
শিলচরে প্রতি ১০জন বাইক চালকের মধ্যে ১জন হেলমেট পড়েন, 'নো হেলমেট-নো পেট্রোল' শুধুমাত্র পোস্টার!
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বিউরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে উত্তর-পূর্বের সবথেকে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অসমে। অসমের মোট ৩২৪৫টি মৃত্যুর তুলনায় ত্রিপুরায় সেই বছর ২৭১টি মৃত্যু হয়েছে যা উত্তর-পূর্বের দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মেঘালয়, এখানে ১৭৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। অসমের ৩২৪৫টির মধ্যে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ মৃত্যুর কারণ দ্বিচক্রযান দুর্ঘটনা। এর মুখ্য কারণ হচ্ছে মদ্যপ অবস্থায় বাইক চালানো এবং হেলমেট না পরা। অথচ সমীক্ষা বলছে, শিলচর শহরের দশজন বাইক চালকের মধ্যে শুধুমাত্র একজন হেলমেট পরে চালান। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখের সামনে রয়েছে।
কিছুদিন আগে শিলচর শহরের রাস্তায় বাইকে ওড়না ফেঁসে গিয়ে রাস্তায় পড়ে মারা গিয়েছিল আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। তার মাথায় হেলমেট থাকলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেত। এমন ঘটনা অতীতে আমাদের চোখের সামনে অনেক হয়েছে, তবে এর প্রভাব কোনোভাবেই বাইক চালকদের ওপর পরে না।
মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট ১৯৮৮ এর মতে কোন ব্যক্তি হেলমেট বা হেডগিয়ার ছাড়া প্রকাশ্যে যানবাহন চালালে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে প্রশাসন। ইউনাইটেড নেশনের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া প্রত্যেক ১০ জনের মধ্যে অন্তত চারজন দ্বিচক্রযান দুর্ঘটনায় মারা যান এবং তাদের মাথায় হেলমেট বা হেডগিয়ার থাকে না।
শহরের প্রায় প্রত্যেকটি পেট্রোলপাম্পে ‘নো হেলমেট নো পেট্রোল’ বোর্ড লাগানো রয়েছে, বলা হচ্ছে হেলমেট না থাকলে পেট্রোল ডিজেল ইত্যাদি দেওয়া হবে না। তবে এই স্লোগানটি শুধুমাত্র পোস্টারেই সীমিত, বাস্তব চিত্র অন্য কথা বলছে। অবশ্যই একসময় হেলমেট পড়ে পেট্রোল ডিজেল ইত্যাদি কেনার একটি প্রচলন তৈরি হয়েছিল। তবে অন্যান্য নিয়ম-নীতির মত এটিও শুধুমাত্র কাগজপত্রেই থেকে গেছে, বাস্তবে এর গ্রহণযোগ্যতা আর নেই। আমরা এভাবেই স্লোগানগুলো শুধু মনে রাখি, কিন্তু কাজে করে দেখাই না। অনেকেই বলেন সরকারের ‘দেবো না-নেব না’ নীতিও এখন শুধুমাত্র স্লোগান আর পোস্টারেই সীমিত, এর বাস্তবে কোনও গ্রহণযোগ্যতা আর নেই।
একটি সমীক্ষায় বলছে, শিলচর শহরে এনআইটি পয়েন্ট থেকে শুরু করে রংপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত চালকদের উপর নজরদারিতে দেখা গেছে, প্রায় নব্বই শতাংশ মোটরসাইকেল চালক হেলমেট পরেন না। তারা প্রত্যেকেই পেট্রোলপাম্প থেকে পেট্রোল অবশ্যই কেনেন। প্রথমদিকে পেট্রোলপাম্পে হেলমেট ছাড়া গেলে অন্য কোন ব্যক্তির হেলমেট নিয়ে পেট্রোল সংগ্রহ করেছেন একাংশ বাইক চালক। তবে এই নীতিও ধীরে ধীরে বদলেছে, এখন পেট্রোলপাম্পে হেলমেট ছাড়া পেট্রোল পাওয়া যায়।
হাইলাকান্দির জেলাশাসক মেঘ নিধি দাহাল একটি নীতি বানিয়েছিলেন যেখানে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে হেলমেট ছাড়া কোনও চালক পেট্রলপাম্প থেকে জ্বালানি দ্রব্য কিনতে পারবেন না। এতে কিছুটা হলেও জনমনে সচেতনতা গড়ে উঠেছে। সেখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, সরকারের স্বীকৃতি সম্মত আইএসআই মার্কা হেলমেট প্রত্যেক চালককে পরতেই হবে, অন্যথায় তারা জ্বালানি কিনতে পারবেন না। তবে কাছাড় জেলায় শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমের কাছে বড় বড় কমেন্ট দেওয়া ছাড়া আর কোনও নীতি বানানোর কাজ হয়নি।
এব্যাপারে কাছাড়ের ডিডিসি জেসিকা রোজ লালসিমের বয়ান, “আমরা স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছি কোনও পেট্রোল পাম্পে হেলমেট ছাড়া চালকদের জ্বালানি দ্রব্য বিক্রি করা চলবে না, তবে দেখা গেছে চালকরা পেট্রোল পাম্পের কর্মীর সঙ্গে এব্যাপারে ঝগড়া করেন, অনেকেই ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করেন। একসময় নিরীহ কর্মীরা এতে ভয় পেয়ে পেট্রোল বিক্রি করতে বাধ্য হয়।”
একই সুরে জেলাশাসক কীর্তি জল্লি বলেন, “আমাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে খবর এসেছে পেট্রোলপাম্পের নিরীহ কর্মীরা চালকদের কাছে হেনস্থা হয়েছেন। তারা বারবার হেনস্থা হওয়ার পর এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা যদি কড়া নির্দেশ জারিও করি, প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিরীহ পেট্রোল পাম্প কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। এসব ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠতে হবে, না হলে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।”
তিনি মনে করেন, হেলমেট না পরলে চালকদের উপর বড় অঙ্কের ফাইন বসালে হয়তো কিছুটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি বলেন, “আমরা বারবার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি, সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তবে এতে যদি কাজ না হয় তাহলে কেউ নিয়ম ভাঙলে তার কাছ থেকে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করতে হবে, এতে সচেতনতা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। তবে হঠাৎ করে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আলোচনার মাধ্যমেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
বারবার পেট্রোলপাম্পের কর্মীরা হেনস্থা হওয়ার পর একসময় মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রশাসনের একটি বৈঠক হয়। এতে নানান কথা উঠে আসে, পুলিশের পক্ষ থেকে মালিকদের জানানো হয় তারা যেন কোনওভাবেই হেলমেট ছাড়া কোনও চালককে জ্বালানিদ্রব্য বিক্রি না করেন। তবে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে এই নীতি লাগু করা সম্ভব নয়, এমনটাই মনে করেন পেট্রোল পাম্পের মালিকরা।
Comments are closed.