রঙের উৎসব দোল রাঙ্গিয়ে দেয় বসন্তের আকাশ
দোল উৎসব। রঙের উৎসব। এক মুঠো খুশির উৎসব। এক বুক ভালোলাগার উৎসব। বসন্তোৎসব। বসন্ত পূর্ণিমা। ফাল্গুনী পূর্ণিমা। হোলি। আমরা সবাই জানি ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। রাধা-কৃষ্ণ রয়েছেন এই দোল উৎসবের প্রাণকেন্দ্রে।আবার বাঙালি বা হিন্দুদের অন্যতম মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথিও হচ্ছে এই দোল তিথি। বাংলায় যা দোলযাত্রা, তা-ই পশ্চিম ও মধ্য ভারতে ‘হোলি’।
হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব হচ্ছে দোল। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরেই এই উৎসবের জন্ম। ইতিহাস আরও বলছে, খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই উদযাপিত হয়ে আসছে এই উৎসব। খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্যে এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায়। হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরানেও রয়েছে এই উৎসবের কথা। সপ্তম শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময় সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকায় হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। একই সঙ্গে সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ এই দুটি নাটকেও এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা কিনা রচিত হয়েছিল তৃতীয় চতুর্থ শতকে, কামসূত্রেও এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা কামসূত্রে জানতে পারি। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়াও আল-বেরুনীর বিবরণে জানা যায় যে মধ্য যুগে কোনও কোনও স্থানে মুসলমানরাও হোলিকা উৎসবে সংযুক্ত হতেন।
ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোল পূর্ণিমা বলা হয়। আবার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম এই পূর্ণিমা তিথিতেই হয়েছিল বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে বৃন্দাবনে রং খেলায় মেতেছিলেন। এই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয় বলে মনে করা হয়। এছাড়া এও বলা হয়, পুরীতে মূলত দোল উৎসব ফাগুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ ছিল সে থেকেই এই সমারোহ বাংলায় আসে।
দোলযাত্রা বা হোলি নিয়ে অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান, লোককথা রয়েছে। বলা হয় এ মূলত দুই প্রকার, প্রথম হচ্ছে যাত্রার পূর্ব দিন পালিত বহ্নুৎসব ‘হোলিকা দহন’ বা ‘মেড়াপোড়া’ সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলাকে কেন্দ্র করে কাহিনী।
রঙের এই উৎসবের আগের দিন হোলিকাদহন হয় সর্বত্র মহাধুমধাম করে। শুকনো গাছের ডাল, পাতা ইত্যাদি দাহ্যবস্তু আগে থেকে সংগ্রহ করে উঁচু করে খাম্বা বানিয়ে আগুন লাগিয়ে ‘হোলিকাদহন’ হয়। বাংলাতেও হোলিকাদহনের মতই উদযাপিত হয় ‘চাঁচর’। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই চাঁচরেরও বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা রয়েছে। ঋতুচক্রের শেষ উৎসব হচ্ছে আমাদের এই দোল। এই সময়টাকে বলা যায় পাতা ঝরার সময়। বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এরও রয়েছে এক সামাজিক তাৎপর্য। পুরনো সব জঞ্জাল শুষ্কতা রুক্ষতা সরিয়ে এক নতুনকে আহবান করে পালিত হয় হোলি বা দোল। দোলের আগের দিন বাংলায় চাঁচর উদযাপনকে অনেক জায়গায় এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
হোলি হচ্ছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির উত্থানেরও ইতিহাস। কথিত আছে, এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেছিলেন। আবার কোথাও কোথাও অরিষ্টাসুর নামে অসুর বধের কথাও পাওয়া যায়। অত্যাচারী অসুরকে বধ করার পর সবাই আনন্দে মেতে উঠে। অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির জয়ে মহাআনন্দে মেতে উঠে সবাই।
