Also read in

মাটির টানেই আমেরিকা থেকে শিলচর ফিরে এসেছিঃ ডঃ লক্ষণ দাস

শিলচরের অনেকেই যাকে ভগবান জ্ঞান করেন সেই লক্ষণ দাস চিকিৎসক হিসেবে যত বড় এবং জনপ্রিয়, মানুষ হিসেবেও তিনি ততটাই বড় মাপের। স্টেথোসস্কোপ কানে লাগিয়ে তিনি যেমন রোগীদের হৃদস্পন্দনের হিসেব কষতে পারেন অনায়াসে, তেমনি গরিব-দুঃখীদের হৃদয়ের খবর রেখে ওদের মঙ্গলের জন্য চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারেন পারিশ্রমিকের তোয়াক্কা না করে। ১৯৪২ সালে শ্রীহট্টে জন্মগ্রহণ করলেও স্কুল ফাইনাল পাস করেন তিনি মনিপুরের ইম্ফল থেকে। এরপর আইএসসি পাস করেছেন শিলংয়ের সেন্ট এডমুন্ডস কলেজ থেকে। তারপর চলে যান কলকাতায়। ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেন। কানাডা থেকে এফআরসিএস এবং আমেরিকা থেকে এফএসিএস পাশ করেন। পড়াশোনা শেষ করে দশ বছরের মতো আমেরিকায় চিকিৎসাও করেন ডঃ দাস। কিন্তু তারপর মাটির টানে ফিরে আসেন শিলচরে। ১৯৮৭  সাল থেকে শিলচরেই চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথমে রেডক্রস এ চিকিৎসা করলেও ২০০৪ সাল থেকে কল্যাণীতে চিকিৎসা করেন। আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যও কাজ করে চলেছেন কাজ প্রিয় ডঃ দাস। কল্যাণীতে তিনি ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন।
রোগী অন্তপ্রাণ চিকিৎসক লক্ষণ দাসের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিধি চিকিৎসা, রোগ, রোগের কারন, রোগ থেকে মুক্তির উপায় সহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।
সেই সাক্ষাৎকারের সম্পাদিত অংশ তুলে ধরা হলো।
সবচেয়ে বেশি কি ধরনের রোগী আপনার কাছে আসে?
সবচেয়ে বেশি রোগী আসে গলব্লাডার ইনফেকশনের জন্য।
এই রোগটা কম হওয়ার জন্য আপনি কি সাধারণ মানুষকে কোনও উপদেশ দেবেন?
স্টেটিসটিকেলি  দেখতে গেলে যারা তেল-ঘি জাতীয় জিনিস বেশি খান ওদেরই হয়তো এই রোগটা বেশি হয়। যদিও আমার কাছে সায়েন্টিফিক কোনও প্রমাণ নেই।
আমাদের এ অঞ্চলে গ্যাস এ্যাসিডিটি  আর গলব্লাডারের রোগী বেশি। এর কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?
আমার মনে হয় আমাদের এই খাদ্যাভ্যাসই এর জন্য বিশেষ ভাবে দায়ী। আমরা খুব বেশি তৈলাক্ত জিনিস খাই, ঝাল- মশলা আমরা বেশি ব্যবহার  করি, এটাই বোধহয় এর প্রধান কারণ।
মানুষ কিভাবে গ্যাস,এ্যাসিডিটি সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারে?
খাদ্যাভ্যাসকে বদলাতে হবে। খাদ্যাভাসে তেল-মশলা,ঝাল কমাতে হবে। সর্বোপরি আমার যা মনে হয়, আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি খাই। শরীর এতটা নিতে পারেনা। তাই হজম করার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়।
