ভারতবর্ষে ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়। ক্রিকেট যেন একটা ধর্ম। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কত আবেগ। সারা বিশ্বের কাছে ভারত মানেই ক্রিকেটের দেশ। এদেশে জাতীয় দলের তারকারা সুপারস্টার এর সম্মান পেয়ে থাকেন। আর আই পি এল এসে যাওয়ার পর থেকে তো শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বে ক্রিকেটের চেহারাটাই বদলে গেছে। এখন ক্রিকেটে প্রচুর অর্থ। আগের তুলনায় এখন ভারতীয় ক্রিকেটে প্রচুর টাকা। এখন অনেকেই রয়েছেন যারা এই খেলাটা দিয়েই নিজের সংসার চালাচ্ছেন। এটা একটা বাস্তব। তবে এই বাস্তবের আরও একটা দিক রয়েছে। ভারতের মতো ক্রিকেট পাগল দেশে এমন প্রচুর খেলোয়াড়ও রয়েছেন যারা ক্রিকেটের জন্য নিজের সবকিছু দিয়েও অর্থের অভাবে ভুগছেন। একাধিকবার রাজ্য দলের প্রতিনিধিত্ব করেও তাদের কপালে একটা সরকারি চাকরি জুটছে না। এমনই একজন হলেন শিলচরের তারকা ক্রিকেটার রাজু দাস।
শুধু জেলাস্তরে নয়, গোটা বরাক উপত্যকার অন্যতম সফল ক্রিকেটার রাজু। বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে রাজ্য দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাও এক দুবার নয়, একাধিকবার। ছিলেন রনজি দলের ট্রায়াল’ ক্যাম্পেও। কিন্তু এত সবের পরও রাজুর কপালে জোটেনি স্পোর্টস কটায় একটা সরকারি চাকরি। রাজুর পরিবার আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নয়। এরমধ্যে মহামারী করোনা যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে রাজুকে এবার একটি গ্যাস এজেন্সির ডেলিভারি বয়ের কাজ করতে হচ্ছে।
স্কুল ক্রিকেট দিয়ে শিলচরের ক্রিকেটে নিজের সফর শুরু করেছিলেন ডানহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান রাজু। বৈদ্যনাথ নাথ স্কুল ক্রিকেটে পাবলিক স্কুলের হয়ে বেশ নজর কেড়েছিলেন তিনি। তৃতীয় ডিভিশনে বিলপাড়ের মন্দির দিঘীরপার ক্লাবের হয়ে খেলেও নজর কাড়েন রাজু। সে ছিল ডিভিশন ক্রিকেটে তার সফরের শুরু। এরপর ধাপে ধাপে দ্বিতীয় ডিভিশন এবং প্রথম ডিভিশনের দলগুলোতেও স্থান করে নেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে গণসুর ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। ২০০২-০৩ মরশুমে আসাম দলের অনূর্ধ্ব ১৫ এক্সপোজার ট্যুরে গাজিয়াবাদ গিয়েছিলেন রাজু। সফরে ভালো পারফর্ম করেছিলেন তিনি। যার ফলে ডাক পেয়ে যান অনূর্ধ্ব ১৫ রাজ্য দলেও। তবে মেডিকেল টেস্টে আটকে যান।
এরপর অনূর্ধ্ব ১৭ আসাম দলের হয়ে দুবার বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে খেলেন। অনূর্ধ্ব ১৯ রাজ্য দলের জার্সি গায়ে বিনু মাঁকড় ও কোচবিহার ট্রফিতেও খেলেছেন শিলচরের ডানহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব ২৩ রাজ্য দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু এত সবের পরও আজ পর্যন্ত রাজুর কপালে স্পোর্টস কোটায় একটা সরকারি চাকরি জুটেনি। এমনটা নয় যে রাজু প্রাইভেট চাকরি পাননি, তবে সমস্যা হচ্ছে, প্রাইভেট চাকরি করলে তাকে ক্রিকেট ছাড়তে হবে। আর কোনোভাবেই ক্রিকেট ছাড়তে রাজি নন রাজু। কারণ এই খেলাটাকে তিনি খুবই ভালোবাসেন। এর সঙ্গে তার অনেক আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। রাজু বলেন, ‘দেখুন, প্রাইভেট সেক্টরে চাকুরি করলে আমায় ক্রিকেট ছাড়তে হবে। কারন দুটো একসঙ্গে করা যাবে না। আর আমি ক্রিকেট ছাড়তে পারবো না। রোশনি গ্যাস এজেন্সি তে একজন ডেলিভারি বয়ের কাজ করছি। এজেন্সির কর্ণধারের ছেলে তথা আমার বন্ধু শিবজ্যোতি রায় আমায় এই চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই চাকরি টা করায় আমায় ক্রিকেট ছাড়তে হবে না। সঙ্গে পরিবারের জন্য কিছু অর্থ রোজগার করতে পারব।’
