উনিশে মে, রবীন্দ্রনাথ ও স্পাইডারম্যান
এবারের উনিশে আমরা সবাই ঘরবন্দী। অন্য বছর হলে এতক্ষণে ঠিক পৌঁছে যেতাম আমার প্রাণের শহর শিলচরে। কিন্তু এবার হলো না। কিন্তু হলো না বলেই যে উনিশ আমার থেকে দূরে, তা মোটেও নয়। সারাদিন ধরেই ভেবে চলেছি, কতটুকু জানি উনিশকে?
ছোটবেলায় উনিশের সাথে আমার পরিচয় ইশকুলের বার্ষিক ছুটির তালিকায়। তারপর একটু বড় হতে গিয়ে শিখলাম বাড়ির বারান্দায় মোমবাতি জ্বালানো। মালুগ্রামের বাড়ি থেকে কিছুদূর এগোলে যুব সমাজ ক্লাবঘরের গায়ের শহিদ বেদী পর্যন্ত হেঁটে আসা। গণনাট্য সংঘের শিশু শাখার হয়ে গান, নাচ। ভালো করেই উনিশকে ‘রবীন্দ্রজয়ন্তীর মতো’ পালন করতে শিখে গিয়েছিলাম। সেই শেখাকে কখনো প্রশ্ন করিনি। আজ করছি। বেশ কিছু বছর ধরেই করছি।
প্রশ্ন করছি বলেই কয়েকটা জিনিস আজকাল বড় চোখে ঠেকে। গান্ধীবাগে ফুল দিতে গিয়ে স্পাইডারম্যানের মুখোমুখি হওয়া কেমন যেন মনে হয়। মঞ্চে উঠে যিনি ‘শোনো ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই, আর দেরি নয়, দেরি নয়’ গাইছেন, তাকেই পরমুহূর্তে এক নিশ্বাসে “এই মণিপুরি ইতারে লইয়া আর পারিনা” বলতে শুনেছি। অবাক হয়েছি। আস্তে আস্তে চোখের সামনে ভাষা শহিদ দিবসকে গোটা শহরজুড়ে উদযাপিত হতে দেখেছি। কিন্তু কোথাও গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, এটাই কি উনিশের শিক্ষা? উত্তরাধিকার?
৬১তে যারা লড়েছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন ভাষিক সম্মানের সংগ্রামকে, তারাই পরে আমাদের পূর্ব প্রজন্মকে শিখিয়েছিলেন এই সংগ্রামের অর্থ। তারপর, সেই প্রাপক প্রজন্ম আমাদের শিখিয়েছে নিজের সংস্কৃতিকে বুক ঠুকে স্বীকৃতি দিতে। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় বাংলা গান গাওয়াটা বন্ধুমহলে বেশ ঠাট্টারই কারণ হতো। কিন্তু আমরা বড়দের দেখানো পথে চলতাম, কোনো প্রশ্ন করতাম না। জানতে চাইতাম না, কেন করছি। চুপচাপ হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে গেয়ে যেতাম। এখন গত দেড় দশক ধরে শিলচর তথা বরাক উপত্যকায় বাংলা সংস্কৃতি চর্চার নতুন জোয়ার এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় তরুণ গানের দল, নাচের দল, নাটকের দল। তারা একের পর এক অসাধারণ প্রযোজনা করছেন। উনিশের শহরে বাঙালিকে আর নিজের সংস্কৃতি বিষয়ে কোনো হীনমন্যতায় ভুগতে হয় না আর। এই শিক্ষাটা আমরা পেয়ে গেছি আমাদের পূর্ব প্রজন্ম থেকে।
কিন্তু এই ঘরবন্দী উনিশে আমার মাথায় ঘুরছে একটা বড় প্রশ্ন। এরপর কী? আমরা কী শিখিয়ে যাব আমাদের পরের প্রজন্মকে? শুধুই গান-নাচ-নাটক-বর্ণমালায় মোড়া টিশার্ট? যে চেতনার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে নেব আমরা আজকের গোটা দিনজুড়ে, সেই দিনের ইতিহাস থেকে কী শিখেছি আমরা, যে পরবর্তীর জন্য কিছু শিক্ষণীয় রেখে যাব?
