Also read in

দ্বিচারিতা! সরকারি অর্ডারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপমানসূচক মন্তব্য জেলাশাসকের, ক্ষুব্ধ সংবাদ মহল

২০১৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সর্বানন্দ সোনোয়ালের প্রতিটি বাক্যে ‘বরাক-ব্রহ্মপুত্র’ একসুরে উচ্চারিত হয়। বহুবার শিলচর সহ বরাক উপত্যকা পরিদর্শন করেছেন তিনি এবং প্রত্যেকবার তার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পর্যাপ্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। অথচ ৪ জুন ২০২০, সন্ধ্যে সাতটার সময় হঠাৎ করে শহরের প্রায় প্রত্যেকটি পত্রিকার সাংবাদিক সহ শিলচর ও গুয়াহাটির ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং শুরু হওয়ার আগেই জেলাশাসক কার্যালয় পরিত্যাগ করলেন। কারণ স্থানীয় প্রশাসন তাদের অবহেলা এবং অপমান করেছিল।

পরের দিন সাংসদ রাজদীপ রায় এবং জেলাশাসক কীর্তি জল্লি তাদের আমন্ত্রণ করে কারণ খুঁজতে চাইলেন। সাংবাদিকরা স্পষ্ট করে বললেন তাদের অপমান করা হয়েছে, তাই তারা সভা ত্যাগ করেছেন। জেলাশাসক ক্ষমা চাইলেন এবং রাজদীপ রায় জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল নিজে এই ঘটনায় দুঃখিত।

এই অবহেলার দায় বর্তায় স্থানীয় জনসংযোগ বিভাগের ওপর। অথচ জেলাশাসক অন্য এক বিভাগের কর্মীকে বরখাস্ত করলেন এবং বরখাস্তনামায় স্পষ্ট লিখে দিলেন, “সাংবাদিকরা মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে খাবার পায়নি বলে রাগ করে বেরিয়ে গেছিলেন, এইজন্য কর্মীটিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে।” মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের যতটুক অপমান করা হয়েছিল তার থেকে কয়েক গুণ বেশি অপমানজনক জেলাশাসকের অর্ডার কপির ভাষ্য।

শিলচর শহরে দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে শুরু করে অসমের বহু মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠান করেছেন। সাংবাদিকরা প্রত্যেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন এবং প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। কাছাড় জেলায় গত পাঁচ বছরে অন্তত ছয়জন জেলাশাসক এসেছেন। আগের কেউ এধরনের একটি লাইন লিখে সংবাদমাধ্যমকে অপমান করার ধৃষ্টতা দেখান নি। একজন আইএএস অফিসার হয়ে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে এভাবে অপমান করে কীর্তি জল্লি অত্যন্ত করুণ উদাহরণ স্থাপন করেছেন।

এতে স্থানীয় সাংবাদিকরা নিজেদের ভাষ্য তুলে ধরেছেন।

যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রাক্তন সম্পাদক তথা বিশিষ্ট লেখক অরিজিৎ আদিত্য তার কথাগুলো প্রথমে ফেসবুকে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, “সাংবাদিকরা কি রিফ্রেশমেন্টের প্যাকেট না পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন বয়কট করেছিলেন? এই বিষয়টি নিয়ে জল যথেষ্ট গড়িয়েছে। এতটাই গড়িয়েছে যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পরদিনই ডিসি সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন, সেখানে শিলচরের সাংসদ রাজদীপ রায়ও ছিলেন। তাঁরা ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেন। সেই বৈঠকেই সাংবাদিকরা জানিয়ে দেন, মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস মিট বয়কটের সঙ্গে রিফ্রেশমেন্ট পাওয়া না-পাওয়ার কোনও যোগসূত্র নেই। সাংবাদিকরা অনুষ্ঠান কভার করতে যান, রিফ্রেশমেন্টের প্যাকেট বা সোজা কথায় খাবারের জন্য যান না। জেলাশাসক এবং সাংসদের সঙ্গে ওই বৈঠক হয় পাঁচ জুন এবং পাঁচ জুনই কীর্তি জল্লি তারাশংকর দাশের সাসপেনশন অর্ডারে সাংবাদিকদের রিফ্রেশমেন্ট না-পাওয়ার বিষয়টিকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেগে দেন।