অনেক সময় অনেকে বলেন একসঙ্গে বেশি না খেয়ে দু ঘন্টার ব্যবধানে অল্প অল্প খাওয়া উচিত। এটা কতটা সত্য?
এটা বলা খুব মুশকিল। কারণ আমি এই অঞ্চলের বাইরে যখন হিমাচল প্রদেশ ছিলাম তখন দেখেছি শ্রমিক শ্রেণির লোকদের সকালে খেয়ে বাইরে বা কর্মস্থলে যেতে। আর হয়তো ওরা সন্ধ্যের সময় ফিরে খায়। তারমানে ওরা সকাল পাঁচটায় খেয়ে যায় আর বিকেল পাঁচটায় এসে খায়। মধ্যেখানে বিশেষ কিছু খায় না অথচ ওদের কোন সমস্যা হতে দেখিনি। ওরা খুব ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী।
এই অঞ্চলে ক্যান্সারটা কি খুব বেশি হয়?
কয়েকটা টাইপের ক্যান্সার তো নিশ্চিতভাবে বেশি হয় আমাদের অঞ্চলে। যেটা দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। টবাকো রিলেটেড ক্যান্সার এখানে বেশি হয়। সিগারেট, বিড়ি, পান, সাদা, তামাক, খৈনি যারা বেশি খায় তাদের মুখের এবং ফুসফুসের ক্যান্সার বেশি হয়। এটা শুধু এ অঞ্চলেই নয়, সব জায়গায়ই।
শিলচরের একাংশ মানুষ আপনাকে ভগবান মানেন অথচ আপনাকেও প্রথমে অনেক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এটা কি সত্যি?
(হাসির সঙ্গে) আমি ঠিক জানিনা, শুনেছি এরকম হয়েছিল। বিরোধিতা তখনই হয় যখন আমি অন্য কারোর ক্ষতি করবো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমি যদি  কোন ডাক্তারের উপার্জন কমিয়ে দিতাম তাহলে হয়তো ওরা বিরোধিতা করত। কিন্তু বাস্তবে আমি যাদের চিকিৎসা করতাম ওরা তো আমাকে ফি পর্যন্ত দিতে পারত না। অনেক সময়ই আমি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতাম। কারণ ওদের পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা ছিলনা। তাই বলি আমি যদি ধনী লোকের চিকিৎসা করতাম এবং কোন ডাক্তারের কাছ থেকে ওই রোগীকে ছিনিয়ে নিতাম, তাহলে ওদের বিরোধিতা করলে খাটে।
অনেকে জানেন আপনি প্রথমে অস্ত্রোপচারে পেস্ট লাগাতেন। পড়ে অনেকে বুঝলেও প্রথমে আপনাকে কি এ জন্য অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?
এটা একটা ভুল ধারনা। আমি কখনো পেস্ট লাগাতাম না। ব্যাপারটা বিস্তারিত ভাবে  বললে সময় লাগবে, তাই সংক্ষেপে বলছি প্রথম যখন অপারেশন শুরু করলাম আমরা তখন শিওর ছিলাম না যে রোগীর ইনফেকশন  হবে কিনা। তখন আমরা চামড়াটাকে সম্পূর্ণ সেলাই না করে কিছুটা ওপেন রেখে দিতাম। লোকেদের একটা ভুল ধারণা যে সেলাই টা ওপেন রেখে দিলে ইনফেকশনের চান্স বেশি। অথচ বিজ্ঞান সন্মতভাবে প্রমাণিত যে একটা ক্ষতকে  যদি খোলা রেখে দেওয়া যায় তাহলে ইনফেকশন হওয়ার চান্স কম। আবার যদি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে যেহেতু ড্রেন করছেনা তাই ইনফেকশন হওয়ার চান্স বেশি। তাই আমি একটু জায়গা খোলা রেখে দিতাম, সারতে একটু সময় লাগতো, কিন্তু ইনফেকশন হতোনা। কোনদিনই আমি পেস্ট লাগাইনি।

