দু বছর ধরে নিখোঁজ সৌরভ-সুপ্রিয়া; সমাধান সূত্র খুঁজে বের করতে পারেননি চারজন পুলিশ সুপার, "তারা মরে গেলে হাড়গোড় এনে দিন", বলছেন বাবা
দুই বছর আগে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি ১২-বছরের সৌরভ দাস এবং ৫-বছরের সুপ্রিয়া দাস। একসময় তাদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে মায়ের হাত রয়েছে বলে পুলিশ সোমবালা দাসকে গ্রেফতার করে। তার স্বামীর অনুরোধে জামিনে মুক্তি পান সোমবালা। তখন কাছাড় জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন মুগ্ধ জ্যোতি দেবমহন্ত। এরপর জেলায় আরও তিনজন পুলিশ সুপার এসেছেন, মানবেন্দ্র দেব রায়, বিএল মিনা এবং বৈভব চন্দ্রকান্ত নিম্বালকর। প্রত্যেকের কাছেই সাংবাদিকরা এই প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং প্রত্যেকে আশ্বাস দিয়েছেন তারা খোঁজ নেবেন। অনেকেই বলেন, বড়লোকের সন্তান হারালে তাকে দ্রুত খোঁজা হয়, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত টুইট করেন। কিছু বছর আগে তৃষা নামের একটি শিশু হারিয়ে যাবার পর পুলিশ এবং সরকার মিলে তাকে উদ্ধার করলেও তার সঙ্গেই নিখোঁজ হওয়া নেহা বাকতিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৫ জুন নেহা বাকতি নিখোঁজ হওয়ার চারবছর হয়েছে। অনেকেই এই কথা ভুলেই গেছেন।
রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া সৌরভ-সুপ্রিয়ার বাবা সুনধন দাস একসময় রিক্সা চালাতেন। শিলচর শহর সংলগ্ন তপোবন নগর এলাকায় তাদের বাড়ি। দুই শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দিনরাত পরিশ্রম করতেন এবং তাদের জন্য ধীরে ধীরে পাকা ঘর বানানোর কাজ শুরু করেছিলেন। ২০১৯ সালের ৯ জুন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, যে বাড়িতে একদিন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাতেন, সেখানে এখন বসে বসে অপেক্ষা করেন যদি কোনও খবর আসে। পাড়ার লোকেরা জানিয়েছেন, গত দুই বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন রাতে তার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসে। মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।
বরাক বুলেটিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার কথার খেই হারাচ্ছিলেন। প্রথমেই তিনি বলেন, “আমার সন্তানরা গরু-ছাগল নয় যে হারিয়ে গেছে এবং তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদি তারা জীবিত না থাকে আমাকে কেউ তাদের হাড়গোড় এনে দিক, তখন বিশ্বাস করব আমি সন্তানহারা হয়েছি। এর আগে বিশ্বাস করব না এবং অপেক্ষা ছেড়ে দেব না।” এই কথা বলতে গিয়ে তার চোখে মুখে একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছিল।
তবে পরের মুহূর্তেই হতাশ হয়ে বলেন, “আমার সাধ্যমত চেষ্টা তো বাদ দেইনি, তবু দুবছর হয়ে গেলো তাদের কোনো সন্ধান পেলাম না। প্রত্যেকের কাছে গেছি, হাতজোর করেছি, আন্দোলন করেছি, তবে পুরো সমাজ মিলে দুটো শিশুকে খুঁজে বের করতে পারেনি। এই বাড়ি ঘর, এই জীবন, সবটাই আমার কাছে নিরর্থক। তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টায় অনেক টাকা খরচ করেছি, এতে ঋণ হয়েছে। সেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার খাতিরে এখনও সব্জি বিক্রি করতে যাই, কিন্তু নিজেকে মৃত বলে মনে হয়, বেঁচে থাকার কোনও কারণ খুঁজে পাই না।”
গত বছর তিনি বলেছিলেন তার স্ত্রীর মানসিক অবস্থা ভালো নয়, তাই তিনি কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। এমনকি নিজেই স্ত্রীকে অনেকদিন দেখতে পাননি। তবে গত এক বছরে তার সঙ্গে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যাতে কোথাও একটা সন্দেহ জাগছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গতবছর জানিয়েছেন সোমবালা দাস নিখোঁজ। তবে এতে তারা একেবারেই বিচলিত নন, বরং তার বোন ও তার স্বামী জমির কাগজপত্র ঠিক করতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। এতে সুনধন দাসের মনে একদিকে যেমন সন্দেহ জাগছে, অন্যদিকে একটা আশা দেখছেন, হয়তো তার স্ত্রীর নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এমন কিছু সূত্র রয়েছে যেটা ধরে দুই সন্তানকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, “একসময় আমাকে দিয়ে এক কাগজে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে আমার স্ত্রী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে আমি তার জামিন পাওয়ার ব্যবস্থা করেছি এবং ঘরে ফিরিয়ে এনেছি। এর পরেও তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন এবং বহুদিন ধরে তার দেখাই পাইনি। শুনেছি গত এক বছর ধরে তিনি নিখোঁজ, পরিবারের মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর বাকি সদস্যরা একেবারে নির্বিকার। আমি বাবা হিসেবে নিজের সন্তানদের হারিয়ে কতটুকু বিচলিত এটা নিজে জানি। এই জায়গায় আমার একটা সন্দেহ দেখা দিচ্ছে এবং এর পিছনে রয়েছে একটা আশার আলো। আমার মনে হয় যদি পুলিশ আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পারে তাহলে সন্তানদের খুঁজে পাওয়ার একটি সূত্র বেরিয়ে আসবে। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা লাগাতার আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন এবং আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। যদি এর পেছনে কোনও রহস্য থাকে এবং সেটা পুলিশ খুঁজে বের করে তাহলে আমার সন্তানের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমি কার কাছে গিয়ে বলব, পুলিশের কাছে আমি অপরাধী, কারণ যার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ তার জামিন আমিই নিয়েছিলাম। একসময় বিজেপির সদস্য হিসেবে অনেক পরিশ্রম করেছি, কিন্তু সরকার পক্ষের কেউ আজ পর্যন্ত আমার পাশে দাঁড়াননি। হয়তো আমি তাদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নই, বা আমার সন্তান হারিয়ে যাওয়া তাদের কাছে খুব একটা বড় ব্যাপার নয়। কাউকে দোষারোপ করি না, তবে বাবা হিসেবে একটাই স্বপ্ন, যেকোনওভাবে আমার সন্তানরা ফিরে আসুক। তারা না এলে এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।”
রাজ্যে নতুন সরকার আসার পর ড্রাগস বিরোধী অভিযান চলছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে অভিযানের বৃত্তান্ত নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের প্রচার করছে পুলিশ বিভাগ। তবে শিলচর শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে দুটো শিশু হারিয়ে যাওয়ার দু’বছর পরেও এদের সন্ধানের সূত্র খুঁজে বের করা যায়নি। বৈভব চন্দ্রকান্ত নিম্বালকর কাছাড় জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেওয়ার পরের দিন সংবাদমাধ্যমে মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাকে এই বিষয়ে অবগত করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন মহিলা এবং শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের ক্ষেত্রে তিনি সব থেকে কঠোর থাকবেন। এবার দেখার বিষয় চতুর্থ পুলিশ সুপার হিসেবে এই ঘটনার সমাধান সূত্র তিনি বের করতে পারেন কিনা।
Comments are closed.