তাছাড়া আমরা সবাই দৈত্য রাজ হিরণ্যকিশপুরের কাহিনীও জানি। ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিলেও পরম ধার্মিক ছিলেন। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও যখন প্রহ্লাদকে হত্যা করা যাচ্ছিল না তখন হিরণ্যকিশপুরের বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করে। কারণ হোলিকা বর পেয়েছিল যে আগুনে তার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু আগুনে প্রবেশ করা মাত্র বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থেকে যায়। যেহেতু হোলিকা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল তাই তার বর কাজে আসে না। ফলে হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। এ থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি বলে অনেক তথ্যে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে শান্তিনিকেতনেও বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই চলে আসছে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শান্তিনিকেতনে বসন্ত পূর্ণিমার দিন উৎসবের রীতি চালু করেছিলেন। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই উৎসবের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি তখন এর নাম করেছিলেন ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’ হিসেবে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
তথ্য ঘেঁটে আরও একটি বিষয় জানা যায়, এই উৎসব কাল, স্থান কিংবা প্রথা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে জানা যায় পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে বসন্ত ছুঁয়ে যায় ভিন্নতায়। তাই বসন্ত উৎসব পালিত হয় রকম ফেরে। উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় বসন্ত পালিত হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
এশিয়ার চীন দেশে বসন্ত উৎসব উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। চীনারা এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে মজাদার সব খাবার তৈরি করে ঘরে। শুধু চীনারাই নয় অধিকাংশ মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠী এই চৈনিক উৎসব পালন করে থাকে বলে জানা যায়।
আমাদের যেমন বসন্তঋতু শেষ হওয়ার পর নববর্ষ শুরু হয়, ইরানের নববর্ষ কিন্তু বসন্ত দিয়েই শুরু হয়। ইরানে এর নাম ‘নওরোজ’। মানে হচ্ছে নতুন দিন। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে এটি উদযাপিত হচ্ছে। আর আজ ইরানের এই ‘নওরোজ’ ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, চীনের উত্তর-পশ্চিম ও ইউরোপের বলকান অঞ্চলে।
মেক্সিকোতে এ উৎসব অন্যতম। মেক্সিকোর বসন্তকে বলা হয় সান মার্কোস। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। মোরগ লড়াই থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা এমনকি সুন্দরী প্রতিযোগিতারও আয়োজন থাকে। এই অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ শুরু হয়ে এই অনুষ্ঠানটি, চলে প্রায় তিন সপ্তাহব্যাপী।
জাপানে এ উৎসব প্রকৃতির অপরূপ শোভায় অনন্য হয়ে উঠে। তারা বসন্ত উৎসব পালন করে খুবই উৎসাহের সঙ্গে। বসন্তে জাপানে ফোটে চেরি বা সাকুরা ফুল। এ নিয়েই তাদের বসন্ত উদযাপন। এ সময় পুরো দেশটাই ছেয়ে যায় চেরি ফুলে। লালে লাল হয়ে প্রকৃতি অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে সাকুরা জানুয়ারি মাস থেকেই ফুটতে শুরু করলেও উৎসবের আয়োজন কিন্তু শুরু হয় মার্চ মাস থেকে। তাদের এই উৎসবকে বলা হয় হানামি। জাপানিরা সপ্তম শতাব্দী থেকেই এই ফুল ফুটার উৎসবে আনন্দে মেতে উঠে।
বসনিয়ানরা আজব ভাবে বসন্ত উদযাপন করে। তাদের উৎসবের নাম চিয়াম্বুরিজাদা। এ দিনে তারা গামলাতে ডিম ভুনা করে সবাই মিলে খায়। উৎসবের অন্য একটি নাম হচ্ছে “ফেস্টিভাল অব ক্র্যাম্বলড এগস”।
সে যাই হোক, রংয়ের খেলা হোলি কিংবা দোলে হৃদয়ে অফুরন্ত খুশির দোলা দেয়। রঙে রঙে ভরে যায় চতুর্দিক। এছাড়াও এর রয়েছে এক সার্বজনীন আবেদন। আজ হোলি খেলা শুধু এক নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সব ধর্মের নারী পুরুষরাই রংয়ের এই উৎসবে নিজেদের মতো করে মেতে উঠেন। তাই শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি এই দোলযাত্রা অনেকের যেমন নগর সংকীর্তন করে পরমেশ্বরের নাম কীর্তনের মাধ্যমে খুশির দোলায় মন আনন্দে নেচে উঠে, তেমনি যারা ধর্মের আঙ্গিকে একে দেখছেন না তারাও বসন্তকে রাঙ্গিয়ে দেন উৎসবের রঙে। তাই আজও হোলি খেলার মাধ্যমে প্রেমের বার্তা পৌঁছে যাক চারিদিকে।রঙে রঙে রাঙ্গিয়ে দেই আমাদের মনের আকাশ। যাক আমাদের মনের দরজা খুলে। রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে হোলির রং যেন আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়
“ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগলো যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল, দ্বার খোল।।”
(এতে ব্যবহৃত তথ্য বিভিন্ন পুস্তিকা, প্রবন্ধ থেকে সংগৃহিত)
Comments are closed.