 

 

এখানে অনেকে চিকিৎসার নামে ব্যবসা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ শোনা যায়। শুধু বেশি পয়সা রোজগারের আশায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত রোগী একদিনে দেখে থাকেন। কথাটা কি আপনি মানেন?
কথাটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবে এখানে রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে অনেক ডাক্তারকে ইচ্ছে না থাকলেও বেশি রোগী দেখতে হয়।
সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, সিভিল হাসপাতালে অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি সহ চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তা সত্বেও মধ্যবিত্ত  জনগণ অনেক কষ্টে হলেও নার্সিংহোমে যেতে পছন্দ করেন। এটা কেন?
এটা বলতে গেলে একটু হিস্টোরিক্যাল ব্যাপারটা বলতে হবে ।আমি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কথা বলছি। ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ একটা আদর্শ জায়গা  ছিল। সব কিছু করা হতো। এমনকি লোকেদের যদি ভাল চিকিৎসা পেতে হত ওরা ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে যেত। কিন্তু এখন সেটা হয় না। তাই সাম্প্রতিক কালে আমার মনে হয় নার্সিংহোম কালচারটা এসে গেছে। তার জন্য হয়তো অনেক ডাক্তার মেডিক্যাল কলেজ বা সিভিল হাসপাতালে মনোযোগ না দিয়ে নার্সিংহোমে বেশি এ্যাটেনশন দিচ্ছেন। যদিও আমি ব্যাপারটা হলফ করে বলতে পারছিনা, তবে এটা হয়তো এর একটা কারণ হতে পারে।
আপনি যেখানে কাজ করছেন সেটা শহরতলীতে রয়েছে। শহরের মানুষ যাতে আপনার চিকিৎসার সুযোগ পান সেজন্য আপনি কি আবার রেডক্রসে ফিরে আসবেন?
 আমার বয়স এখন ৭৬।  এই বয়সে মনে হয়না এটা আর সম্ভব। কুড়ি বছর আগে হলে হয়তো ভাবতে পারতাম।
এবারে আমি জেনেরিক মেডিসিনগুলোর বিষয়ে জানতে চাইবো। এই মেডিসিনগুলোর দাম কম হয় বলে সাধারণ মানুষ কিনতে পারে। মেডিসিন গুলোর যখনই ব্র্যান্ড নাম এসে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে যায়। আপনার কি মনে হয় যে দুটোর মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে?
আমার মনে হয় গুণগত পার্থক্য আছে। এটা আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ। অনেক জেনেরিক মেডিসিন বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আসে যেগুলো এত উন্নত মানের না। এ ব্যাপারটা বিশদভাবে বলতে পারবোনা কারণ পলিটিশিয়ানদের ইন্টারেস্ট এখানে জড়িত রয়েছে।
এটা বলতে পারি,আমি যদি আমার একজন ঘনিষ্ট আত্মীয়কে মেডিসিন প্রেসক্রাইব  করি, তবে আমি জেনেরিক মেডিসিন দেবোনা। একজনের পয়সা কম বলে উন্নত মানের হবে না জেনেও জেনেরিক মেডিসিন দিয়ে দিলাম, তাহলে ওর কি কাজ হবে? প্রমাণ করতে হয়ত পারব না কিন্তু গুণগত পার্থক্য অবশ্যই আছে।
আপনি আমেরিকায় পড়াশুনা করার পরে চিকিৎসাও করেছেন। তারপর ভারত বা শিলচরে ফেরার কারণ কি মাটির টান না জনসেবা করার ইচ্ছে?
মাটির টানই বলতে পারেন। আমেরিকায় দেখেছি রোগীরা চট করে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে, এফোর্ড করতে পারে। কিন্তু ইন্ডিয়াতে অনেক জায়গা আছে যেখানে লোকেরা ডাক্তারের কাছে যেতে পারেনা বা এফোর্ড করতে পারেনা নিজেদের দরিদ্রতার জন্য। তাই ভাবলাম এখানে এলে আমার বিদ্যা বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারব।
আপনিতো অবসর সময় কাটাতে ক্লাইম্বিং করে থাকেন। এ ব্যাপারে একটু বলুন। একি আপনাকে সতেজ করে তুলে?
হ্যাঁ, ভীষণভাবে. আমাদের একটা এক্সপ্লোরার ক্লাব আছে। ওইটা থেকেই আমরা যাই। ক্লাইম্বিং এর সময় দৈনন্দিন কাজ থেকে দূরে থাকি এবং এটি খুবই রিফ্রেশিং।
সাধারণ মানুষকে ভালো থাকার জন্য চিকিৎসক হিসেবে কিছু বলবেন
আমেরিকায় আমার এক প্রফেসর বলতেন, to stay healthy keep your brain full and stomach empty. এটা যদিও একটা চূড়ান্ত উদাহরণ, তবে এরমধ্যে সত্যতাও আছে। পরিমিত খাওয়া এবং ব্রেনকে এ্যাকটিভ রাখা প্রয়োজন। এ্যাকটিভিটি  আমাদের জীবনে খুবই জরুরি।

Comments are closed.