সংবাদমাধ্যমকে উপেক্ষা এবং অপমান প্রশাসনের, মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সাংবাদিকরা
মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে আসা সাংবাদিকদের ছয় ঘন্টা ধরে বসিয়ে রাখা হয় বৃহস্পতিবার। শেষমেষ সুরক্ষা কর্মীরা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন সাংবাদিকরা। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর বরাক সফরের সময় ঘটনাটি ঘটেছে।
প্রাথমিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী তিন জেলায় ভ্রমণ করবেন বলে কথা ছিল। সেটা বিশেষ কারণে বাতিল করে কাছাড় জেলায় মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে তিন জেলার জেলাশাসক সহ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যোগ দিতে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই কাছাড় সহ হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জে সাংবাদিকরাও অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করতে যোগ দেন। প্রত্যেকেই প্রায় দুপুর ১২টা থেকে জেলাশাসক কার্যালয় চত্বরে উপস্থিত ছিলেন।
সকাল দশটার কাছাকাছি জেলা প্রশাসনের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগ জেলার প্রত্যেক সাংবাদিককে মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুপুর সাড়ে বারোটায় মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করবেন। মেঘলা আকাশ থাকায় গুয়াহাটি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রা কিছুটা পিছিয়ে যায় এবং তিনি বিকেল তিনটে নাগাদ রওয়ানা হন। প্রায় পৌনে চারটায় কাছাড়ের জেলাশাসক কার্যালয় চত্বরে প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন সাংসদ রাজদীপ রায়, বনমন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য, উপাধ্যক্ষ আমিনুল হক লস্কর সহ কাছাড় এবং করিমগঞ্জ জেলার বিধায়করা। কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী এসেই বৃক্ষরোপণ করবেন, বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ের ছোট ছোট ছাত্রীরা হাতে পরিবেশ দিবসের প্লেকার্ড নিয়ে সকাল থেকে অপেক্ষা করছিল। তবে মুখ্যমন্ত্রী বৃক্ষরোপণ করেননি, সোজা চলে যান বৈঠক কক্ষে। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সেখানে বৈঠক চলে।
৬টা ১৫মিনিঠ নাগাদ হঠাৎ করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আসা আধিকারিকরা জেলাশাসক কার্যালয়ের নিচের তলায় সিঁড়ির পাশে একটি পোডিয়াম এবং মাইক বসিয়ে বললেন এখানেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। জায়গাটির পাশেই রয়েছে কার্যালয়ের কমন বাথরুম, দুর্গন্ধময় এবং সংকীর্ণ একটি প্যাসেজ। সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করলেন যে সবাই পোডিয়ামের সামনে থাকবেন না, সামাজিক দূরত্ব মেনেই মুখ্যমন্ত্রীর বয়ান গ্রহণ করা হবে। অথচ সিঁড়ির পাশ দিয়ে তিন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী এবং সরকারি আধিকারিকরা বারবার উঠছেন আর নামছেন। কয়েকবার মুখ্যমন্ত্রীর সুরক্ষা কর্মীরা এসে সাংবাদিকদের বললেন, আপনার সরে দাঁড়ান। সাংবাদিকরা কথা রাখলেন এবং সরে দাঁড়ালেন। এরপর হঠাৎ করে এক কালো বেশধারী সুরক্ষাকর্মী এসে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে সাংবাদিকদের সরিয়ে দিতে শুরু করলেন। উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রথম ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলেন, অন্যরা যদি উপরে কনফারেন্স হলে বসে কথা বলতে পারেন তাহলে আমরা কেন সিঁড়ির পাশে এই ছোট্ট জায়গায় দাঁড়াবো। এতে আধিকারিকরা পাত্তাই দিলেন না, উল্টো সোশ্যাল ডিসটেন্সেংয়ের জ্ঞান দিতে থাকলেন। এক সময় সাংবাদিকরা চরম অপমানিত বোধ করে ঠিক করলেন তারা আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন এবং ঠিক করলেন মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন বয়কট করা হবে। তৎক্ষণাৎ সবাই জেলাশাসক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করলেন।
সামনে তখন চোখে পড়ে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছাত্রীরা। সরকারি স্কুলের কুড়ি পঁচিশটি ছাত্রী পরিবেশ দিবসের প্লেকার্ড নিয়ে সেই সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে, তখন রাত সাতটা বাজে, তখনও মুখ্যমন্ত্রী বৃক্ষরোপণ করতে আসেননি। রাত আটটার সময় গাছ লাগিয়ে পরিবেশ দিবস পালন করার সিদ্ধান্তের উপরেও প্রশ্ন চিহ্ন উঠেছে। তবে কি পুরোটাই লোক দেখানো?
সাংবাদিকদের বেড়িয়ে যেতে দেখে প্রথমে নেমে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জগদীশ দাস এবং মুখ্যমন্ত্রীর ওএসডি শেখর দে। সাংবাদিকরা তাদের জানিয়ে দেন, এই অপমান মেনে নিতে যাতে অনুরোধ করা না হয়। এরপর নেমে আসেন, সাংসদ রাজদীপ রায়, উপাধ্যক্ষ আমিনুল হক লস্কর এবং বনমন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য। তাদেরকেও একইভাবে সাংবাদিকরা বুঝিয়ে বলেন। একসময় স্বাস্থ্যবিভাগের আধিকারিকরা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে শান্ত করার চেষ্টা করেন। শেষমেষ উপস্থিত সাংবাদিকরা গলা ফাটিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেন। বাইরে থেকে চোখে পড়ে, মুখ্যমন্ত্রী হেঁটে জেলাশাসক কার্যালয়ের গেট পর্যন্ত আসেন। এরপর গাড়ি করে ফিরে যান।
সাংবাদিকদের জল পর্যন্ত ব্যবস্থা করা হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে সাংবাদিকরা খাবার বা জল পাবার জন্য এসব অনুষ্ঠানে যান না, পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে সংবাদ উপস্থাপনের জন্যই এত পরিশ্রম করেন। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়ার জন্য প্রায় সাতঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করার পর এধরনের ব্যবহার পেয়ে সাংবাদিকরা অপমানিত বোধ করছেন। অনুষ্ঠানটি বয়কট করার পেছনে কাউকে ছোট করে দেখানো কিংবা নিজেদের দাপট দেখানোর ব্যাপার নয়।
Comments are closed.