরও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
অর্থাৎ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগ এসবের গুরুত্ব দিচ্ছে, মূল্য দিচ্ছে। এমনকি আমার উপন্যাসের উপর এমফিলও হয়েছে।তাই বলছি সাহিত্য বিভাগ এসব ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও আমার এই বইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এসব ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায় না। ইতিহাস বিভাগটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অথচ ত্রিপুরার একজন মহিলা যে আমার বইয়ের ওপর এমফিল করেছেন, সেই ব্যবস্থা কিন্তু আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হয়েছে।
কথা প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি। জয়ন্ত ভট্টাচার্য গত দু-তিন বছর আগে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় বললেন, ১৯৫৮ সালে চালিহা যখন বদরপুরে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তখন তাকে বিরোধিতা করার জন্য গুরুচরণ কলেজের ছাত্ররা রথীন সেন’র পক্ষে বদরপুরে যায় এবং সেখানে কাজ করে। তারপর তিনি বলছেন যে ইতিহাসে কিন্তু এসব কথা এলো না। চল্লিশ বছর ধরে ইতিহাস লেখার মালিক হচ্ছেন তিনি, আর তিনিই বলছেন এসব কথা ইতিহাসে এলো না। তাহলে বুঝুন!
আরো একটা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে। আমার বইয়ে রয়েছে “শিলচরে মহাত্মা গান্ধী ও অন্নপূর্ণা মন্দির”। অন্নপূর্ণা মন্দিরের উইল করেছিলেন বিষুণ লালা, সেখানে লেখা আছে, ‘আমি অন্নপূর্ণার মূর্তি রাজস্থান থেকে তৈরি করে আনিয়েছি। সেইসঙ্গে মন্দিরে আমি মহাত্মা গান্ধীর মর্মর মূর্তিও স্থাপন করিয়াছি ‘। মন্দিরে সেই মূর্তির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমি আমার বইয়ে এই ঘটনাটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছি। এটা কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। একজন মানুষ মহাত্মা গান্ধীকে দেবতা জ্ঞান করে মূর্তি তৈরি করে এনেছেন এবং মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা সারা ভারতের মানুষের জানা উচিত বলে আমি মনে করি।ভারতের আর কোন জায়গায় মন্দিরে এভাবে মূর্তি তৈরি করে স্থাপন করা হয়েছে বলে জানা নেই, তবে শিলচরে রাখা হয়েছিল। এই মূর্তিটি সে-ই, যা অনেক আগে থেকেই গান্ধী মেলা চলার সময় মেলার সামনের আঙ্গিনায় মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি রাখার রেওয়াজ বহন করেছে।
কাজেই এসব ঘটনা যদি কেউ মূল্য দেয় তাহলে অনেক বড় ইতিহাস, আর যদি মূল্য না দেয় তাহলে কিছুই না। আমার কাছে এগুলোই ইতিহাসের মূল স্পিরিট। এখানে মানুষের যে স্পিরিট সেটাকে এখানের ইতিহাসে এখনো তুলে ধরা হয়নি। আর সেই তুলে না ধরার ফলে এখানের মানুষের নিজের সম্পর্কে বোধটুকু ভালোভাবে জাগ্রত হয়নি।
সবশেষে আপনার বইয়ের সাফল্য কামনা করছি।
ধন্যবাদ।
Comments are closed.