কপিল মুনির সাধন-পীঠস্থান সিদ্ধেশ্বর শিববাড়ি নিয়ে কিছু কথা
সিদ্ধেশ্বর শিববাড়ি। বরাক উপত্যকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের এমন মানুষ মেলা ভার হবে যিনি বদরপুর ঘাটে অবস্থিত এই শিবমন্দিরে পূজা দেননি। শুধু বরাক উপত্যকা কেন আশেপাশের অনেক জায়গা এমনকি বিদেশ থেকেও ভক্তরা বরাক পারের এই মন্দিরে পূজা দিতে আসেন। বারুনি স্নান কিংবা শিব চতুর্দশী বাদ দিলেও সাধারণ সোমবারগুলোতেও শিব ভক্তদের সংখ্যা নেহাত কম হয় না। ধর্মীয় স্থান হিসেবেতো বটেই বরাক পারে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত এই মন্দিরের শান্ত পরিবেশ অশান্ত মনকেও শান্ত করে তুলতে সমর্থ। বহু প্রাচীন এই মন্দিরের একটা সুন্দর কাহিনীও রয়েছে। ইন্টারনেটেও এই মন্দির ঘিরে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সে তথ্যগুলো কতটা সত্য সে বিষয়েও অনেকের সন্দেহ থাকতে পারে। তাই এমন সংশয়ের বিষয়টি এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তীর কাছে উত্থাপন করতেই জানা গেল পৌরাণিক এক কাহিনী, অনেক অজানা কথা। প্রথমে এই অঞ্চলটি পুরোপুরি জঙ্গল ছিল। আমাদের অনেকেরই জানা, বহুকাল পূর্বে কপিল মুনি বলে এক ঋষি ছিলেন। উনার বাবার নাম করদম ঋষি, মায়ের নাম দেবাহুতি। একসময় তিনি এই স্থানে আসেন এবং শিবের ধ্যান করতে শুরু করেন। সেই ধ্যানে তুষ্ট হয়ে শিব তার সন্মুখে প্রকট হন বলে জানা যায়।
এর বহু কাল পরের কথা, গনেশ গিরি নামে এক সন্ন্যাসী হিমালয়ে ছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন যে এই স্থানে অর্থাৎ বর্তমান সিদ্ধেশ্বর শিব বাড়ির স্থলে কারোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব প্রকট হয়েছিলেন এবং এরপর এখানে শিব লিঙ্গ স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর কোনও পূজা অর্চনা নেই, এমন কি কোনও মানুষ জনও নেই। গনেশ গিরি সন্ন্যাসী সেই স্বপ্নকে অনুসরণ করে এই স্থানে আসেন। এসে সত্যি সত্যি এইখানে শিব লিঙ্গের সন্ধান পান। তিনি শিবের পুজার্চনা করতে শুরু করেন।তখন এইখানে কেবল একটি নদী ছিল আর সব জায়গা জঙ্গলে ভরে ছিল। জনবসতি বলতে কিছু ছিল না। শুধু বদরপুরের শ্রীগৌরীতে কিছু মানুষের বসতি ছিল।
ওইখানের একজন মহাজন এদিকে ঘুরতে এসে এই সন্ন্যাসীকে দেখেন। কৌতুহল বশে সন্ন্যাসীর কাছে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তিনি সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করেন শ্রীগৌরীতে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ ওই রাতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। সন্ন্যাসী যেতে রাজি হননি এই বলে যে সন্ন্যাসী কারো ঘরে রাত কাটাতে পারেন না। মহাজন এরপর ঘরে ফিরে যান। কিন্তু ঘরে ফিরে তিনি মোটেই শান্তি পাচ্ছিলেন না বরং ভীষনভাবে ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ সে রাত্রে সত্যি সত্যি ভীষনভাবে ঝড় তুফান বৃষ্টি হয়েছিল। তিনি শান্তি না পেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার ফিরে আসেন সন্ন্যাসীর কাছে। এসে দেখেন সন্ন্যাসী গাছের নীচে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। তার উপরে একটা কম্বল এবং নীচে একটা কম্বল। এত বৃষ্টি হয়েছে অথচ কম্বল দুটো শুকনো। তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান এবং তাঁর মনে সন্ন্যাসীর প্রতি খুব শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। তিনি সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করেন তাঁকে দীক্ষা দেওয়ার জন্য। এরপর গনেশ গিরি সেই মহাজন অর্থাৎ বিষ্ণু প্রসাদকে তাঁর স্বপ্নের কথা জানান, যে বহুকাল আগে এখানে কপিল মুনি শিবের ধ্যান করার পর শিব প্রকট হয়েছিলেন। এরপর কপিল মুনি এখানে শিব লিঙ্গ স্থাপন করেন।
