
মলিন শর্মা, এ কেমন যাওয়া !
এ কেমন যাওয়া………
ঘুম থেকে উঠেই চোখে পড়ল হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ। চমকে উঠলাম! আবার মৃত্যু! আবার পথ দুর্ঘটনা! এবার তো সবার প্রিয় সাংবাদিকের অকাল মৃত্যু! হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এই সংবাদ। সহ্য করা মুশকিল! বার বার মনে হচ্ছিল,এ কেন মিথ্যে হলো না! তবুও এটা আমাদের কাছে একটা মর্মান্তিক সংবাদ! কিন্তু যে চলে গেছে তার পরিবারের কাছে এ হচ্ছে পৃথিবী উজাড় হয়ে যাওয়া, সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া।
সারাদিন ধরে চলেছে দুঃখ প্রকাশ। এটাই স্বাভাবিক। ডাকা হয়েছে শিলচর বনধ। প্রতিবাদে মুখিয়ে উঠেছেন মহিলা সহ শহরের বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষ। এমনটা হওয়াই উচিত।কিন্তু এই যে নিজেরা নড়ে ওঠে প্রশাসনকে নাড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, এটা যেন থেমে না যায়। কারণ শিলচরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের অব্যবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা অনায়াসেই আঁচ করা যায় অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়া অহরহ পথ দুর্ঘটনার ঘটনায়। শহরে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের ব্যস্ততা।বাড়ছে একজনকে ডিঙিয়ে আরেকজনের এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। কিন্তু বাড়ছে না রাস্তার প্রস্থ। তার উপরে রয়েছে যেখানে খুশি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার প্রবণতা। সব মিলিয়ে শিলচর শহরের যা হাল তাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে মানুষের দুরবস্থা বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করবে তার দিকেও সাধারণ মানুষের সন্দেহের আঙুল উঁচিয়ে রয়েছে। সাধারণ মাপের গাড়িগুলোর ভিড় সামলে যখন শিলচরের দিশেহারা অবস্থা তখন মৃত্যুদূত সম ট্রিপার-লরি কিংবা বড় বড় ট্রাকে শহরের অবস্থা নাজেহাল যে হবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনের দিকে আঙ্গুল উঠছে কিভাবে এই ট্রাকগুলোকে সময়ের হিসেব না মেনে যথেচ্ছভাবে শহরে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে? টাকার খেলায় সাধারণ মানুষের জীবন এক্ষেত্রে পণ রাখা হচ্ছে,অভিযোগের সুরের ভাষা এমনই। কারণ অভিযোগে আরো সংযোজিত হচ্ছে যে এই বড় বড় ট্রাক চালকদের অনেকেরই লাইসেন্স নেই। লাইসেন্সবিহীন চালক কিভাবে এত বড় ট্রিপার-লরি কিংবা ট্রাক নিয়ে শহরে ঢুকে, এ প্রশ্ন কি অবান্তর! বড় বড় শহরে যদি ট্রাফিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে, তাহলে তুলনায় ছোট্ট শহর শিলচরে এ ক্ষেত্রে বাধা কোথায়?
মলিন শর্মার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় দোষী কারা তা বের করা পুলিশ প্রশাসনের জন্য এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়, যদি তারা এ ব্যাপারে সচেষ্ট হন। তবে এখানেও সেই একই প্রশ্ন তারা কি সচেষ্ট হবেন? না হলে, কেন?
তবে এও সত্য, দুর্ঘটনার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি কিছুটা হলেও দায়ী সাধারণ জনগণও। শিলচর শহরের জনসংখ্যার তুলনায় রাস্তার পরিধি অত্যধিক মাত্রায় চারচাকার ভার বহন করতে অসমর্থ। তবু প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে চারচাকার গাড়ি রাস্তায় নামানোর অভ্যাসটা বাড়ছে। একই বাড়ি থেকে দুজন দুটো গাড়ি নিয়ে বেরোলে ‘সোকল্ড স্ট্যাটাস মেন্টেন’ হয়তোবা হয়, কিন্তু রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ে, যানজটের সৃষ্টি হয় এবং অবশ্যই অহেতুক পরিবেশ বেশি দূষিত হয়।
ব্যস্ততম পৃথিবীতে আমরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠি যে একজনকে পেছনে ফেলে আরেকজনের এগিয়ে যাওয়ার হিসেব-নিকেশে এক চুল ভুলেই হারিয়ে ফেলতে হয় কাউকে কারোর প্রিয়জন। সেই প্রিয় জন কারোরই হতে পারে, সেটা তো ভুল করেও ভোলা উচিত নয়! কমবয়সী ছেলেদের নিজেকে হিরো ভেবে বাইক কিংবা স্কুটি মাত্রাতিরিক্ত স্পিডে চালিয়ে যাওয়াকে ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আনার কথা থাকলেও তা হচ্ছে কি? বরং অনেকেরই হয়তোবা লাইসেন্স পর্যন্ত নেই!
অনেকে আবার টুকটুকি এবং শেয়ারে চলা অটোরিকশা গুলোকেও দায়ী করেন ট্রাফিক জ্যাম তথা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থার জন্য। যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার জন্য অনেক সময়ই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় পথচারীদের। তার উপর রয়েছে গাড়ি পার্কিং পর্ব। যত্রতত্র যেখানে খুশি গাড়ি পার্কিং এর ফলে সবাইকে কতটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন! যেখানে খুশি গাড়িগুলো পার্কিং করা থাকে। কোথাও কোথাও আবার এর বিনিময়ে পুরসভা পার্কিংয়ের পয়সাও আদায় করে। কোনও কোনও সংকীর্ণ রাস্তায় দুধারে এই গাড়ি পার্কিং এর ফলে রাস্তা সংকীর্ণতম হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে যেখানে খুশি গাড়ি পার্কিং শিলচরে এক বিরাট সমস্যার কারণ।
কিছুদিন আগে আমরা হারিয়েছিলাম অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সবার প্রিয় জগদীশ চক্রবর্তীকে। এবার আবার হারাতে হলো আমাদের সবার প্রিয় সাংবাদিক মলিন শর্মাকে।শিলচরবাসী নিশ্চয়ই এখনও ভুলেনি যে তারও আগে প্রাণ হারাতে হয়েছিল এভাবেই অমৃত দেবকে। বেশ কয়েক বছর আগে সুখেন্দু বিকাশ সোম (ভানু সোম নামে বেশি পরিচিত) গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিলেন তারাপুরের রাস্তায়। প্রাণ হারাতে হয়েছিল এভাবেই পথদুর্ঘটনায়। তাছাড়া আরও কত প্রাণ যে কেড়ে নিল সড়ক দুর্ঘটনা তার ইয়ত্তা নেই। তাই এবারও যদি প্রশাসনের ঘুম না ভাঙ্গে এবং সাধারণ জনগণ জেগে না ওঠেন তাহলে এ তালিকা দীর্ঘ হলে তার দায়ভার কে নেবে?
Comments are closed.