বরাক উপত্যকার বাঙালিকে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে?
কয়েকদিন আগে বরাক উপত্যকার আকাশে বাতাসে একটা মন্তব্য ঘোরপাক খাচ্ছিল।কিছুটা প্রতিবাদও হয়েছে, তবে যতটা হওয়া উচিত ছিল ততটা হয়নি। এক্স ওয়াই জেড যদি এমন মন্তব্য করতেন তাহলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ ডক্টর দয়ানন্দ বরগোঁহাই যদি এক্স ওয়াই জেড হতেন তাহলে কোনো ব্যাপার ছিল না, কিন্তু মন্তব্যটা ছিল অসম উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যানের। তাই পদের কথা ভেবে নিঃসন্দেহে এটাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এবার দেখা যাক মন্তব্যটা কি? তার মন্তব্যের বাংলা করলে দাঁড়ায় বরাক উপত্যকার মানুষ যদি অসমিয়া শিখতে না চান তাহলে তাদের অসম থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো। কথাটাকে অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, বরাক উপত্যকার মানুষ যদি আসামে থাকতে চায় তাহলে তাদেরকে অসমিয়া ভাষা শিখতেই হবে। নিজের ইচ্ছেয় যে কোন ভাষা শিক্ষা কোনভাবেই অপরাধ কিংবা নিন্দনীয় নয়, যতক্ষণ না চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কাজ করছে। শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান( ব্যক্তি মুখ্য নয়, পদ মুখ্য) এর এই মন্তব্যে বরাকের একজন হিসেবে চমকে উঠলাম? আমরা যে তিমিরে ছিলাম তাহলে কি এখনো সেই তিমিরেই রয়েছি? মিথ্যে বরাকের মাটি বারবার রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে? মিথ্যে এগারো শহিদের এবং তারপরে আরো অনেকের আত্ম বলিদান? কিছুদিন আগে চলে যাওয়া বীরেন্দ্র সূত্রধরের সহধর্মিনী ধনকুমারীর চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সংগ্রামী জীবন সত্বেও শহিদ পত্নী হিসেবে গর্বিত হওয়া তাহলে মিথ্যে?
এই মন্তব্যের পর প্রতিবাদ একদম হয়নি তা নয়, এমনকি এর বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু যতটা প্রতিবাদ করা উচিত ছিল ততটা কি হয়েছে?তাছাড়া এই বক্তব্য নিয়ে বরাক জুড়ে প্রতিবাদ হলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নেতৃস্থানীয়দের কোন বক্তব্য শোনা যায়নি। সঙ্গে প্রশ্ন হচ্ছে, বরাক উপত্যকার বাঙালির উপর বারবার কেন আঘাত হানা হচ্ছে? আর কতবার বরাক উপত্যকার বাঙালিকে পরীক্ষা দিতে হবে? না হলে কেন এভাবে বরাক উপত্যকাকে আলাদা করে দেওয়ার কথা উঠবে?