সেই শিব লিঙ্গটি সন্ন্যাসী বিষ্ণু প্রসাদকে দেখান। তখন তিনি নিজে সন্ন্যাসীকে বলেন, “ আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?” সন্ন্যাসী তাঁকে উত্তর দেন, “এখানে একটি মন্দির স্থাপন কর এবং আমিও সবাইকে জানাব এই কপিল মুনির পীঠস্থানের কথা”। তারপরেই বিষ্ণু প্রসাদ চৌধুরী প্রথম মন্দির স্থাপন করেন। শিব লিঙ্গের জায়গা খোদাই করে যখন বেদির আকৃতি দেওয়া হয় তখনই দেখা গেল শিব লিঙ্গের নিচে একটা পুষ্পপাত্র রয়েছে।যা থেকে জানা যায় শিবের সঙ্গে কপিলমুনির কথোপকথন, কোনদিন শিব প্রকট হয়েছিলেন ইত্যাদি। জানা যায়, শিব প্রকট হয়েছিলেন চৈত্র মাসের মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী শতবিশা নক্ষত্র তিথিতে। ওই তিথি উপলক্ষে বারুনি স্নান ও তর্পণে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এদিকে তারপরে সন্ন্যাসী গণেশ গিরি দেহত্যাগ করলে এখানে তাঁর সমাধি দেওয়া হয়। উনার পরে তাঁরই এক শিষ্য মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবেই একের পর এক শিষ্য মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে। সর্বশেষ সন্ন্যাসী ছিলেন লছমন গিরি। তাঁর পরে আর কোনো সন্ন্যাসী ছিলেন না। ১৯৪৯ সাল থেকে পুরোহিত দ্বারা মন্দির পরিচালিত হচ্ছে। প্রথম পুরোহিত ছিলেন হরি সাধন চক্রবর্তী। সর্বশেষ সন্ন্যাসী লছমন গিরি থাকা অবস্থায় প্রায় পনেরো বছর হরি সাধন চক্রবর্তী পৌরোহিত্যের কাজ করেছেন। বর্তমানে হরি সাধন চক্রবর্তীর পুত্র শ্যামল চক্রবর্তী পুরোহিত হিসেবে মন্দিরে রয়েছেন।
পুরো ভারতবর্ষ তথা কখনও কখনও বিদেশ থেকেও ভক্তরা আসেন এখানে পুজো দিতে।এমনিতে সব দিন ভক্তের সংখ্যা সমান হয় না। কখনও হাজার মানুষের ভিড়, কখনও বা কুড়ি পঁচিশ এর মত ভক্ত সমাগম হয়। কিন্তু শ্রাবণ মাসের সোমবারে বৃহৎ সংখ্যায় ভক্ত সমাগম ঘটে। চৈত্র মাসের মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী শতবিশা নক্ষত্র তিথিতে অনুষ্ঠিত বারুনি স্নানে সব চাইতে বেশি ভিড় হয়। অনুমেয় দেড় দুই লক্ষ লোক বারুনিতে স্নান, তর্পণ সেরে মনের বাসনা পূর্ণ করেন। সে সময় এই স্নান উপলক্ষে নদীর ওই পারে বিরাট করে বারুনি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শিব ভক্তদের মধ্যে বারুনি স্নান থেকে শুরু করে মেলায় অংশগ্রহণ সব কিছতেই প্রচুর উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়। ভক্ত সমাগমের দিক থেকে এর পরই উল্লেখ করতে হয় শিব চতুর্দশীর কথা। এদিনও বৃহৎ সংখ্যায় শিব ভক্তরা বাবার মাথায় জল দুধ বেলপাতা চড়িয়ে বাবাকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াসে ব্রতী হন। বাবার আশীর্বাদ-ধন্য হওয়ার অভিলাষায় এই শিব বাড়িতে সমবেত হন।
পরম শ্রদ্ধায় এই মন্দিরে পূজা দেওয়ার ফাঁকে অতি প্রাচীন এই মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানার আগ্রহ আমার মত হয়ত আরও অনেকেই মনে পুষে থাকবেন। বর্তমান পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তীর কাছ থেকে শিব বাড়ি প্রতিষ্ঠায় পৌরাণিক কাহিনী জানার পর, যাদের এনিয়ে আগ্রহ রয়েছে তাদের মনের ইচ্ছে পূরণে তা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যই এ প্রয়াস। মন্দির ঘিরে এ কথন কতটা সত্যতা বহন করে সে বিষয়ে গবেষনা করবেন গবেষক কিংবা ইতিহাসবিদরা। বলা যেতে পারে শিব ভক্তরা এত চুলচেরা বিচারে না গিয়ে হয়ত নিজেদেরকে ডুবিয়ে রাখবেন ভক্তিরসে, কপিল মুনির সামনে শিবের প্রকট হওয়ার এ গাঁথায় বিশ্বাসের তরী বেয়ে ‘ভক্তিতে মুক্তি’ বিচারে ভক্ত আর ভগবানের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে।
Comments are closed.