Also read in

"প্রাণ দিতেও রাজি আছি, সন্তান ফিরিয়ে দিন..." সৌরভ-সুপ্রিয়া নিখোঁজের বছর পূর্তিতে কাতর আবেদন পিতা সুনধনের

“ওরা বেঁচে আছে কিনা জানিনা, যদি বেঁচে থাকে যেখানে আছে যেন খাবারটুকু অন্তত পায়। যদি বেঁচে না থাকে, তবে তাদের আত্মার শান্তি হোক। বাবা হিসেবে এখন এর বেশি কোনও পাওনা নেই।” এইটুকু বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সবজি বিক্রেতা সুনধন দাস।

গত বছর ৯ জুন তার দুই সন্তান, সৌরভ আর সুপ্রিয়া নিখোঁজ হয়। অভিযোগ উঠে, এর পিছনে তার স্ত্রীর হাত রয়েছে। যদিও এর কোনও প্রমাণ মেলেনি। সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী সমবালা দাসকে নিয়ে শিলচরে ক্ষুদিরাম মূর্তির সামনে আমরণ অনশন শুরু করেন। পুলিশ এসে টেনে-হেঁচড়ে তাদের অনশন ভেঙে দেয়।

খবর পাওয়া যায় কলকাতার গড়িয়া এলাকায় তার মেয়েকে দেখা গেছে এবং পুলিশ পরিবারের লোকেদের গিয়ে মেয়েটিকে শনাক্ত করতে বলে। তাদের সঙ্গে সেখানে যেতেও রাজি হন সন্তানহারা দম্পতি। তবে সেখান থেকে ফিরে সব দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। সন্তান শোকে তার স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছেন, এখন আর জনসমক্ষে এসে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আশে পাশের বাড়ির মানুষ লক্ষ্য করেছেন প্রায় রোজ রাতেই নিজের ঘরে একা কান্নাকাটি করেন সুনধন দাস।

Vegetable vendor Sunadhan Das, father of Sourav and Supriya

শিলচর শহরের লাগোয়া অঞ্চল থেকে দুটি শিশু হারিয়ে যায়, এক বছর পেরিয়ে যায় অথচ তাদের কোনও সন্ধান দিতে পারে না পুলিশ বা প্রশাসন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অন্যের ওপর দোষারোপে ব্যস্ত থাকলেও তাদের কানে এই পরিবারের কান্নার আওয়াজ পৌঁছয় না।

যখন তারা নিখোঁজ হয়েছিল সেই সময় পুলিশসুপার ছিলেন মুগ্ধজ্যোতি দেবমহন্ত। এই ঘটনার ইনভেস্টিগেটিং অফিসারও তিনিই ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তের পর তিনি জানিয়েছিলেন পুলিশ খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, হয়তো খুব তাড়াতাড়ি রহস্য ভেদ হবে। তবে সেটা হয়নি, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কাছাড় ছেড়ে চলে যান। এক সময় পুলিশের পক্ষ থেকে সরাসরি বলা হয়, সৌরভ-সুপ্রিয়ার মা-ই নাকি তাদের লুকিয়েছে, তবে এর পর্যাপ্ত তথ্য তারা তুলে ধরতে পারে নি।

Sunadhan and Somabala Das in hunger strike

ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ সমবালা দাসকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন স্বামী সুনধন দাস। তবে তিনি স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, এটা তিনি নিজেই জানতেন না। তিনি বলেন, “বাচ্চাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই পুলিশের কাছে গেছিলাম। তারা কাগজ দেখিয়ে বলল এটা হচ্ছে মিসিং ডায়েরি, আমাকে সই করতে হবে। তারপর আমার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হল। পরে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, আমি নিজেই আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমি তো পুলিশের উপর বিশ্বাস করেছিলাম, তারা এমনটা না করলেও পারতেন। এই ঘটনায় আমার স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আর আগের মত সম্পর্ক নেই। এদিকে আমার দুই সন্তান আর কোনদিন ফিরে আসবে কিনা জানিনা, ঘটনায় সব থেকে বেশি ক্ষতি আমার হয়েছে। এখন আর ঘরে যাই না, যতক্ষণ পারি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করি। কারণ ঘরে গেলে মনে পড়ে, আমরা একদিন সুখী জীবনযাপন করতাম।”

