সঠিক পথেই রয়েছে ভারতীয় ফুটবল, তবে এশিয়ার সেরাদের সঙ্গে লড়াই করতে হলে এখনো আরো অনেক পথ যেতে হবে, শিলচরে এসে বললেন প্রাক্তন ভারতীয় তারকা রেনেডি সিং
ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় তিনি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দাপিয়ে বেরিয়েছেন মাঝ মাঠ। তিনি মণিপুর তথা গোটা নর্থ ইস্টের ফুটবল আইকন রেনেডি সিং। তিন দিনের সফরে কাছাড়ের লক্ষ্মীপুরে এসেছেন প্রাক্তন জাতীয় তারকা। খুব কম সময়ে সাড়া জাগানো লক্ষ্মীপুরের ফুটবল ক্লাব লেনরুল এফ সির কর্ণধার বিকি সিং এক বিশেষ ভিশন নিয়ে কাজ করছেন। ক্লাবের ফুটবলারদের আরও এক্সপোজার দিতেই রেনেডি সিংয়েয় মতো প্রাক্তন জাতীয় তারকাকে আমন্ত্রণ দিয়েছিলেন তিনি। তার সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেই তিনদিনের সফরে এসেছেন রেনেডি।
আগামী তিন দিন লেনরুল এফ সির সিনিয়র দলকে প্র্যাকটিস করাবেন প্রাক্তন জাতীয় তারকা। শুধু তাই নয় ক্লাবের অনূর্ধ্ব ১৩, ১৫ ও ১৭ দলের সঙ্গেও সময় কাটাবেন রেনেডি। খুব শীঘ্রই মহিলাদের দল মাঠে নামাচ্ছে লেনরুল। সেদিকে নজর রেখে একটা প্রদর্শনী ম্যাচেরও আয়োজন করেছেন ক্লাবের কর্ণধার বিকি সিং। সেই ম্যাচে অংশ নেবেন ৫-৬ জন জাতীয় মহিলা ফুটবলার ও। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রেনেডি। ফুটবল থেকে অবসর নিলেও এখনো প্রাক্তন মিডফিল্ডারের ধ্যান জ্ঞান শুধু ফুটবল। আর ফুটবলের টানে তিনি ছুটে এসেছেন লক্ষ্মীপুরে।
দেশের জার্সি গায়ে ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খেলেছেন রেনেডি। ২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাই রাউন্ডে ইউ এ ই, ব্রুনেই ও ইয়েমেনের মতো দলের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিল ভারতীয় দল। ৬ ম্যাচে ১১ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। তবে গোল পার্থক্যে ইয়েমেনের থেকে পিছিয়ে থাকায় তাদের ঠিক পরে শেষ করেছিল। সেই ভারতীয় দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন রেনেডি। এছাড়া ২০০৭ সালে নেহেরু কাপ ও ২০০৮ সালে এফসি চ্যালেঞ্জ কাপ জয়ী ভারতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। মাঝ মাঠে দারুন গতিময় ফুটবলার ছিলেন। ২০১১ সালে এশিয়ান কাপে বাহরেনের বিরুদ্ধে ম্যাচ হারলেও ভারতীয় দলের দুটো গোলেই প্রধান ভূমিকা ছিল রেনেডির। তিনি দুটি গোলে বলের যোগান দিয়েছিলেন। দেশের হয়ে মোট ৭২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মণিপুরের এই মিডফিল্ডার।
ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মতো শীর্ষ ক্লাবগুলির জার্সি গায়ে দাপট দেখিয়েছিলেন ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে। এরমধ্যে কলকাতা জায়ান্ট ইস্টবেঙ্গলের হয়ে একশটিরও বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড রয়েছে তার। চিড়াগ ইউনাইটেড, জে সিটি, ইউনাইটেড সিকিমের হয়েও খেলেছিলেন। ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ মুহূর্তে আই এস এলেও খেলেছিলেন রেনেডি। সেটা ছিল ২০১৪-১৫ মরশুম। সেবার কেরালা ব্লাস্টার্সের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। তার দল খেলেছিল ফাইনালে। ফুটবল থেকে অবসর নিলেও মাঠ থেকে অবসর নেননি প্রাক্তন জাতীয় তারকা। অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ হিসাবে কেরিয়ার শুরু করেন পুনে সিটি এফসি-তে। তারপর নেরোকা এবং ইস্টবেঙ্গল এর সহকারী কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
