"আমি নিজে পড়াশুনা করতে পারিনি, তাই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমার এই ছোট্ট প্রয়াস"মোদির স্বীকৃতির পর উচ্ছসিত আহমদ আলীর প্রতিক্রিয়া
করিমগঞ্জ এবং পাথারকান্দির মানুষকে হরদম বহিরাগত বাংলাদেশি বলে হাসি ঠাট্টা করা হয়। গুগোল ম্যাপেও করিমগঞ্জকে অনেক সময় ভারতের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয় না। সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলটি আজ রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এমনকি আন্তরাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমও এই অঞ্চলটির প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আহমেদ আলি নামের এক রিক্সা চালকের জন্য। হয়তো অবাক হচ্ছেন, কিন্তু এটাই সত্য! তিনি গ্রামের মানুষদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এক এক করে নয়টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। একসময় দরিদ্রতার জন্য তিনি নিজে স্কুলে যেতে পারেননি, কিন্তু বাকিরাও যাতে তার মতো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয় সেই জন্য তিনি এই মহৎ প্রয়াস শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি “মন কি বাত” অনুষ্ঠানে তার এই মহৎ প্রয়াসের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং আজ তার নাম জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। কিভাবে রাতারাতি এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি আসুন জানা যাক-
গতকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি “মন কি বাত” অনুষ্ঠানে আপনার উল্লেখ করে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন আপনার এই অসামান্য অবদানের জন্য। এ সম্পর্কে আপনার অনুভূতিটা আমাদের একটু বলুন।
হ্যাঁ, আমার বয়স এখন ৮২ বছর কিন্তু এটা শোনার পর আমার মনে হচ্ছে আমার বয়স এখন ১৬ বছর। এমন আনন্দ যে পেয়েছে সেই শুধু বলতে পারবে,অন্য কেউ এই অনুভূতিটা বলতে পারবে না, বুঝতেও পারবে না। দেখুন আজ আমার ডাক্তার সুরজিৎ সিনহার কাছে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আনন্দ আর ফুর্তিতে আমি সেটাও ভুলে গেছি ।১৯৩৬ ইংরেজীতে আমার জন্ম। স্বাধীনতার আগে থেকেই আমি অনেক নেতা মন্ত্রী দেখেছি কিন্তু কৃষ্ণেন্দুবাবুর মতো কেউ আমাকে এতোটা সাহায্য করেনি। উনি আমাকে এই স্কুলের জন্য ১১ লক্ষ টাকা দান করেছেন।
আপনি কোনোদিন ভেবেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী আপনাকে এইরকমভাবে স্বীকৃতি দেবেন?
এগুলো তো আমার কল্পনার বাইরে ছিল! আমি ভাষা খোঁজে পাচ্ছি না আমার অনুভূতি ব্যক্ত করার। নরেন্দ্র মোদিকে আমি অনেক ধন্যবাদ জানাই এবং আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।”
আপনি তো করিমগঞ্জ এবং পাথারকান্দি তথা বরাক উপত্যকাকে ভারতবর্ষের সকল লোকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তো আপনি অভিনন্দন কিরকম পাচ্ছেন?
হ্যাঁ, সব দিক থেকেই অভিনন্দন আসছে। শিলচর, ত্রিপুরা সব জায়গা থেকে আসছে। আমার আর কি চাই বলুন? আমার যদি কোটি টাকার খেত কৃষিজমি থাকত তবুও তো এই আনন্দ আমি পেতাম না!
আপনার যে শিক্ষার প্রতি এত আগ্রহ যার জন্য আপনি এতগুলো স্কুল স্থাপন করলেন, এই চিন্তাধারাটা আপনার কোথা থেকে এলো?
শিক্ষা না থাকলে মানুষ তো মানুষই নয়, একেবারে অধম। আমি নিজে পড়াশোনা করিনি।একটু একটু বাংলা পড়তে পারি, এইযে আমার স্কুলে ইংরেজিতে আমার নাম লেখা আছে সেই নামটাই পড়তে পারি না, এটা আমার খুবই দুঃখ। আমার ছেলে ও মেয়েরা মেট্রিক পাস করেছে যদি এখানে স্কুল না থাকতো তবে তাদেরও পড়াশুনা হতো না। সম্পত্তি দিয়ে দেশের উন্নতি হবেনা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা অর্জন করার উপদেশ দিয়ে গেছেন। এই কথাটা আমার মনের ভিতরে বিধে আছে।
এরপর ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আপনার কি আরও কোনো পরিকল্পনা আছে?
স্কুলের বাচ্চাদের পাথারকান্দি যেতে হলে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়। তাই আমি ভাবছি একটা হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করব।
আপনার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও একটা কৌতুহল আছে, শুধু আমাদের কেন, হয়তো অনেকেরই রয়েছে, যে আপনি রিকশা চালিয়ে কি করে নয়টা স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, যদি আমাদের কিছু বলেন এসম্পর্কে……
আমাকে এই অঞ্চলের লোকেরা খুবই সাহায্য করেছে। কোন কিছু করতে গেলে অন্যদের যেখানে ১০ টাকা লাগে আমার সেখানে ৫ টাকায় হয়ে যায়। আমি যেখানেই গেছি সবাই আমাকে খুব সাহায্য করেছে। শিক্ষক যারা আছেন ওরাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। উপরওয়ালাও আমাকে সব সময় সাহায্য করে গেছেন। গ্রামাঞ্চলে লোকেরাও আমাকে অনেকে অনেক কিছু দিয়ে সাহায্য করেছে। আমার পরিবারের সোনাগুলোও এক্ষেত্রে আমি ব্যবহার করেছি। সবশেষে আমি কৃষ্ণেন্দু পালকে আবার আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, উনার সাহায্য-সহযোগিতার জন্য।
সবশেষে বলা যায় যে আমাদের দেশে আহমেদ আলীর মতো ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন রয়েছে যারা ধন সম্পত্তির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সমাজ এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। শিক্ষা যে কত বড় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে সমাজকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে সেটা আমরা আহমেদ আলীর গল্প থেকে আরও একবার উপলব্ধি করতে পারি। হয়তোবা করিমগঞ্জবাসীকে কেউ আর বাংলাদেশি বলে ঠাট্টা করবে না আহমেদ আলীর সৌজন্যে। আমরা আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে স্বীকৃতির পাশাপাশি উনি জাতীয় স্তরের পুরস্কারও লাভ করবেন।
https://www.youtube.com/watch?time_continue=438&v=kEy3gILUK6g
Comments are closed.