রাজুর আশা ছিল, একাধিকবার রাজ্য দলের প্রতিনিধিত্ব করায় স্পোর্টস কটায় একটা সরকারি চাকরি পেয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আশা করেছিলাম স্পোর্টস কটায় কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একটা সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে ক্রিকেট টা চালিয়ে যেতে পারতাম। আমি এই খেলাটাকে খুবই ভালোবাসি। তাই যতটুকু সম্ভব চালিয়ে যেতে চাই।’
রাজ্য দলের জার্সি গায়ে বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে যতটুকুই সুযোগ পেয়েছেন, ভালো পারফর্ম করেছেন রাজু। যার জন্য সিনিয়র রনজি দলের ট্রায়ালেও ডাক পেয়েছিলেন। শিলচরের এই প্রতিভাবান ক্রিকেটার কে শুধু আর্থিক মন্দার সঙ্গে নয়, লড়াই করতে হয়েছে চোট সমস্যার বিরুদ্ধেও। ২০১৭ সালে রনজি দলের এক প্রস্তুতি ম্যাচে ফিল্ডিংয়ের সময় কাঁধে চোট পেয়ে যান রাজু। সেই সময় তিনি গুয়াহাটিতে থাকতেন। সেখানকার সিটি ক্রিকেট ক্লাবে কোচিং নিতেন। দিসপুরের সেই ক্লাবটিতে রাজুকে ফ্রিতে কোচিং দিতেন গৌতম হাজারিকা। তবে কাঁধে চোট পাবার পর অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। চোট পাওয়ার পর তাকে অসম ক্রিকেট সংস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন শিলচরের আরো এক তারকা তথা রনজি ক্রিকেটার প্রীতম দাস। চোট গুরুতর থাকায় অসম ক্রিকেট সংস্থার পক্ষ থেকে রাজুকে গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে তাকে দিল্লির এইমস-এ রেফার করা হয়। সেই সময় গুয়াহাটিতে শিলচরের প্রাক্তন বিধায়ক দিলীপ পাল রাজুকে কিছুটা আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। গুয়াহাটি থেকেই শুরু হয় রাজুর রিহ্যাব প্রক্রিয়া। রিহ্যাবে থাকাকালীন রাজুকে অনেক ঝড় ঝাপটা পেরোতে হয়েছে। তবে নিজের লড়াকু মানসিকতার জোরে সবকিছু পেরিয়ে চোট সারিয়ে ওঠেন ডানহাতি তারকা।
চোট সারিয়ে উঠলেও নতুন করে সমস্যা দেখা দেয় রাজুর কাঁধে। ব্যাটিংয়ের সময় সমস্যা না হলেও ফিল্ডিংয়ে থ্রো দিতে গেলে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। ফলে আরো একবার তাকে চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হতে হয়। তারা পরামর্শ দেন সমস্যাটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। তবে এ জন্য দরকার পড়বে একটা সার্জারির। যার খরচ পড়বে প্রায় আড়াই তিন লক্ষ টাকা। এমন একটা সময়েও ক্রিকেটেই ভরসা রাখছেন রাজু। তিনি জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে শিলচরের ইন্ডিয়া ক্লাবের সঙ্গে তার একটি মৌখিক চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুসারে আগামী দু মরশুমে তিনি ইন্ডিয়া ক্লাবের হয়ে খেলবেন। এর বিনিময়ে তাকে এক লক্ষ টাকা দেবে ইন্ডিয়া ক্লাব। সার্জারিতে সাহায্যের জন্য শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থাতেও একটি চিঠি দিয়েছেন রাজু। তিনি জানান সংস্থার সচিব বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। এছাড়া তার সার্জারির জন্য নাকি শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে আসাম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কে ই মেইল ও করা হয়েছে।
এ তো ছিল শিলচরের এক রাজুর গল্প, তবে ভারতীয় ক্রিকেটে এমন অনেক রাজুই রয়েছেন যারা আইপিএলের যুগেও নিজেদের পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক কষ্টে ক্রিকেট চালিয়ে গেলেও সংসার চালাতে পারছেন না। ক্রিকেটপাগল ভারতবর্ষে এটাও কিন্তু একটা বাস্তব। কঠিন বাস্তব।
Comments are closed.