Also read in

উনিশ নামক লিগ্যাসি

দেশ স্বাধীন হবার পর অসমের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ( তখন মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত)গোপীনাথ বরদলৈ গোলাঘাটে এক ছাত্র সম্মেলনে ঘোষনা করলেন —“It is not the intention of the Govt. to make Assam a bilingual state.For the homogeneity of the province they( ie non-assamese) should adopt the Assamese language…Assam is for Assamese.”

তারপরই ৬০ সালের ভাষা আইন, এবং সমগ্র আসামের বাঙালি হৃদয় জুড়ে অসন্তোষ যা বরাক উপত্যকায় রূপ পায় ৬১র ভাষা আন্দোলন রূপে। এগারো প্রাণ শহিদ হলেন, অনেকেই আহত। বিনিময়ে পাওয়া গেলো মায়ের ভাষা বাংলায় বলা, লেখা, ভাবার অধিকার। এখানেই শেষ নয়,ভাষার ছুতো ধরে আঘাত এসেছে আরো তিন বার। শহিদ হলেন আরো চার জন। সবমিলিয়ে পঞ্চদশ শহিদ এই প্রান্তিক ভূমির। শ্রীহট্ট ভাগে নিদারুণ মর্মাহত হয়ে কবিগুরু লিখেছিলেন—
মমতাহীন কালস্রোতে বাংলার রাষ্ট্রসীম হতে নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি।”

কিন্তু শ্রীভূমির যমজ বোন এই বরাক এবং সেখানে থাকা বাংলাভাষীদের যন্ত্রনা মূল স্রোতের বাংলাসাহিত্যে যেমন উপেক্ষিত তেমনই ইতিহাসেও। সকল প্রতিবন্ধকতা এবং সীমিত ক্ষমতা নিয়েই এই ভাষিক সংখ্যালঘুরা শুধু লড়লেন না,জিতেও দেখালেন। সেই থেকে উনিশে মে ভাষিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সকল ভাষাপ্রেমির অস্মিতা আর গৌরবের প্রতীক। ভাষা যদিও ভাবপ্রকাশের মাধ্যম মাত্র। কিন্তু জাতি প্রেম, জাতিস্বত্বার কিছু চিহ্ন,কিছু অভিমানের জায়গা থাকে। ভাষা তাদের মধ্যে অন্যতম। আর যে জায়গা আজ বাংলা ভাষা বিশ্বআসনে লাভ করেছে,এই তৃতীয় ভূবনের শহিদের রক্তস্নান তাকে অল্প হলেও কি এগিয়ে রাখছে না?

ভাষা নিয়ে, জাত্যাভিমান নিয়ে এমন লিগ্যাসি থাকা সত্বেও তিনবছর ধরে উনিশ নিয়ে লেখা, মানে উনিশ নিয়ে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে লেখা আমার তেমন আসে না । বড় দেখনদারী, কৃত্রিম আর ছাড়াছাড়া সবকিছু।প্রাসংগিকতাই খুঁজে পাই না যেন। অথচ আমাদের স্কুল জীবন যখন ছিল তার থেকে এখন অনেক জাঁক জমক, অনেক বেশি উৎসব মুখরতা ১৯ পালনে। এই প্রজন্ম বেশ উৎসাহের সাথেই উনিশ পালন করে। আল্পনা, গান, ছবি, কবিতায়, অতিথি আগমনে বেশ ঝাঁ চকচকে ব্যাপার। কিন্তু গায়কদের বড় অংশই গান গায় রোমান হরফে লেখা রবীন্দ্রসংগীত দেখে। ভাষাতে তেমন কিছু আসে যায় না জানি,মনের ভাব প্রকাশ হলেই হল। তাছাড়া মাতৃ ভাষা, পিতৃ ভাষা নিয়ে বিরোধ করেই লাভ কি? যে ভারতীয় দুই ভিন্ন মাতৃভাষার মা বাবার শিশুর জন্ম বিদেশে তার মাতৃভাষা , সে নিজেই হয়ত ঠিক করবে বড় হয়ে। কিন্তু আমাদের উনিশের মূল তো ভাষা, নিজের ভাষার, বলার, লেখার, ভাবার অধিকার আদায়ের লড়াই, তবে সে লড়াই লড়েই কি হল যখন যা পাবার জন্য লড়া হল তা হারিয়ে ফেললাম।

The Last Lesson গল্পে প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর ফরাসী দুই প্রদেশে যখন জার্মান ভাষা বাধ্যতামূলক করল বিজেতারা, ছোট্ট ছেলে Franz বুঝেছিল যুদ্ধে আসলে তাদের স্বাধীনতা, তাদের জাতি হিসেবে সতন্ত্রতা যায় নি, ভাষাটা গিয়ে এবার যাবে। আমাদের পূর্বসূরিরা তা কিন্তু টের পেয়েছিলেন। তাই লড়ে গেছেন। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এক অধ্যাপকের মুখে শুনলাম, এত লড়াই করে পাওয়া স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তির পরীক্ষা দিতে আসা অধিকাংশ পরীক্ষার্থী ৬১ র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তো জানেই না, ‘উনিশ’ বলে যে এই উপত্যকার গৌরবের একটি তারিখ আছে সেই সম্পর্কেও অত্যন্ত ভাষাভাষা ধারনা। আর এন আর সি নামক নিয়ত হেনস্তা আর অপমানের কর্মকান্ডে আমরাতো মোটামুটি উনিশ’কে একঘরে করেই রেখেছি। লিগ্যাসি ডেটার চক্করে উনিশের লিগ্যাসি সম্পূর্ন বিস্মৃত হয়েছি। না হলে এমন মেরুদণ্ডহীন হলাম কি করে যে ফোঁস অব্দি করতে ভূলে গেলাম?আবার ঘুরে ফিরে ভাবি এত নৈরাশ্যের মধ্যেও উনিশ আছে বলেই আশা শেষ হয়নি। উনিশ আছে বলেই এই লেখার প্রয়োজন। উনিশ আছে বলেই এই উপত্যকার নিজের আলাদা পরিচয়। ৬১ থেকে আমরা সংখ্যায়, অর্থনীতিতে, সামাজিক অবস্থানে অনেকটাই শক্ত অবস্থানে আছি।উনিশ হোক আমাদের লড়াইয়ের, আত্মসম্মান রক্ষায় মিলিত ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা। আমাদের ‘শাহবাগ’।

তাই উনিশের আমাদের ড্রইং রুমের সুন্দর ওয়াল হেংগিং হয়েই থাকার দিন শেষ,এবার চেতনে যাপনে ঠাঁই দিতে হবে উনিশকে। মাটি কাদা জল রক্তে ভিজে সে আমাদের সকলের–উঁচু নীচু, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের প্রাণের আরাম, মনের শান্তি, বিদ্রোহের আগুন হয়ে রোজের জীবনে থাকবে। বৎসরের একটি বিশেষ দিন হয়ে উদযাপিত হবার আরো কত দিনই তো আছে। উনিশ না হয় আমাদের রোজনামচাই হল, প্রতি দিনের ছোট বড় সহজ কঠিন কাজে সে অভ্যাস হয়ে দেখা দিক। বিশ্বের সকলের ভাষাসংস্কৃতিকে সম্মান দিয়ে, নিজের ভাষা,নিজের জাতির মান যে চির উন্নত রাখা যায়, আমাদের ব্যবহার দিয়ে উনিশ পৃথিবীকে সেই শিক্ষা দিক।

Comments are closed.