Also read in

আমি শিলচর, তোমাদের প্রিয় শিলচর; আমারও আছে অনেক সুখ-দুঃখের ইতিহাস ; আজ সেটাই জানাতে চাই আমার 'আত্মকথা'য়

আমি শিলচর, তোমাদের প্রিয় শিলচর; আমারও আছে অনেক সুখ-দুঃখের ইতিহাস ; আজ সেটাই জানাতে চাই আমার ‘আত্মকথা’য়

অনেক দিন ধরে তিল তিল করে আমি, এই শহর শিলচর, গড়ে উঠেছি। কিন্তু আমাকে তোমরা কতটুকুই বা জান! আমার ইতিহাস নিয়ে তোমরা তো খুব কমই ভাব। আমি চাই আমার অতীত নিয়ে কথা কইতে –

১৪ই আগস্ট, ১৮৩২ ইংরেজি তারিখে কাছাড় জেলা ব্রিটিশ অধিকার ভুক্ত হয়। সদর স্টেশন হিসেবে আমার গোড়াপত্তন হয় ১৮৩৩ এর মাঝামাঝি সময়ে।

স্টেশন কমিটি গঠনের মাধ্যমে আমার নগরায়ন শুরু হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। এই স্টেশন কমিটি ছিল পৌরসভা গঠনের প্রাথমিক পর্যায়।

২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২ তারিখে কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল । ওই প্রথম সভায় উপস্থিত ছিলেন ৩ জন ইংরেজ এবং ৯ জন ভারতীয়। সভায় আমার উন্নয়ন বাজেটে ১৩৪৪.০০ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল। ১৮৯৮ সালে এই স্টেশন কমিটি মিউনিসিপ্যালিটিতে উন্নীত হয়।

আমাতে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয় ১৮৯৯ সালে। এই সেদিনও অর্থাৎ ব্রডগেজ এর জন্য মেগা ব্লক হওয়া পর্যন্ত তোমাদের রেল যোগাযোগের মাধ্যম ছিল যে মিটারগেজ, সেটা ব্রিটিশদেরই অবদান। রেল যোগাযোগের আগে বহির্বিশ্বের সঙ্গে এই অঞ্চলের যাতায়াতের মাধ্যম ছিল জলপথ। সদরঘাট নামের মধ্যেই এই ইঙ্গিত স্পষ্ট।

যে কারণে আমার নাম বিশ্বের বিভিন্ন রেকর্ড বইয়ে জ্বলজ্বল করছে সেটা হচ্ছে, পোলো ক্লাব । এই গ্রহে পোলো ক্লাব প্রথম স্থাপিত হয়েছিল আমার কোলে, ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে।

এখন যে জায়গাটাকে তোমরা পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ড-টাউন ক্লাব -ইন্ডিয়া ক্লাব হিসেবে জানো সেখানটায় খেলা চলত সাহেবদের। ঘোড়ায় চড়ে পোলো স্টিক নিয়ে আমার বুকে দাপিয়ে বেড়াতো তারা। তখনকার সহকারী জেলা শাসক জো শেরারের উদ্যোগে এই ক্লাব স্থাপিত হয়েছিল।

আজ থেকে ১৫৫ বছর আগে অর্থাৎ
১৮৬৩ সনে প্রথম হাইস্কুল স্থাপিত হয় রেভারেন্ড উইলিয়াম প্রাইজের উদ্যোগে । এই স্কুলকেই তোমরা এখন বল গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল । ১৯ বছর পর মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়; এবার প্রতিষ্ঠাতা সাগর পারের সাহেব নয়, একেবারে খাঁটি দেশীয় ভরত চন্দ্র ভট্টাচার্য।

তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৫ সালে আমার আয়তন ছিল ২.৪ বর্গমাইল। সেই সময়ে আমার উপরে গড়ে ওঠা রাস্তায় ছিল ৯৮ টি ল্যাম্প পোস্ট । তবে সেটা বৈদ্যুতিক আলো ছিল না, সন্ধ্যের আগে আলো জ্বালিয়ে যেত পৌরসভার লোকেরা ।আমি বৈদ্যুতিক আলোতে ঝলমল করে উঠলাম ১৯২৯ সালে । তোমাদের পূর্বজদের খাবার জল সরবরাহের জন্য ছিল তিনটি দিঘী এবং চারটি কুয়ো ।

