শ্যামাপ্রসাদ, অহমিয়া ভাষা এবং আসামের রাজনীতি
আসামের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এক সভায় মন্তব্য করেছেন যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নাকি চেয়েছিলেন যে আসামে অসমিয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা হোক। তার এই মন্তব্যে রাজ্যজুড়ে তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমেই আমরা তার এই বক্তব্যের ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করে দেখি। তারপর আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো যে আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তার এই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু। পিতা আশুতোষের মৃত্যুর পর মাত্র বাইশ বছর বয়সে শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা সেনেটে নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৪ সালে তেত্রিশ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কমবয়সী উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ – এই চার বছরের মেয়াদে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু নতুন শাখার প্রবর্তন করেন। গৃহবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, জনস্বাস্থ্য, পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্ববিদ্যা, এরোনটিক্স প্রভৃতি শাখায় পঠনপাঠনের শুরু তার হাত ধরে। পরবর্তী জীবনে রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুবিতর্কিত শ্যামাপ্রসাদের শিক্ষাবিদ রূপে এই কাজগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ১৯৩৫ সালে তিনি স্নাতক স্থরে অসমিয়া ভাষা চালু করেন। শুধু অসমিয়াই নয়, চৈনিক ও তিব্বতীয় ভাষা চর্চার শুরুও তার হাত ধরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া। বিভিন্ন ভাষায় পঠন পাঠন শুরু করার পিছনে শ্যামাপ্রসাদের মনেও হয়তো এরকম চিন্তাভাবনাই কাজ করেছিল। কিন্তু অসমিয়া ভাষাকে অসমের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করা উচিত – এরকম মন্তব্য তিনি কখনো করেছেন বলে ঐতিহাসিক কোনো তথ্য বা প্রমাণ নেই। এ নেহাতই মুখ্যমন্ত্রীর অনৃতভাষণ ছাড়া আর কিছু নয়।
কিন্তু কেন করলেন তিনি এ ধরণের মন্তব্য? তার তাৎপর্য বুঝতে আমাদের আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির স্বরূপ বুঝতে হবে। আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বরাবরই চায় অনান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা কেড়ে নিয়ে অসমিয়া ভাষা জোর করে চাপিয়ে দিতে।( কয়েক মাস পূর্বে আসাম হাইয়ের সেকেন্ডারি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান দয়ানন্দ বরাগোহাইর বিদ্বেষ প্রসূত মন্তব্য পাঠকদের স্মরণে আছে আশা করি) এ নিয়ে বহুবার রক্ত ঝড়েছে। ১৯৬১,১৯৭২, ১৯৮৬ বারবার তিনবার বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তা প্রতিহত করতে করতে অকালে ঝরে পড়ে কয়েকটি তরতাজা প্রাণ। শুধু ভাষা চাপিয়ে দেওয়াই নয়, শ্যামাপ্রসাদের স্বজাতি বাঙালিদের উপর নেমে এসেছে অকথ্য দমন, পীড়ন, নির্যাতন, নিপীড়ন। ৮০ র দশকে বিদেশি খেদানোর নাম করে শত শত বাঙালিকে হত্যা করা হয়। নেলী, গোরেস্বর, শিলাপাথার, খোরাইবাড়ি, উওর কামরূপ প্রভৃতি জায়গা বাঙালি নিধন যজ্ঞের জন্য ইতিহাসের পাতায় কালো কালিতে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। ” বঙাল খেদা ” আন্দোলনের জন্য হাজার হাজার বাঙালি বাধ্য হয়েছেন আসাম ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যেতে। তার পরিবর্তে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতা দখল করতে সফল হয়েছে।
আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও সেই উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিরই একজন বিশ্বস্ত সৈনিক। তার ছাত্র ও যুবক কালে তিনি এ ধরণের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যে কাজ বন্দুকের নল এবং ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার ভয় দেখিয়ে করতে পারেনি, তা তিনি কৌশলে সমাধা করতে চান। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি হিন্দুত্ববাদীদের আইকনে পরিণত হয়েছেন। অনেক হিন্দু বাঙালি তাঁকে এখনো শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখেন। অর্থাৎ কোনভাবে যদি এই কথাটা রটিয়ে দেওয়া যায় যে আসামে অসমিয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা শ্যামাপ্রসাদের স্বপ্ন ছিল, তাহলে তার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এধরণের মন্তব্য করেছেন।
আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তার শপথ গ্রহণের পর রাজ্যবাসীকে সমৃদ্ধশালী ” নতুন অসম” -এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। রাজ্যবাসীও তার কর্মদক্ষতার উপর আস্থা রেখে উন্নতি ও প্রগতিতে সমৃদ্ধ আসামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পিছুটান এবং এইসব দুরভিসন্ধিমূলক মন্তব্য ত্যাগ করে তিনি উন্নয়নমূলক কাজে মনোনিবেশ করুন। তবেই তার রাজ্যকাল স্বার্থক হবে, নইলে অসমের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি কেবল একজন বাঙালি বিদ্বেষী উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবেই চিরকাল রয়ে যাবেন।
এই নিবন্ধটির লেখক কল্পর্নব গুপ্ত বরাক ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ ফ্রন্টের প্রধান আহ্বায়ক এবং আইআইটি বোম্বে’র ছাত্র
Comments are closed.