সদরঘাটে সেতুর পাশে প্রকাশ্যে সিরিঞ্জের মাধ্যমে ড্রাগস নিচ্ছে যুবক, জেলায় সক্রিয় হচ্ছে পাচার চক্র
বঙ্গভবন এবং পুরোনো সদরঘাট সেতুর মধ্যে যে রাস্তা রয়েছে, সন্ধ্যার পর সেই এলাকায় গেলে চোখে পড়ে প্রকাশ্যে সিরিঞ্জ দিয়ে ড্রাগস সেবনের দৃশ্য। সম্প্রতি খুব সাবধানে গোপনে তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটা রিক্সা রাখা রয়েছে তার পাশে এক যুবক নিশ্চিন্তে হাতে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে ড্রাগ সেবন করছে। সাংবাদিকের ক্যামেরায় সেই মুহূর্ত বন্দি হয়েছে। তবে ক্যামেরায় বন্দি না হওয়া এমন অনেক মুহূর্ত শিলচর শহরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। বরাক নদীর পাশে বিভিন্ন এলাকায় যুবকরা দল বেঁধে বসে ড্রাগস সহ নানান মাদক সেবন করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যুবসমাজের একটা বড় অংশ ড্রাগসের মত মাদকের কবলে পড়ে শেষ পর্যন্ত নেশামুক্তি কেন্দ্রে গিয়ে জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরছে। অনেকেই নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে জীবনযাপন করছে। শিলচর শহরের অন্যান্য এলাকা ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে এমন ঘটনা প্রচুর রয়েছে যেটা জনসমক্ষে আসছে না। মালুগ্রাম অঞ্চলের নদীর পাশে কখনও দিনের বেলা, কখনও বা সন্ধ্যেবেলা দলবেঁধে ড্রাগ সেবনের দৃশ্য চোখে পড়ে বলে জানিয়েছেন একাংশ মানুষ। এলাকার এমন অনেক যুবক রয়েছেন, যারা মাদকাসক্তি মুক্তিকেন্দ্র থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
প্রকাশ্যে ড্রাগস সেবনের ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশসুপার বিএল মিনার কাছে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পুলিশের তরফে ড্রাগসের পাচারের ওপর কড়া নজরদারি রাখা হয়। গোয়েন্দা বাহিনীরা লাগাতার তাদের কাজ চালিয়ে যায়। আমরা বিভিন্ন সময়ে বড় অংকের ড্রাগস জব্দ করি এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করি। তবে শুধুমাত্র পুলিশের নজরদারিতে এসব আটকানো সম্ভব নয়। যারা ড্রাগস নিচ্ছেন তাদের প্রথমে বুঝতে হবে, এটা সেবনের ফলে জীবনের কতটা ঝুঁকি নিচ্ছেন। পাশাপাশি অভিভাবকদের আরেকটু সচেতন হতে হবে, তাদের সন্তান যখন উঠতি বয়সে, সেইসময় তারা কি করছে না করছে এদিকে নজর রাখা উচিত। যেটা খেলে নিজের ক্ষতি হয়, সেটা কেন খাব? এই মনোবৃত্তি যদি যুব সমাজের মধ্যে চলে আসে তাহলে দুষ্ট লোকেরা তাদের ভোলাতে পারবে না। যেসব যুবক-যুবতীরা জীবনে বড় লক্ষ্য নিয়ে এগোয়, তাদের এসব লোভ দেখিয়ে ভোলানো যায় না। আমরা চাই সমাজের প্রত্যেক যুবক-যুবতী সচেতন হোক এবং এধরণের অফার পেলে প্রয়োজনে তাদের অভিভাবককে বা পুলিশকে খবর দিক।”
মনিপুরের সাংসদ আরকে রঞ্জন সিংহ সম্প্রতি শিলচর এসে বলেছিলেন, “নারকোটিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ড্রাগস পাচারের একটি আন্তর্জাতিক রুট রয়েছে যা মায়ানমার থেকে মনিপুর হয়ে বরাক উপত্যকায় ঢুকে। তারা করিমগঞ্জ ও আগরতলা হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শুধু মায়ানমার নয়, মনিপুর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এখন অবৈধভাবে পোস্ত চাষ হচ্ছে। এই পোস্তু থেকেই ড্রাগস বানানো হয় যা আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক দামে বিক্রি হয়। পাচারের সময় মনিপুর এবং বরাক উপত্যকার যুবকদের মধ্যে ড্রাগস বিতরণ হয় এতে যুবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে ফিরে আসা এক যুবক তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে জানিয়েছেন, মাধ্যমিক পাস করে যখন কলেজের গণ্ডিতে ঢোকেন তখন বেশ কিছু বন্ধু জীবনের ‘আসল মজা’ নিতে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। এই মজা প্রথমে বিনামূল্যেই তার হাতে পৌঁছে যায়, কয়েকটা ডোজ নেওয়ার পর যখন মজাটি তার অভ্যেস হয়ে ওঠে, তখন জানতে পারেন এখন আর বিনামূল্যে সেটা পাবেন না এবং তিনি যেটা সেবন করছেন সেটা ড্রাগস্। এর বিনিময়মূল্য অনেক বেশি, অথচ তার হাতে সেটা কেনার মত টাকা নেই। প্রথমদিকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করা, ধীরে ধীরে ঘর থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুকিয়ে বিক্রি করা, পরিবারের সদস্যদের হাতে ধরা পড়া এবং চরম হেনস্তা হওয়া, শেষমেষ বাইরে চুরি করা। পাশাপাশি পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, জীবনের শান্তি সবকিছু হারানো। অল্প বয়সে চরম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং সেখান থেকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে ঠাঁই। শুধুমাত্র একবার ভুল পথে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ায় জীবন নরকে পরিনত হয়েছিল তার। নেশা মুক্তি কেন্দ্র থেকে ফিরে সাধারণ সমাজে মাথা তুলে চলাফেরা করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। সমাজে তাকে আর আগের মত স্বাভাবিক চোখে দেখা হতো না, খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে অত্যন্ত অপমানজনক ব্যবহারে একসময় মনে হতো আবার নেশা শুরু করা প্রয়োজন। তবে অনেক কষ্টে নিজেকে আটকে ধীরে ধীরে জীবনের মূল স্রোতে ফেরার চেষ্টা করছেন তিনি। নিজেকে গড়ে তোলার বয়সের অত্যন্ত মূল্যবান সময়, সমাজ এবং পরিবারের বিশ্বাস এবং মনের শান্তি, সবটা হারিয়ে তার বন্ধু এবং সহপাঠীদের থেকে জীবনে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন।
এমন ঘটনা শুধু একজনের নয়, অনেকেই আমাদের কাছে একই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। শিলচর শহরের আশেপাশে যেগুলো নেশামুক্তি কেন্দ্র রয়েছে সেখানে পরিদর্শন করলে দেখা যায়, অত্যন্ত কমবয়সী যুবকেরা পাগলা-গারদে থাকার মতো জীবনযাপন করছেন। নেশামুক্তি কেন্দ্র থাকা যুবকদের অভিভাবক এবং পরিবারের সদস্যদের মনের যন্ত্রণাও চোখে পড়ে। সবটাই শুধুমাত্র অসাবধানতাবশত ড্রাগসের কবলে চলে আসার দরুন হয়।
Comments are closed.