আমাদের চারপাশের বাস্তব ১৯৬১’র নয়। ১৯৭৯ নয়। ১৯৮৫ নয়। আমাদের বাস্তব ২০২০। হাত পাতলে করোনা আর কান পাতলে নাগরিকত্ব। এর মাঝেই উনিশ। এর মাঝেই রবীন্দ্রজয়ন্তী। এর মাঝেই নববর্ষ। আমাদের মতো বাঙালির জীবনে একের পর এক গ্রীষ্মকালীন উৎসব। ব্যস ওইটুকুই। দিন ফুরোলে সব শেষ। আবার ফিরে যাওয়া প্রতিদিনের নিয়ম মেনে টিকে থাকার লড়াইয়ে। মাস্ক জোগাড় থেকে কাগজ জোগাড়, এই যোগানেই ব্যস্ত থাকব আমরা সবাই। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও উনিশ অন্তত আসামের বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে অর্থবহ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। যদিও সেই ভূমিকা সম্বন্ধে এখনও আমার সমসাময়িক অনেকেই অবগত নন। সেটা কি, তা-ই একটু খুলে বলি। তাহলে আমাদের প্রজন্মের কর্তব্যটা কিছুটা পরিষ্কার হবে, আশা করি।
আমরা জানি, যে উনিশে মে, একুশে ফেব্রুয়ারি সবই ছিল সংখ্যাগুরুর আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর ন্যায় আদায়ের লড়াই। সংখ্যাগুরুর ভাষা জোর করে সংখ্যালঘুর ওপর চাপিয়ে দেবার প্রতিবাদই এর মূলে। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধও অনেকটা তাই। কিন্তু সমস্যা হলো, একুশ-পরবর্তী, ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ এই লড়াইয়ের উত্তরাধিকার বুঝে নেওয়ার আগেই সংখ্যাগুরু ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায়। ফলস্বরূপ, আমাদের চোখের সামনে বাংলা ভাষা কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে আগ্রাসকের ভাষা, যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার জেনেভা ক্যাম্পের চাকমা, মারমা ও উর্দুভাষীদের কাছে কোনোভাবেই একুশের বার্তা নিয়ে আসে না। আসামে অবশ্য গল্পটা কিছুটা আলাদা। আসামে বাঙালি নিজেই সংখ্যালঘু। রাজ্যের ভিত্তিতে দেখলে, সেখানে সে প্রান্তায়িত। কিন্তু উনিশের মাটি, বরাক উপত্যকায়, সে সংখ্যাগুরু। সেখানে বাংলাভাষীর ঠিক পাশেই বাস করেন নেপালি, মেইতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, খাসি, নাগা, মিজো, ভোজপুরি, মারোয়াড়ি, অসমিয়া, ডিমাসাসহ একাধিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। উনিশের উদযাপনে আমরা গর্বের সাথে নাম করি শহীদ সুদেষ্ণা সিনহার, ভাষাসৈনিক সনৎ কৈরির। কিন্তু বাস্তবে, ২০২০ সালে, কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীর স্বকীয় সাংস্কৃতিক চর্চার স্থল? চলচ্চিত্র উৎসবে বা নাটকের ফেস্টিভ্যালে বা বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে কটা আয়োজন হয়েছে অ-বাঙালি ভাষাগোষ্ঠীদের জন্য? যে সংখ্যক অবাঙালি দর্শক আসেন বাংলা গান শুনতে, একই হারে কি বাঙালিরা ভিড় করেন মণিপুরি কীর্তনের আসরে?
এবারের উনিশে আমি তাই কেবল প্রশ্ন করছি। প্রশ্ন করছি আমার আংশিক উত্তরাধিকার বহন করতে পেরেই গর্বিত থাকা সত্ত্বাকে। প্রশ্ন করছি উনিশের বহুত্বকে ভুলতে বসা শহুরে সংখ্যাগুরুর প্রেমে মত্ত উদযাপনকে। প্রশ্ন করছি পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা শহিদ বেদীর পাশেই অজান্তে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার মতো আমাদের সামূহিক অসাড়তাকে। প্রশ্ন করছি আমার পূর্ব প্রজন্মের ব্যর্থতার পাশাপাশি আমার প্রজন্মের অজ্ঞানতাকে।
এবারের উনিশে আমি কেবল প্রশ্নই করছি। উত্তর দিতে আরও বেশ কয়েকটা উনিশ পেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। কে জানে, হয়তো তখনই আমাদের উনিশের সাথে সত্যিকারের পরিচয় ঘটবে। ততদিন পর্যন্ত, উনিশের উদযাপন আর রবীন্দ্রজয়ন্তীর নির্ঘন্ট মেনে রবীন্দ্রনাথ স্মরণে আমি কোনো মৌলিক ফারাক দেখিনা। কবীর সুমন যেমন বলেছিলেন, “প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবিঠাকুর মূর্তিগড়া”… পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা শহিদ বেদী আসলে ঠিক এই গানের পঙক্তির মত আমাদের ফাঁপা উনিশ-মূর্তির দিকে আঙ্গুল তুলে অট্টহাস্য করে। আর আমরা? নূতন যৌবনেরই দূত? আমরা স্পাইডারম্যানের সাথে সেলফি তুলছি।
Comments are closed.