অর্ডারের এই একটি লাইন শিলচরের সাংবাদিকদের জন্য যথেষ্ট অপমানজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী সফরে এসেছেন, কিন্তু তারপরও শিলচরের সাংবাদিকরা খাবারের প্যাকেট পাননি বলে তাঁর প্রেস মিট বয়কট করেছেন; ডিসির অর্ডারে এই তথ্যই কিন্তু নথিবদ্ধ হয়ে থেকে যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি, কিন্তু তিনিও ডিসির ওই অর্ডারের মাধ্যমে এমন তথ্য পাবেন যে শিলচরের সাংবাদিকরা খাবারের প্যাকেট পাননি বলে তাঁর প্রেস মিট বয়কট করেছেন।
গোটা বিষয়টি ডিসি কীর্তি জল্লি আমলাসুলভ ডিপ্লোম্যাসিতে চালিয়ে দিয়েছেন। কনফারেন্স হলের বৈঠকে সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷ আবার এক কর্মীকে সাসপেন্ড করার ক্ষেত্রে সেই সাংবাদিকদের কাঁধেই বন্দুক রেখেছেন।
তারাশংকরবাবুর সাসপেনশন একদিন ঠিক উঠে যাবে। কীর্তি জল্লিও অন্যত্র বদলি হয়ে যাবেন। কিন্তু সরকারি ফাইলে এই তথ্য নথিবদ্ধ হয়ে থাকবে যে খাবারের প্যাকেট পাননি বলে শিলচরের সাংবাদিকরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস মিটও বয়কট করেছেন। শিলচরের সাংবাদিকরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে প্রতিবাদ জানাবেন নিশ্চয়। একজন সাংবাদিক হিসাবে আমিও আমার প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম।”

তমোজিত ভট্টাচার্য, (দৈনিক গতি পত্রিকার বরিষ্ঠ সাংবাদিক)
“প্রায় চার দশক ধরে এধরনের অনুষ্ঠান একের পর এক কভার করেছি। সেদিন দুপুর ১২টায় গেছি এবং সন্ধ্যে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে শারীরিক অসুবিধার জন্য ফিরে এসেছি। পরে পুরো ঘটনা জেনেছি। কিন্তু এখন এটা কানে আসছে, যে জেলাশাসক বলছেন, সাংবাদিকরা খাবার না পেয়ে প্রতিবাদ করেছে, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমাদের কাছে সংবাদই হচ্ছে প্রধান খাদ্য, এর থেকে বেশি আমরা কিছু চাই না। এই সাধারণ সত্যটুকু যদি প্রশাসনের আধিকারিকরা বুঝতে না পারেন তাহলে আমরা দুঃখিত।”

অভিজিৎ ভট্টাচার্য, (প্রাগ নিউজ, গুয়াহাটি)
প্রায় দুই দশক ধরে সাংবাদিকতা করছি, ছোট থেকে বড় নেতা আমলা প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। সাংবাদিকদের আত্মসম্মানবোধ আর পাঁচটা লোকের থেকে বেশি। এই আত্মসম্মানবোধের জন্যই আমরা সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর মিডিয়া ব্রিফিং উপেক্ষা করি। তবে মুখ্যমন্ত্রী বা কোন বিশেষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের রাগ ছিল না। এমনকি রাতে যখন আমাদের আবার ডাকা হলো, আমরা যেতে রাজি হয়েছিলাম। এই দুঃসময়ে সাংবাদিকরা যে পরিশ্রম করছেন, এর বিনিময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ন্যূনতম সম্মান আমরা আশা করতেই পারি।

সেদিন বৈঠকে আমরা স্পষ্ট বলেছি খাবার জন্য কেউ প্রতিবাদ করেনি। আমরা নিজেদের খাবারটুকু জোগাড় করার প্রত্যেকের সামর্থ রয়েছে। প্রশাসন খাবার দেবে, এই আশায় অনুষ্ঠানে যোগ দিইনা। মুখ্যমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পরের দিন জেলা শাসকের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠকে একটা কথাই বারবার উঠে এসেছে। অথচ পরে দেখলাম তিনি একটি অর্ডারে স্পষ্ট লিখেছেন সাংবাদিকরা খাবার পায়নি বলে প্রতিবাদ করেছেন। এটা একদিকে যেমন হাস্যকর, অন্যদিকে অপমানজনক।

সুবীর দত্ত, (যুগশঙ্খ পত্রিকার বরিষ্ঠ সাংবাদিক)
যারা সংবাদ-মাধ্যমে আছেন তারা প্রত্যেকেই এতটুকু যোগ্যতা রাখেন যে অন্য কোনও চাকরিতে গিয়ে স্বসম্মানে কাজ করতে পারতেন। তবু অনেক কষ্ট সহ্য করে সাংবাদিকতা করেন। সারা জীবন ধরে তারা যেটা অর্জন করেন, সেটা হচ্ছে সম্মান। আত্মসম্মানবোধে আঘাত সাংবাদিকরা মেনে নিতে পারেন না। সেদিন কোনও সাংবাদিক খাবার বা জল পাননি বলে অভিযোগ করেননি। পরেরদিন কথাটা সাংসদের উপস্থিতিতে জেলাশাসককে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন তারা। তার পরেও জেলাশাসক তার অর্ডার কপিতে লিখলেন সাংবাদিকরা নাকি খাবার পায়নি বলে প্রতিবাদ করেছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া অন্যায়। আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা না নিলেই ভালো হয়। আমরা চাই না ভবিষ্যতে এধরনের পরিস্থিতি আবার তৈরি হোক।

