Also read in

"নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে."----জয়তী চক্রবর্তীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন নিম্মি চক্রবর্তী

নিম্মি চক্রবর্তী

সেদিন রাতে স্কুলের অনলাইন মিটিং এ বসবো, মোবাইল টা হাতে নিতেই অবিস্বাস্য একটা মেসেজ এলো, ….
আমার  অতি প্রিয় রূপাদিদি (ড: জয়তী  চক্রবর্তী)  আর নেই—-

কিছুতেই মানতে পারছি না …কিছুতেই না ।দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে, … কনফার্ম হবার জন্য আমার দুএকজন বন্ধু ও আত্মীয়কে ফোন করলাম এবং ঘটনাটা সত্যি প্রমাণিত হলো…কিন্তু আমি কি করে মেনে নেব?

এই কোভিড আর কতো প্রাণ নেবে? আর কতো?

ছোটবেলা থেকে ওর সাথে আমার সম্পর্ক। ও আমার বাবার ছোটবেলার বন্ধু হীরা কাকুর মেয়ে। বাবার চাকরির সুবাদে আমরা আসামের বিভিন্ন জায়গায়  ছিলাম। কিন্তু পুজোর সময় বা যখনই শিলচর আসতাম , বাবার সাথে ওদের বাড়ি যেতাম।আমাদের বাড়ি ছিল জেইল রোড উল্লাসকর দত্ত সরণী আর ওদের বাড়ি শিলং পট্টি।

তখন তো এতো আপন পর বুঝতাম না, দিদি মানেই  নিজের দিদি ভাবতাম। রূপাদিদি ছোটবেলায় খুব রোগা পাতলা ছিল, দুদিকে দুটো বিনুনী বেঁধে থাকতো। ওদের বাড়িতে গেলেই আমাকে ওর পড়ার টেবিলের সামনে বসিয়ে অনেক গল্প করতো। আমিও খুব মন দিয়ে শুনতাম ওর মিষ্টি মিষ্টি কথা । এভাবেই অনেক বছর কাটলো, আমরাও বড় হলাম ও আমার দুবছরের সিনিয়র ছিল । তারপর ১৯৯৫ সালে আমরা ট্র্যান্সফার হয়ে স্থায়ীভাবে শিলচর এলাম। ১৯৯৬ সালে দূরদর্শনে আমি কেজুয়েল অ্যানাউন্সার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলাম। সেখানে গিয়ে আবার রূপাদিদিকে পেলাম। তারপর আকাশবাণীতেও রূপাদিদি আর আমি একসাথে অনেকদিন কাজ করলাম। সেই সময় আমরা কত যে মজা করতাম  , হাসি ঠাট্টা, আড্ডা, আরো কতো কি। ও যে কি আদর করতো আমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।  তারপর ও উওমেন কলেজে বাংলার অধ্যাপিকা হিসেবে নিযুক্ত হলো। পরে ও বাংলায় Ph.D করলো।  আমাদের দুজনেরই বিয়ে হলো, আমি সংসার,  চাকরি করে আর দূরদর্শন ও আকাশবাণীর কাজ চালাতে পারলাম না, প্রায় ছেড়েই দিলাম। রূপাদিদি কিন্তু সময়ে সময়ে  চালিয়ে যাচ্ছিল। যখনই  দেখা হতো কোনো অনুষ্ঠানে, কি যে আদর করে ডাকতো, আর বলতো, “একদিন আয় না রে,… সারাদিন আমি আর তুই আগের মতো আড্ডা মারবো” আমিও যাবো যাচ্ছি করে আর যাওয়া হলো না। হীরাকাকু মারা যাবার পর গেলাম ওর নুতন অট্টালিকায়। আমাকে ওর নতুন বাড়ি পুরোটা  ঘুরে ঘুরে দেখালো , অনেকক্ষণ  ছিলাম সেদিন। এর একমাসের মধ্যেই ও এলো আমার ছেলের উপনয়নে। বললো,  অন্য কোনো নিমন্ত্রণ হলে আসতাম না, শুধু তোর বাড়ির অনুষ্ঠান বলেই এসেছি।  রূপIদিদি , দেবাঞ্জনদা ও সংহিতা একসাথে এসেছিল। এরপর আমার আর যাওয়া হয়নি ওর ওখানে, তবে ফোনে কথা হতো প্রায়ই।

সেদিন এই মর্মান্তিক খবর পেয়ে মনে হচ্ছিল আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।  সব স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসছিল। ওকে নিয়ে past tense এ কিছু লিখতে হবে, ভাবতেই পারছি না। ওর কথা ভাবলেই বুকে খুব ব্যথা হয় । ওর হাসিমুখটা শুধু চোখে ভাসে।

 

 

কতো গুণী ছিল আমার রূপাদিদি,  মিষ্টি চেহারা, ঝলমলে কথার বাহার, অপূর্ব সঞ্চালনা, অতি অমায়িক একজন শিল্পী।  অতি অল্প সময়েই সবার সাথে মিশতে পারতো।খুব আন্তরিক ছিল , সবাইকে আপন করে নেবার ক্ষমতা ছিল ওর। ওর ব্যাপারে “ছিল”  (past tense)বলতে খুব কষ্ট  হচ্ছে। জানি না আর কত অকাল মৃত্যুর সংবাদ আমাদের সহ্য করতে হবে। শিলচর মেডিক্যাল কলেজের এর আইসিইউ’তে এগারো দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অবশেষে আমার এই দিদি সত্যি সত্যিই না ফেরার দেশে চলে গেল..আর কোনোদিন ওকে আর দেখবো না… ভাবতে পারছি না ।
রূপাদিদি, যেখানেই থাকো খুব ভালো থেকো , এছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমার।

তুমি আমার হৃদয়ে সারাজীবন সজীব হয়ে থাকবে।  আবার তোমার সাথে দেখা হবে একদিন। শুধু পরমপিতার  কাছে একটাই জিজ্ঞাসা,হে ঈশ্বর, তোমার এই কি বিচার?কিছুতেই  মানতে পারলাম না……কিছুতেই না!

( লেখিকা পেশায় একজন শিক্ষিকা। তাছাড়া সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।)

Comments are closed.