
অনন্য দৃষ্টান্ত: প্রয়াত সাংবাদিক পীযূষ কান্তি দাসের মুখাগ্নি করলেন সহকর্মী জাকির লস্কর এবং কন্যা শিঞ্জিনী
শিলচর, ২৮ মে ।।
শিলচর শহরে মানবিকতার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার এক অনন্য নজির স্থাপন হয়েছে বৃহস্পতিবার। প্রয়াত সাংবাদিক পীযূষ কান্তি দাসের মুখাগ্নি করেছেন তাঁর কন্যা শিঞ্জিনী সৌহার্দ্য এবং দীর্ঘদিনের সহকর্মী তথা ভ্রাতা সুলভ বন্ধু জাকির লস্কর। বরাবরই আধুনিক চিন্তাধারার ব্যক্তি ছিলেন সাংবাদিক পীযূষকান্তি দাস; তার শেষকৃত্যেও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আধুনিকতার এক নিদর্শন স্থাপিত হয়েছে।
বুধবার রাতে গুয়াহাটিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তখন তার সঙ্গে স্ত্রী-কন্যা সহ পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। রাতেই সেখান থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে রওয়ানা হন পরিবারের সদস্যরা। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা নাগাদ শিলচর, অম্বিকাপট্টির বাড়িতে মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়। সেখানে তার মাতৃদেবী সহ পরিবারের আরও সদস্যরা অপেক্ষা করছিলেন।
তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সংবাদ মহলের প্রত্যেক ব্যক্তি পরিবারের পাশে ছিলেন। লাগাতার ফোনে যোগাযোগ চলছিল কখন তাকে নিয়ে শিলচর আসা হচ্ছে। শহরে ঢোকার আগেই কিছু সহকর্মী তাকে এগিয়ে নিয়ে আসতে ছুটে যান। প্রত্যেক সহকর্মীর চোখে এদিন জল দেখা যায়। এভাবে অকালে চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ অম্বিকাপট্টির বাড়ি থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে রওনা দেওয়া হয়। খুব সাবধানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে একটি ছোটখাটো শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়।
প্রথমে তাকে শিলচর প্রেসক্লাবের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সাংবাদিকরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এরপর বঙ্গভবনে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করা হয়। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের সদস্য সহ শহরের বিভিন্ন শিল্পী এবং বিজ্ঞজনেরা এতে যোগ দেন। অনেকেই চোখের জলে তাকে শেষ বিদায় জানান।
এরপর জেলাশাসক কার্যালয়ের সামনে তাকে প্রশাসনিক কর্মচারীরা শ্রদ্ধা জানান। সেখান থেকে সুসজ্জিত গাড়িটি গান্ধীবাদ পার্কের সামনে নিয়ে আসা হয়। অসম পুলিশের ডিআইজি সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের কর্ণধার, সামাজিক কর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীরা সেখানে তার মরদেহে মাল্যদানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান।
এরপর শিলচর রেডক্রস হাসপাতাল হয়ে শ্মশানঘাটে তার মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়। সেখানে শিলচরের সাংসদ রাজদীপ রায়, অসম বিধানসভার উপাধ্যক্ষ আমিনুল হক লস্কর, শিলচরের বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল, জেলা বিজেপির সভাপতি কৌশিক রাই, সাধারণ সম্পাদক কণাদ পুরকায়স্থ, শিলচর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তমাল কান্তি বণিক, বিশিষ্ট সমাজসেবী কমল চক্রবর্তী, প্রান্তজ্যোতি দৈনিকের কর্ণধার নিলয় পাল, বরিষ্ঠ সাংবাদিক অসীম দত্ত, বিকাশ চক্রবর্তী, উত্তম কুমার সাহা সহ অনেকেই শ্রদ্ধা জানান।
শ্মশান ঘাটের নিয়ম অনুযায়ী মৃতদেহের মুখাগ্নি করতে হয় এবং এতে পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। তার ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকেই এখানে উপস্থিত ছিলেন। পীযূষকান্তি দাস যখন অসুস্থ হয়ে গুয়াহাটি যান, তখন তার সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন ছাড়া আরেকজন ছিলেন, তিনি হলেন সংবাদকর্মী জাকির লস্কর। ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও এদিন তিনি তার দাদার মুখাগ্নিতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকে সম্মতি দেন, কারণ পীযূষকান্তি দাস আগাগোড়া মানবধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।
আমরা সবাই জানি, এক সময় সমাজে মেয়েদের শ্মশানে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল, মুখাগ্নি তো দূরের কথা। এই প্রথাও ভেঙে দিয়ে প্রয়াত সাংবাদিকের কন্যা শিঞ্জিনী সৌহার্দ্য মুখাগ্নিতে অংশ নেন। উপস্থিত প্রত্যেকে এই দৃশ্য দেখে অভিভূত হন। সাংবাদিকরা সমাজের সচেতন অংশ, তাদের গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। হয়তো একজন সাংবাদিকের পরিবারেই এধরনের মানবতাবোধ সম্পন্ন চিন্তাধারা থাকতে পারে।
জাকির লস্কর জানান, পীযূষ কান্তি দাস তার কাছে শুধু বড় ভাই নয়, পিতৃতুল্য একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সোনার কাছাড় পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদ জগতে এসেছিলেন। বলতে গেলে হাতেখড়ি পীযূষকান্তি দাসের কাছে। তিনি বলেন, ‘পীযূষকান্তি দাস একসময় এনডিটিভির মত সংস্থায় কাজ করেছেন। তার কাছে কাজ শেখার পাশাপাশি সঙ্গে থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের ধর্মীয় পরিচয় কখনোই সম্পর্কের মধ্যে আসেনি। দাদা সব সময় পথপ্রদর্শক হিসেবে অনড় ছিলেন। তার এভাবে চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারছেন না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ভেতরে কি হারিয়েছি, এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। দাদার শেষকৃত্যে ছোট ভাই হিসেবে এভাবে যোগ দিতে পারা অবশ্যই প্রাপ্তি।’
পীযূষকান্তি দাসের ছোটভাই পাপলু দাস শিলচরের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘আমি দাদার যতটুকু ভাই , জাকির লস্কর তার থেকে একফোঁটাও কম নয় বরং কিছুটা বেশি। তিনি আমাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে মুখাগ্নি করে দাদার মনে আনন্দ দিয়েছেন। পাশাপাশি সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মানবধর্মের এক নজির স্থাপিত হয়েছে।’
উল্লেখ্য, গুয়াহাটির এক বেসরকারি হাসপাতালে বুধবার রাত ১১টা ১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাংবাদিক পীযূষ কান্তি দাস। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। স্ত্রী শান্তশ্রী সোম, কন্যা শিঞ্জিনী সৌহার্দ্য, পরিবারের সদস্য এবং অসংখ্য গুণমুগ্ধকে রেখে গেছেন তিনি। কর্মসূত্রে তিনি গুয়াহাটির নিউজ লাইভের শিলচরের সংবাদদাতা ছিলেন। সাংবাদিক জীবন শুরু করেছিলেন দৈনিক সোনার কাছাড় পত্রিকার একজন সাংবাদিক হিসেবে।জড়িত ছিলেন আজকাল ও অমৃতবাজার পত্রিকার সঙ্গেও। তাছাড়া ‘খোঁজখবর’ নামে একটি কেবল নিউজেরও জন্মদাতা তিনি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সমাজ সেবার কাজেও তিনি জড়িত ছিলেন। তার মৃত্যুতে বরাক উপত্যকার সাংবাদিক জগতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
Comments are closed.