ইদানিংকালে একটা কথা সবার মুখেই শোনা যায়, সময়টা বড্ড কঠিন। সেই কঠিন সময়টার বয়স কিন্তু নেহাত কম নয়! বিশেষভাবে বাঙালির জন্য! হাজার হাজার বাঙালির কপাল পোড়া শুরু হয়েছে সে অনেকদিন! উনিশ লক্ষ মানুষের কাছ থেকে যখন নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয় তখন পোড়া কপাল নিয়ে তারা কোথায় দাঁড়াবে? নিজেদের নাগরিকত্ব তথা অস্তিত্ব হারিয়ে বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বাঙালির জন্য চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ নয়। তাই নরেন্দ্র মোদী যখন বলেন, “কেউ আপনার অধিকার, স্বতন্ত্র পরিচয় এবং সুন্দর সংস্কৃতি কেড়ে নিতে পারবে না”। কথাগুলো তখন রাজনৈতিক বক্তব্যের অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না এই ঘরপোড়া বাঙালিদের। কারণ নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি আঁকড়ে থাকার মত পায়ের নিচের জমি কৃত্রিম ভূকম্পনে বারবার নড়ে উঠছে। প্রত্যেক মানুষেরই নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসার অধিকার রয়েছে, অধিকার রয়েছে মাতৃভাষা চর্চা করার, অধিকার রয়েছে নিজের মাতৃভাষার জন্য গর্বিত হওয়ার। এর অন্যথা হলে প্রতিবাদে গর্জে উঠাই সঠিক প্রতিক্রিয়া। এই অবস্থায় অসম উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যানের ভাষা নিয়ে মন্তব্য কিংবা বরাককে আলাদা করে দেওয়ার মন্তব্যকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের ভাষা যদি বলিষ্ঠ না হয়ে ওঠে তাহলে হয়তোবা আরো আঘাতের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এই বরাকবাসীকে।
এর আগে বরাকবাসীর আবেগ বিজড়িত উনিশে মে তারিখে অসম উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিষদ (কাউন্সিল) কর্তৃক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার দিন ধার্য করে বরাকবাসীর আবেগের অমর্যাদা করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছে অনেক সংগঠন। রাজনৈতিক নেতারাও আশ্বাস দিয়েছিলেন তারিখ পরিবর্তনের। এবং পরীক্ষার তারিখের পরিবর্তনও করা হয়েছে। অর্থাৎ উনিশে মে’র দিনে কোন পরীক্ষা থাকবে না। অনেকে এ সিদ্ধান্তে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বরাকের একজন হিসেবে আমিও। কিন্তু তবুও মনের মধ্যে কোথায় একটা যেন খচখচ ভাব। হয়তো খুঁতখুঁতে মন, তাই! খুঁতখুঁতে মনটা নিজের মনেই বলে উঠলো, বরাকবাসীর আবেগ নিয়ে খেলা করার পালা তো একপ্রস্থ সম্পন্ন হয়েছে। একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন পড়েনি, উনিশে মে’র সঙ্গে বরাক উপত্যকার মানুষের বন্ধনটা কোথায়? রক্তস্নাত উনিশকে বরাকের বাঙালি আবেগে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় মনের কোথায় ধরে রেখেছে তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না কাউন্সিলের। অথচ উনিশে মে’কে অবজারভেশন ডে হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। তাহলে কেন ছিল এই প্রহসন? তাই এখন এটাকে বলা ভালো, ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’। তবু কথায় বলে, মন্দের ভালো এবং এখানে বেশি প্রযোজ্য ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার।’
সঙ্গে এটা ভেবে ভালো লাগছে, আমরা চাইলে অনেক কিছু করতে পারি, এটা প্রমাণিত।এরপর অন্ততপক্ষে উনিশে মে’র উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের চোখে চোখ রাখতে পারব আমরা।
নিজেদের ক্ষমতা বোঝার পরও যদি ইদানীংকালের ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সঙ্গে বাঙালি আপোষ করে তাহলে বলতেই হয়, আমরা যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়েছি। তবে সঙ্গে এটাও স্পষ্ট করতে হয়, এতগুলো তরতাজা প্রাণের আত্ম বলিদান মিথ্যে ছিল না। মিথ্যে ছিল না তাদের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, আবেগ। মিথ্যে ছিল না ‘জান দেব তবু জবান দেবো না’! এই কথাগুলো শুনলে যে বাঙালির আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে সেই বাঙালিদের কি সাজে আপোস করা? যাদের ঘরে কমলা, কানাইলাল, চণ্ডীচরণ জন্মগ্রহণ করেন তাদের কি সাজে সব কিছু এভাবে নীরবে মেনে নেওয়া? তাই উনিশে মে’র দিনে দরাজ গলায় গানে, কবিতায় কিংবা বক্তৃতায় যতই আমরা শহিদদের স্মরণ করি, তবু প্রশ্ন থেকেই যায় মাতৃভাষার ওপর আঁচ এলে আমরা যদি নীরবে মেনে নেই তাহলে সত্যিকার অর্থে আমরা কি শহিদদের স্মরণ করতে পারছি?
Comments are closed.