এনআরসি দাবি-আপত্তি পেশের অন্তিম তারিখ ঘনিয়ে আসছে, 'লক্ষ্মী'রা এখনো সেই তিমিরেই
লক্ষ্মী আমার ঘরে গৃহপরিচারিকার কাজ করে। এনআরসির আবেদনে সে যে লিগ্যাসি ডাটা জমা দিয়েছিল তা বাতিল হয়ে গেছে। আবেদন পেশ করার আগে সাইবার ক্যাফেতে লাইনে দাড়িয়ে বাবা আর দাদুর নাম বলে ১০০ টাকা দিয়ে যে লিগ্যাসি ডাটা হাতে পেয়েছিল, সেটাই আবেদনের সাথে জমা দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই লিগ্যাসি ডাটা ওদের ছিল না। সাইবার ক্যাফের ছেলেটা শুধু বাবার নাম আর দাদুর নাম মিলিয়ে লিগেসি ডাটা প্রিন্ট করে দিয়েছিল, কিন্তু ওদের বাকি তথ্যগুলো পরীক্ষা করে নি; স্বাভাবিকভাবেই তা বাতিল হয়ে যায়। খসড়া তালিকায় এবং চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় নাম না উঠায় মরিয়া প্রয়াসে নির্বাচন অফিসে ৩০০ টাকা কোন মহিলাকে যেন দিয়েছিল, ভোটার লিস্টে ওদের নাম বের করে দেওয়ার জন্য, ফল শূন্য।
এবার লিগ্যাসি ডাটা খুঁজে দেখার ওয়েবসাইট খুলতেই ওর বাবার সঠিক লিগ্যাসি ডাটা খুঁজে বের করলাম। কিন্তু এটা তো আর কোনো কাজে আসছে না এখন। কারণ দাবি-আপত্তি পেশের সময় নতুন কোন লিগ্যাসি ডাটা জমা দেওয়া যাবেনা না। ওদের কস্মিনকালেও কোন জায়গা জমি ছিল না; পোস্ট অফিস, এলআইসি সেগুলো তো দূরে থাক। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওর দাদুর বাবা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে এই দেশে এসেছিলেন ঠিক স্বাধীনতার পরে পরেই । এখানে এসে কোন কিছু সুবিধা করতে না পেরে বাজারে পাঠা-খাসির মাংস বিক্রি করতেন। দাদু ষাটের দশকে স্থানীয় ইন্ডিয়া ক্লাবে চৌকিদার হিসেবে কাজ করেছিলেন। বাবা রিক্সা চালাতেন, এখন প্রায় পঙ্গু হয়ে বাড়িতে বন্দি। লিগ্যাসি ডাটা পাল্টানো যাবে না, এই ব্যাপারটা লক্ষ্মীকে বুঝিয়ে বলতেই ও অসহায় ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে এখন আমরা কি করবো? আসলে উত্তরটা আমার জানা নেই, কারোরই বোধ হয় জানা নেই । এখন লক্ষ্মী আর তার মা, বাবা, বোনের কি হবে ! ওদেরকে কি ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলা দেওয়া হবে? সমস্যাটা শুধু লক্ষ্মীর নয়, এরকম আরও লক্ষাধিক লক্ষ্মী আছে।
সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা এসওপি কে মান্যতা দিল। তাতে হতভাগ্য বাঙালিরা খুব একটা লাভবান হবেন না কারণ আগে ভুলবশত যারা লিগ্যাসি জমা করেছেন, তাদের রাস্তাটা অবরুদ্ধই থেকে গেল। লিগ্যাসি সংক্রান্ত ভুল সংশোধনের সুযোগটা দেওয়া উচিত ছিল। কেন্দ্রের এই ‘এসওপি’তে মূলত হিন্দি ভাষাভাষীরা লাভবান হবেন, বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা অবিভক্ত ভারত) থেকে আসা হতভাগ্যরা, যারা একটা প্রামাণ্য নথির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, তাদের খুব একটা উপকারে আসছে না। তবে, যাদের সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট, রিফিউজি সার্টিফিকেট বা উদ্বাস্তু ত্রান পাওয়ার কোনো নথি আছে তারা এই ক্ষেত্রে উপকৃত হবেন। যেসব বাচ্চার বার্থ সার্টিফিকেট খারিজ হয়ে গিয়েছে তারাও দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারবেন, কারণ তাদের টিকাকরণের প্রমাণপত্র এবং রেশন কার্ডকে লিংক ডকুমেন্ট হিসেবে গণ্য করা হবে। তাছাড়া ১৪ বছরের নিচের বাচ্চাদের লিংকেজ ডকুমেন্ট না থাকলেও বিশেষ শুনানির ব্যবস্থা থাকবে।
তবে, এনআরসি-ছুট চল্লিশ লক্ষের মধ্যে কতজন সকল বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকায় নাম ওঠাতে সক্ষম হবেন তা এখনো অনুমানের বিষয়। তারপরে হাতে থাকবে ‘লক্ষ্মী’র মত এনআরসি-ছুট সেই লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ, যারা নাম উঠাতে সক্ষম হবেন না, যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চলবে রাজনীতির পাশাখেলা।
Comments are closed.