মামলা এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক টাকার খরচ। যে এলাকায় সুনধনের ঘর, তার অর্ধেক অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। তারপরও ঋণমুক্ত হননি, এবার সব্জি বিক্রি করে ধীরে ধীরে ঋণ মিটানোর চেষ্টা করছেন। এক বছর ধরে বিভিন্ন চাপানউতোর দেখেছেন। এব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। যদিও বলছিলেন, “সন্তানরা ভাল থাক এটুকুই চাই, তারা আমার কাছে না আসলেও হবে।” তবু বাবা হিসেবে চোখেমুখে একটা আশা ছিল, সন্তান ফিরে আসবে।

Residence of Sunadhan and Somabala Das

যখন আমরা তাকে ফোন করে দেখা করতে আগ্রহ প্রকাশ করি, তিনি ভেবেছিলেন হয়তো তার সন্তানের খোঁজ পাওয়া গেছে এবং সেই খবর নিয়ে আমরা তার সঙ্গে কথা বলব। যখন জানলেন এমন কিছু হচ্ছে না, কিছুটা নিরাশ হন তিনি। একইভাবে তার পাড়ার লোকেরা প্রথমদিকে ভেবেছিলেন আমরা সৌরভ ও সুপ্রিয়ার খোজ পেয়েছি। তারা আমাদের জানালেন, সন্তান নিখোঁজ হওয়ার পর সুনধন দাস পাগলের মতো তাদের খোঁজার চেষ্টা করেছে। এসব ব্যাপারে পরিবারের ছোট খাটো অশান্তি হওয়া স্বাভাবিক। তবে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারটিই হয়েছে।

Police forcing Sunadhan and Somobala Das to uproot their hunger strike

সৌরভ ও সুপ্রিয়ার মা বাবা বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন, হাতজোড় করে তাদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। সুনধন দাস এমনটাও বলছেন, “আমার প্রতি যদি কারও কোনও রাগ থাকে এবং এর জন্য আমার সন্তানকে লুকিয়ে রেখে থাকেন, তবে আমাকে বলুন, যা শাস্তি দিতে চান আমি মাথা পেতে নেব। প্রাণ দিতেও রাজি আছি, সন্তান ফিরিয়ে দিন।”

তারা একসময় শিলচরে ক্ষুদিরাম মূর্তির সামনে আমরণ অনশনে বসেন। সমাজের কিছু লোক তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশ বাহিনী এসে টেনে-হেঁচড়ে তাদের অনশন ভেঙে দেয়। মুখরক্ষার খাতিরে পুলিশের আধিকারিক আশ্বাস দেন, এক মাসের মধ্যেই খোঁজ মিলবে তাদের হারিয়ে যাওয়া দুই সন্তানের। সেই এক মাস পেরিয়ে যায়, পুলিশ আধিকারিকটিও কাছাড় থেকে বিদায় নেন, কিন্তু নিখোঁজ শিশুদের সন্ধান মেলে না।

The neighbourhood where Sourav and Supriya grew up

সরকার বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প নিয়ে ফলাও করে প্রচার করে। অথচ আমাদের চারপাশের অনেক ছোট ছোট মেয়েরা হারিয়ে যায়, তাদের খোঁজ মেলেনা। নেহা বাকতি হোক বা সুপ্রিয়া দাস, তাদের খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। বরং পরিবারের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় সারে। যে এলাকায় তাদের বাড়ি, শিলচর শহর সংলগ্ন তপবন নগর, সেখানে মানুষের জীবনের মূল্য হয়তো অনেকটাই কম। শহরের নোংরা বয়ে নিয়ে যাওয়া খালের পাশে জমা জলে ছোট ছোট শিশুরা স্নান করছে। এর ফলে যে কোন রোগ হতে পারে, তবু তাদের কাছে হয়তো এর থেকে ভালো আর উপায় নেই। খাবার জন্য জন্য কোন সরকারি সুবিধা এলাকায় পৌঁছয় না। কিছু কিছু ঘরে টিউবওয়েল রয়েছে, সেগুলোই পানীয় জলের একমাত্র উৎস।

আমাদের চারপাশে এভাবেই অনেকে হারিয়ে যায়, প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি আসে, হারানো মানুষটি ফিরে আসে না।

Sourav and Supriya Das

Comments are closed.