"মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দেননি," এই বলে সংখ্যালঘু মোর্চার সব স্তরের কমিটি বাতিল করল দল
নির্বাচনী প্রচারে বিজেপির তরফে বারবার বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা আর বিজেপিকে ভয় পাননা, তারা বিজেপিকে ভোট দিতে শিখে গেছেন। অথচ ফলাফল ঘোষণার পর প্রাথমিক সমীক্ষার ভিত্তিতে দলের তরফে সরাসরি বলা হচ্ছে, “মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা বিজেপি প্রার্থীদের ভোট দেননি এবং এটাই দলের আসন কম পাওয়ার অন্যতম কারণ।” এই যুক্তি দেখিয়ে রাজ্য বিজেপি প্রত্যেক স্তরের সংখ্যালঘু মোর্চা বাতিল করে দিয়েছে। বুধবার দলের রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক তথা শিলচরের সাংসদ রাজদীপ রায় এক্ষেত্রে এক নির্দেশ জারি করেছেন, এতে বলা হয়েছে, “রাজ্য, জেলা এবং বুথ স্তরের প্রতিটি সংখ্যালঘু মোর্চা আপাতত বাতিল করা হচ্ছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন দলের রাজ্য সভাপতি রঞ্জিত দাস।”
এই সিদ্ধান্তে দলের প্রায় প্রত্যেক স্তরের কর্মকর্তা এবং নেতারা সমর্থন জানিয়েছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। হোজাইয়ের প্রাক্তন বিধায়ক তথা দলের বিতর্কিত নেতা শিলাদিত্য দেব ফেসবুকে লিখেছেন, “আমাদের দল প্রথম থেকে ‘সবকা সাথ-সবকা বিকাশ-সবকা বিশ্বাস’ নীতি নিয়ে কাজ করেছে। তবে গত পাঁচবছর রাজ্যে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সমান উন্নতি করলেও নির্বাচনের সময় আমাদের দল মুসলমান সম্প্রদায়ের মন জয় করতে পারেনি। এত কাজ করেও মন জয় করা যায় না, কারণ মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ধর্মীয় পরিচয় সামাজিক উন্নতি থেকে বেশি গুরুত্ব পায়। সংখ্যালঘু মোর্চা বাতিল করার ক্ষেত্রে দলের রাজ্য কমিটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তাদের সমর্থন জানাই।”
সম্প্রতি কাছাড় জেলা বিজেপির তরফে সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করে একই কথা বলা হয়েছিল। এতে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির সভাপতি বিমলেন্দু রায়, দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা নিত্য ভূষণ দে সহ অন্যান্যরা। তারা বলেছিলেন, ‘বিজেপি সরকার গত পাঁচ বছরে সারা রাজ্যের সঙ্গে বরাক উপত্যকার উন্নতির স্বার্থে অসংখ্য প্রকল্প চালু করেছে এবং এর ফল ভোগ করেছেন রাজ্যের প্রত্যেকে। সরকারি প্রকল্পের লাভ থেকে বাদ যাননি কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা। অথচ নির্বাচনে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা সরাসরি বিজেপির বিরোধিতা করেছেন। তারা দায়িত্ব নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন এবং বেশি সংখ্যায় দিয়েছেন, এতেই বরাক উপত্যকায় দলের প্রার্থীরা একের পর এক পরাজিত হয়েছেন। শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কথা সামনে রেখে এক সম্প্রদায়ের লোকেরা এভাবে ব্যবহার করবেন, এটা আমরা আঁচ করতে পারিনি। এবার হয়তো নিজেদের পরিকল্পনায় অনেকটাই পরিবর্তন আনা হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা না হয়।’
তারা আরও বলেন, ‘যেসব এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটদাতার সংখ্যা কম, সেখানে বিজেপির প্রার্থীরা সহজে জয়ী হয়েছেন এবং ভালো ভোটও পেয়েছেন। আমাদের প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা ৯০ শতাংশের বেশি ভোট দিয়েছেন। যারা কাছাড় জেলার বাইরে ছিলেন তারা নির্বাচনের দিন বা তার আগে এলাকায় পৌঁছে গেছেন এবং দায়িত্ব নিয়ে ভোট দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য তারা কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোটের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অথচ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এব্যাপারে উদাসীন, তারা পরোয়া করেননি নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের খাতিরে অন্তত ভোট দিতে যাবেন বলে। এতেই আজ পরিস্থিতি এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বরাক উপত্যকার ১৫ টি আসনের মধ্যে ৮টিতে মুসলমান প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন এবং সেখানে একজনও বিজেপির নন। এখনও যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ভবিষ্যতের পরিস্থিতি আঁচ করতে না পারেন, তাহলে ভুগতে হবে তাদেরই।’
এবছর বিজেপি আমিনুল হক লস্কর সহ বেশ কয়েকটি আসনে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিলেও এদের মধ্যে কেউ জয়ী হতে পারেননি। তবে আমিনুল হক লস্কর পরাজিত হওয়ার পেছনে অন্যতম ফ্যাক্টর ছিলেন দলের হিন্দুত্ব ভাবধারার পোস্টার-বয় আশীষ হালদার। টিকিট না পেয়ে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রায় ১৪ হাজার ভোট পেতে সমর্থ হন। অবশ্যই এই ভোট বিজেপির পক্ষে আসতো যদি তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতেন। এছাড়া বড়খলা এবং কাটিগড়া সমষ্টিতে প্রচারের ক্ষেত্রে জেলা বিজেপি উদাসীনতা দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দুই আসনেই কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হয়েছেন এবং দুজনেই মুসলমান সম্প্রদায়ের। এমন আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো দলের খতিয়ে দেখা উচিত, বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
Comments are closed.