১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আমার রাস্তায় প্রথম গাড়ি আসে। এর আগে লোকেরা পালকি অথবা ঘোড়ায় চড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করত, ছিল গরুর গাড়ি ও। সাইকেল রিক্সা আসলো অনেক অনেক পরে, তখন দেশজুড়ে ভারতছাড়ো আন্দোলন চলছে । এক মাইলের ভাড়া ছিল তিন আনা, তোমরা ভাবছো সে সময়ের ভাড়া তো অনেক কম ছিল। আসলে, সেটা অনেক অনেক বেশি ছিল।

শুধু পোলো ক্লাব নয়, আমার গর্বের ইতিহাস আরও আছে। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর পদার্পণে আমি ধন্য হয়েছিলাম। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে আগস্ট মহাত্মাজী এসেছিলেন। পরদিন তিনি ফাটকবাজারে একটি সভা ও করেছিলেন । তোমরা এখনো ফাটকবাজারে গেলে ঐ সভাস্থলের স্মারক ফলক দেখতে পাবে। তোমরা যে চন্দ ভবনকে এখন গুড়িয়ে ফেলছো, এখনকার উকিলপট্টির সেই চন্দ ভবনেই মহাত্মা গান্ধী দু দিন কাটিয়ে গেলেন। গান্ধীজীর আশীর্বাদধন্য হয়েছিল স্বদেশী স্কুল অর্থাৎ এখনকার দিননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয় (ডিএনএনকে গার্লস হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল) ও। ওই স্কুলে গিয়ে ছাত্রীদের সামনে বসে তিনি চরকা দিয়ে সুতো ও কেটেছিলেন।

আছে, আরো অনেক আছে, জওহরলাল নেহেরু ও এসেছিলেন ; এই চন্দ ভবনেই থেকে গেলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দুবার এসেছিলেন। ১৯৩৮ ইংরেজির এপ্রিল মাসে নেতাজি কুলাউড়া থেকে প্রথমবার আমার কাছে এসেছিলেন, সভা ও করেছিলেন। নেতাজিকে স্বাগত জানাতে স্থানে স্থানে কত তোরন, সেই দিনটা ছিল আমার খুব আনন্দের । প্রথমবার তিনি এসেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে,পরের বছর আসেন ফরওয়ার্ড ব্লক দলের সভাপতি হিসাবে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদিও আসেননি, আমার প্রতিবেশী বদরপুর ছুঁয়ে চলে গিয়েছিলেন । কিন্তু উনার কবিতা উপন্যাসে আমি ঠিক আছি ‌। তোমরা কবিগুরুর ‘শেষের কবিতা’ পড়লে আমাকে খুঁজে পাবে।”তাই ও যখন ভাবছে, পালাই পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে সিলেট-শিলচরের ভিতর দিয়ে যেখানে খুশি, এমন সময় আষাঢ় এল পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বনে …” । আমাকে নিয়ে গুরুদেব একটা ছড়া ও লিখেছিলেন ।

শিলচর হায়, কিল চড় খায় ……

ও হ্যাঁ, তোমাদেরকে বলাই হয়নি আমার নামটা কি করে শিলচর হল। আসলে, সেটা নিয়ে নানা মুনির নানা মত । তবে বিদ্বজ্জনেরা বলেন, বরাক নদীর চরে বিস্তৃত শিলারাশির পাশে গড়ে ওঠার জন্যই আমার নাম হয়েছিল শিলচর।

যাক, সেটা ১৯৪২ সাল, চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । ১৮ ই মে তারিখে আমি কেঁপে উঠলাম, জাপানিরা করল বোমাবর্ষণ । ডার্বি বাগানে সেই বোমা পড়েছিল। রাতারাতি প্রায় সবাই আমাকে ছেড়ে পালালো গ্রামের দিকে । আমি তখন প্রায় একা, এক আতঙ্কগ্রস্ত শহর। অবশ্য সেটা তো মাত্র কয়েকদিন ।

তারপর, ধীরে ধীরে আমার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে চলল, বরাকের জল অনেক গড়িয়ে গেল। তোমাদের জানাবার মত আমার আরো অনেক ইতিহাস আছে। আর একদিন সময় করে তোমাদেরকে আরো কিছু জানাবো, যদি আমার ইতিহাস শুনতে তোমাদের ভালো লাগে।।

Comments are closed.