বছর ঘুরে এলো, নমামি বরাক কি দিল বরাককে!
গত বছর এই ১৮ নভেম্বর তারিখ থেকে তিন দিন ধরে চলল ‘নমামি বরাক’ ; নদীর তীরে তীরে আরতি হল, মাঠে মাঠে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে অনেক অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল বিভিন্ন ভাষা, জনগোষ্ঠীর , নামীদামী শিল্পীরা এসে শান বাড়িয়ে দিলেন, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের হাঁট বসে গেলো, মায় শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিও এসে গেলেন। বরাকের মানুষ তিন দিন ধরে বেশ উৎসবের মেজাজেই মজা করে কাটালেন। অনেকেই ভেবেছিলেন তেমন জমবেনা এই উৎসব, তাই লোক ও হবেনা, মাঠ গুলো ফাঁকাই থাকবে ; কিন্তু উল্টোটাই হয়েছিল – বিশাল বিশাল মাঠগুলো যেন অনেক ছোট হয়ে গিয়েছিল। রাতারাতি ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট ঝাঁ চকচকে হয়ে উঠল।
বরাক উপত্যকার জীবনরেখা বরাক নদিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের সাথে সাথে বরাক উপত্যকার ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি তথা বরাকের কৃষ্টি, সংস্কৃতির বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার প্রয়াসে এই নমামি বরাকের আয়োজন করা হয়েছিল। তিন দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী সোনোয়াল বলেছিলেন,
‘নমামি ব্রহ্মপুত্র’ এবং ‘নমামি বরাক’ পালা করে এক বছর পর পর অনুষ্ঠিত হবে। তা এ বছর তো নমামি ব্রহ্মপুত্র আয়োজন হল না, নদী পূজার অনুষ্ঠান বোধহয় এখানেই ইতি। তা ‘নমামি বরাকে’র এক বৎসর পর আমরা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করতেই পারি।
এই উৎসবের সাত দিন আগে এক অবাঙ্গালি ব্যাঙ্ক আধিকারিককে নমামি বরাকের বিষয়ে জিগ্যেস করাতে উনি বলেছিলেন যে, এই বিষয়ে শুনেছেন কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কি জানেননা। উনাকেই অনুষ্ঠানের ঠিক আগের দিন একই প্রশ্ন করায় উত্তর দিয়েছিলেন “বরাকের রাস্তাঘাট ঠিক হচ্ছে,নাচ গান হবে (আমাদেরকেও ডেকেছে) সঙ্গে নদীর পুজোও হবে।”
বরাকের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনদিন উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। এই সাফল্যের পরেও বিতর্ক কিন্তু কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না ।বিতর্ক শুরু হয়েছিল শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদারকে থিম সঙ থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে , তারপর চলল রাস্তাঘাটের কাজের মান নিয়ে এবং সবশেষে এই পাঁচ কোটি বাজেটের উৎসবের প্রাপ্তি নিয়ে। থিম সঙ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে, শিল্পীকে বাদ দেওয়া হলেও সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে থিম সঙের ভিডিওটি জনগনের কাছে ইতিমধ্যে পৌঁছে যায়, যেটাতে শুভ প্রসাদও সামিল ছিলেন, কিছুটা ছন্দপতনের শুরু সেই থেকেই।
কথা ছিল খনন করে বরাক নদীর নাব্যতা বাড়ানো হবে, যাতে সারা বছরই জাহাজ চলাচল করতে পারে, নদী খননের জন্য এসেছিল ড্রেজার। জলের কম্পনে শিববাড়ি অঞ্চলে শুরু হল বাড়িতে ফাটল ধরা, বন্ধ হলো সেখানে খনন। তারপর বর্ষায় নদীর জলের তোড়ে ভেসে গেল পাইপ রানীঘাট অঞ্চলে, এখন নদীর গভীরতা বৃদ্ধির প্রয়াস প্রায় স্থগিত। রাস্তাঘাটের প্রসঙ্গে বলা যায়, রাস্তার কাজ এখনো মোটামুটি চলছে। শিলচর-করিমগঞ্জ, শিলচর-কুম্ভীরগ্রাম প্রভৃতি সড়কে ভালোই কাজ হচ্ছে। শিলচর-কালাইন সড়কের কাজ শুরু হয়েছে। তবে পরিমল শুক্লবৈদ্য বিভাগীয় মন্ত্রী থাকাকালীন যে গতিতে কাজ চলছিল তা অনেকটাই স্তিমিত।
নমামি বরাকের কথা উঠলেই কাগজ কলের প্রসঙ্গও উঠে আসে। সকল যুক্তিতর্ককে দূরে সরিয়ে রেখে কাগজ কলের কর্মচারীরাও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে নমামি বরাক উৎসবে যোগদান করেছিলেন, আশ্বাসিত হয়েছিলেন। আসামের কাগজ কল দুটোর বর্তমান হাল-হকিকত সবারই জানা, আগামী ২২ নভেম্বর বরাক বনধ ডাকা হয়েছে। নমামি বরাকের অনুষ্ঠানে বিভাগীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেছিলেন, “ফেসবুকে আপনারা যে রকম দেখেন রিলেশনশিপ- কমপ্লিকেটেড, সেরকম কাগজ কলের ব্যাপারটাও ‘কমপ্লিকেটেড'”। তা ঐ কমপ্লিকেটেড অবস্থা থেকে এখন প্রায় ধ্বংসের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে কাগজ কল দুটো, অবশ্য সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আর বরাকের কৃষ্টি-সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে পৌঁছানো সম্বন্ধে বলা যায়, বরাকের বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর কৃষ্টি সংস্কৃতি এখন দিসপুর পর্যন্ত পৌঁছানোই মুশকিল হবে। বাঙালি শিল্পীর অনুষ্ঠান নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কিত ঘটনাই তার প্রমান।
বরাক চিরদিনই বঞ্চিত, অবহেলিত – তাই সামান্য কিছু একটা পেলেই আমরা আহ্লাদিত হই । ওই অবাঙালি ভদ্রলোক অনেকটা উনার মতো করে ঠিকই বলেছেন। নাচ গান হয়েছে, বরাকের পুজোও হয়েছে তবে আসল প্রাপ্তি বোধ হয় একটাই, রাস্তাঘাটের কিছুটা হলেও উন্নতি।
Comments are closed.