সোমবার ব্যস্ত সুচির ফাঁকেই একটু সময় দিলেন প্রাক্তন জাতীয় তারকা রেনেডি। ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে তার বক্তব্য, ‘দেখুন, আমাদের সময়ে আজকের মত এত ভালো সুযোগ সুবিধে ছিল না। এতো ভালো ট্রেনিং ফেসিলিটি ছিল না। ভালো কোচিং সিস্টেম ছিল না। আজ কিন্তু সবকিছু রয়েছে। খেলোয়াড়রাও উন্নতি করছে। তবে এখনো অনেক পথ যেতে হবে। এশিয়ার সেরাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আমাদের আরো উন্নতি করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ধীর গতিতে হলেও ভারতীয় ফুটবল সঠিক পথেই রয়েছে। আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে। তবে তার জন্য প্রতিটি রাজ্যে ফুটবলের উন্নতি করতে হবে। শুধু কলকাতা, গোয়া এবং কেরলের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না। গোটা দেশে সমানতালে ফুটবল নিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্যই আমি এখানে এসেছি। লেনরুল ক্লাবের বিকি খুব ভালো পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। ফুটবলে এমন লোকদের খুব দরকার।’ ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আই এস এল) আসার পর ভারতীয় ফুটবলের তেমন লাভ হয়েছে কি? এর জবাবে প্রাক্তন জাতীয় মিডফিল্ডার বলেন, ‘অবশ্যই হয়েছে। কে ভেবেছিল একদিন ভারতীয় ফুটবলে এত বড় নামিদামি কোচেরা এসে কোচিং করবে। তাদের কাছ থেকে আমাদের ছেলেরা কত কিছু শিখতে পারছে। আই এস এলের সৌজন্যে আন্দ্রে নেস্তা ও রবার্তো কার্লোসের মতো কিংবদন্তিরা আমাদের দেশে এসে ফুটবল খেলেছেন। এর ফলে ভারতীয় ফুটবলের দারুন লাভ হয়েছে। ছেলেরা অনেক কিছু শিখেছে।’ মনিপুরী তারকা আরো বলেন, ‘দেখুন আসল বিষয়টা হচ্ছে, রাতারাতি সাফল্য আসবে না। এমনটা আশা করলে ভুল করা হবে। কারণ আমরা আজ যা করছি, জাপানের মত দেশ সেটা ৩০ বছর আগেই করে ফেলেছে।’ আইএসএলে নর্থইস্ট এর একটা দল থাকা সত্ত্বেও তেমন সাফল্য আসছে না। এ নিয়ে রেনেডি বলেন, ‘দেখুন, আই এস এল এর নর্থইস্টের একটা দল দিয়ে কোন লাভ হবে না। কারণ নর্থ ইস্টে প্রচুর প্রতিভা রয়েছে। মনিপুর মিজোরাম মেঘালয় থেকে প্রচুর ছেলেরা আইএসএলে খেলছে। সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড় তো নর্থ ইস্টেরই। তবে শুধু একটা দল দিয়ে লাভ হবে না। দলের সংখ্যা যত বেশি হবে ততই খেলোয়াড়রা সুযোগ পাবে। তখন ওই লাভবান হবে নর্থ ইস্টের ফুটবল।’
প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার মনে করেন ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি করতে হলে রাজ্য ও জেলাস্তরে অনেক কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ভারতীয় দল ভালো করছে। তবে বাকিরা আরো ভালো করছে। তাই আমাদের আরো পরিশ্রম করতে হবে। তবে ভারতীয় দল তখনই উন্নতি করবে যখন রাজ্য ও জেলা দলগুলি ভালো করবে। সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। রাজ্য ও জেলা স্তরে ম্যাচের সংখ্যা, টুর্নামেন্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শুধু জাতীয় দলের ২৫ জন ফুটবলারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। প্রতিটি রাজ্যকে একে অপরের সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একটা কানেক্টিভিটি থাকতে হবে। তখনই উন্নতি সম্ভব।’
মনিপুরের প্রাক্তন তারকা ফুটবলার জানান, বাবার হাত ধরেই তার ফুটবলে আসা। তিনিই ছিলেন রোল মডেল। তবে মণিপুরের আরও এক প্রাক্তন জাতীয় তারকা কিরণ খংসাইয়ের কাছ থেকে দারুন প্রেরণা পেয়েছিলেন।
আসন্ন কাতার বিশ্বকাপে কাকে সাপোর্ট করবেন? জবাবে এক গাল হাসি দিয়ে রেনেডির জবাব, ‘ফুটবলকে।’ এরপর তিনি যোগ করেন, ‘আমার মনে হয় ফ্রান্স, ব্রাজিল ও স্পেন এই বিশ্বকাপে খুব ভালো খেলবে। তবে কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে, সেটা জিজ্ঞেস করবেন না। সেটা শুধু অক্টোপাসই বলতে পারবে।’
Comments are closed.