বিশ্বজিৎ দত্ত (সাময়িক প্রসঙ্গ পত্রিকা বরিষ্ঠ সাংবাদিক)
আমাদের প্রত্যেক প্রতিনিধি বারবার করে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে খাবার পাওয়া বা না পাওয়া কোনো বিষয় নয়। সাংবাদিকরা অপমানিত বোধ করেছেন বলেই অনুষ্ঠান ত্যাগ করেছেন। এর দায় স্থানীয় জনসংযোগ বিভাগের। এবার যদি জেলাশাসক ঘুরিয়ে সাংবাদিকদের লিখিতভাবে বলেন সাংবাদিকরা খাবারের জন্যই কাজটি করেছেন, তবে এর জবাব তাকে দিতে হবে।

অনিরুদ্ধ লস্কর (নিউজ১৮ এর প্রতিনিধি)
শিলচর শহর শুধুমাত্র অসম নয়, সারাদেশের সংবাদ মাধ্যমের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমরা অনেক জেলাশাসক এবং অনেক মুখ্যমন্ত্রী বদল হতে দেখেছি। আমরা প্রত্যেকে অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং ভদ্র স্বভাবের সাংবাদিক। তবে আমাদের আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিল বলে সেদিন ভদ্রভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান বয়কট করেছিলাম। পরেরদিন নিজের কথাগুলো সোজাসাপ্টা ভাষায় তুলে ধরেছি। আমাদের কথা শোনার পরও জেলাশাসক লিখিতভাবে বলছেন সাংবাদিকরা খাবার না পেয়ে অনুষ্ঠান ত্যাগ করেছিল। এব্যাপারে আগামীতে তার স্পষ্টীকরণ দিতেই হবে।

রত্নদীপ দেব (প্রান্তজ্যোতি পত্রিকার প্রতিনিধি)
স্থানীয় জনসংযোগ বিভাগের আমন্ত্রণে সেদিন সাংবাদিকরা জেলাশাসক কার্যালয়ে জড়ো হয়েছিলেন। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা জেলাশাসক কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেউ এসে আমাদের একটা চেয়ার দিয়ে বসতে বলেনি। তারপর সাংবাদিকরা একসময় অনুষ্ঠান বয়কট করলেন, পরদিন জেলাশাসকের আমন্ত্রণে আবার গেলেন এবং নিজেদের কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন। এরপর জেলাশাসক অন্য ভাষায় সাংবাদিকদের ওপর দায় চাপালেন, তারা নাকি খাবার না পেয়ে রাগ করেছেন। একজন শিক্ষিত জেলাশাসক কি করে এমনটা করতে পারেন এটা নিয়ে আমরা প্রত্যেকে আশ্চর্য হয়েছি। অনেক জেলাশাসক আগে এসেছেন এবং প্রত্যেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন। প্রত্যেকটি সরকারি কাজে সাংবাদিকদের অবদান রয়েছে। এটা ভুলে আমলাতন্ত্রের নেশায় পাগল হয়ে গেলে আখেরে ক্ষতি আমলাদেরই হবে।

মকসুদুল চৌধুরী (গুয়াহাটির আসাম টকসের প্রতিনিধি)
আমরা সেদিন অনুষ্ঠান বয়কট করার পর স্লোগান দিয়েছিলাম, ‘ডিআইপিআর হায় হায়’ বলে। মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ ছিল না। পরেরদিন বৈঠকের প্রথম যে কথা আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, সেটা হচ্ছে, কেউ খাবারের জন্য অনুষ্ঠান ত্যাগ করেনি। অথচ জেলা প্রশাসন নিজেদের এক কর্মচারিকে বরখাস্ত করার চিঠিতে সোজা ভাষায় লিখছে, আমরা নাকি খাবারের জন্য কাজটি করেছি। এর জবাব আগামীতে তাদের দিতে হবে।

জাকির লস্কর (নিউজ লাইভের প্রতিনিধি)
আমরা সোজা কথা সোজা ভাবে বলেছিলাম। জেলাশাসক কেন বোঝার ভান করেন এবং পরবর্তীতে নিজের স্বাক্ষর করা চিঠিতে লিখেন সাংবাদিকরা খাবারের জন্য উৎপাত করেছে, এটা বুঝতে পারছি না। তবে এত সহজে আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে, মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে কেউ পার পাবে না। জবাব তো আমাদের কাছে প্রত্যেককেই দিতে হয়।

বিক্রম সরকার
আমরা সেদিনও যে কথা বলেছি আজও একই কথা বলছি। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে অবজ্ঞা করা হয়েছিল বলেই আমরা অনুষ্ঠান ত্যাগ করেছিলাম। এবার ভুল পথে আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে প্রশাসনের একটি অংশ। সেদিনের বৈঠকে আমরা বলেছিলাম, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেন কোন ব্যক্তির চাকরি জীবনে দাগ না লাগে। তখন সাংসদ বললেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেওয়া হবে। অথচ বর্তমান জেলা শাসকের স্বাক্ষরিত একটি অর্ডার কপিতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে সাংবাদিকরা খাবার পাননি বলে একজন কর্মচারিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। এব্যাপারে আগামীতে সবাইকে উত্তর দিতে হবে।

Comments are closed.