কাব্যরসে ও আবৃত্তি বোধে সুরম্যের চলা ধ্বনিময় শব্দ ছন্দ নিয়ে: দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়
সুরম্য ছন্দবাসর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আবৃত্তি সৌধ শিল্পের প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্ণিত। কোনো এক ছন্দায়িত সন্ধ্যায় আমি, পঞ্চতপা চৌধুরী, আমাদের বর্তমান সম্পাদক সংহিতা পালের বাড়িতে বহু ভাবনা চিন্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন এবং অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে জন্ম দিলাম এই প্রতিষ্ঠানের, যেখানে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিছু আদর্শকে সামনে রেখে বাংলা কাব্য-সাহিত্যের রসে সিক্ত হয়ে বাক্ শিল্পের বিভিন্ন বিভাগে বিচরণ করে বিশেষ করে আবৃত্তিকে এক স্বতন্ত্র ও অনন্য শিল্প হিসেবে সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টায়। তাছাড়াও বাচিক শিল্পী হিসেবে কিছু দায়িত্ব পালন করার জন্য এই সংস্থার জন্ম দেওয়া।
এই ভাবনাকে সম্বলিত করে আমাদের নিজস্ব গোপন কিছু নান্দনিক উত্তরণের প্রচেষ্টায় পর পর চারটি বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছি বিশ্ব কবিতা দিবসকে (২১ মার্চ) কেন্দ্র করে। শুরু হয়েছিল যাত্রা আহমেদাবাদের কবিতা প্রেমীদের নিয়ে। সেখানেই এক সন্ধ্যায় কবিতার অনুষ্ঠান। যেখানে আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা আবৃত্তিকার পার্থ ঘোষ ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য সঙ্গে বাংলাদেশের খ্যাতনামা আবৃত্তি দল ‘তারুণ্যের উচ্ছাস’ এর আবৃত্তি বন্ধুরা ও চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবৃত্তিকার ও শিলচরের আমরা কবিতা প্রেমীরা ছিলাম। আমাদের একটা লক্ষ্য হল, যে সব রাজ্যে বাংলা ভাষা চর্চার তেমন কোনো প্রচলন নেই সেখানে বাংলা কবিতার বা শ্রুতিনাটকের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা। যে ধারা আগামীতে আমরা বজায় রাখব। আমাদের এও চিন্তা রয়েছে সমাজে পিছিয়ে পড়া প্রতিভাবানদের বাক্ শিল্পে প্রবেশ করিয়ে তাদের প্রতিভাকে বিকাশ করা। এরই ফলশ্রুতিতে শিলচরের একটি অন্ধ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়। আমরা চাই যে দেশের রাষ্ট্রভাষা শুধুমাত্র বাংলা, সেই বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্য-ভাষা প্রেমীদের নিয়ে আগামী কাজগুলো সম্পন্ন করা। আমরা সাংস্কৃতিক আদান প্রদানে বিশ্বাসী। বন্ধুত্ব গড়ার কাজে বিশ্বাসী। আমাদের আবাহন বা আহ্বান আছে কিন্তু নিরঞ্জন নয়। বেছে নিয়েছি বিশেষ করে আবৃত্তি শিল্পকে, কেননা এর মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের আসল ছন্দকে খুঁজে নিতে চাই, শুদ্ধ উচ্চারণের চর্চা চাই, কথা বলার এক অনিন্দ সুন্দর ভঙ্গি আয়ত্ত করতে চাই। যে হেতু সাহিত্যের শব্দ ধ্বনিময় হয় তাই বাচিক শিল্পীদের নিয়ে বাকশিল্পকে বাক্যের ছন্দস্পন্দে , অভিব্যক্তির উত্তাপে কন্ঠের মাধুর্যে নিজস্ব প্রকাশ ভঙ্গির আভিজাত্যে আমাদের কাব্য-শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতা দেখাতে চাই। প্রত্যেকের মনের ভেতরের রসবোধকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চাই। আমরা সুরম্য ছন্দবাসরের কর্মীরা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে পেতে চাই আনন্দিত মুহূর্তের সমর্থন, শোকার্ত মুহূর্তের সান্ত্বনা এবং পরাস্ত মুহূর্তের সাহস সঠিক স্বরক্ষেপনে,ছন্দবিভাজনে, কন্ঠচর্চার পদ্ধতিতে। চাই কবিতার ছন্দে ও তালে সারা কবিতা প্রেমীদের মধ্যে এক বিপ্লবের উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে। তাই আমরা তৈরী হচ্ছি আগামী আবৃত্তি কর্মশালা নিয়ে। আরও বহুবিধ পরিকল্পনা নিয়ে।
যে রাজ্যেই আমাদের মনের সঙ্গে মিল থাকা বন্ধুরা আছেন তারা চাইলেই আমরা কাব্যশিল্পে আলিঙ্গন করতে চাই। আমরা জানতে চাই, শিখতে চাই, দিতে চাই, নিতে চাই। আসলে সেই শাস্ত্রবাক্যটি সর্বদাই মনে পড়ে’ আবৃত্তিঃ সর্বশাস্ত্রানাং বোধাদপি গরিয়সি’। তাই তো অনুমোদন নিয়ে জড়িয়ে গেছি সর্বতারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। যার নাম ‘সুরনন্দন ভারতী’, মূল কার্যালয় কলকাতায়। আমরা প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মীরা এবার জোর কদমে এগিয়ে যেতে আরও কিছু সহযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তি করতে চাইছি। কেননা আমরা বিশ্বাস করি ‘ বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ সমস্ত বিশ্ব এক পরিবার। তার উপর আবৃত্তি শিল্প বাক শিল্প আমাদের দিচ্ছে পরিশীলিত ব্যক্তিত্ব, মনকে করছে উদার ও পবিত্র এবং রুচিশীল। তাই বেছে নিয়েছি পরম ব্রহ্মকে শব্দ রূপে, শব্দই আমাদের ব্রহ্ম, উচ্চারিত শব্দই আমাদের স্বরযন্ত্রের বা বাগযন্ত্রের কসরত। তাই দেখি বাস্তব -সত্য ও কাব্য-সত্যের পার্থক্য। চাই কাব্যের মূল কথা মূর্ততাকে Concreteness কে। সুরম্যের স্বপ্ন এক নিজস্ব ঐকতানে সর্বজনীনতার কাছে পৌঁছে যাওয়া। এই প্রেক্ষাপটেই আমরা প্রতিবছর আবৃত্তিকার, কবি ও সাংবাদিকদের গুণীজন সংবর্ধনা দিয়ে যাচ্ছি। গতবছর আমরা বিশেষ অতিথি শিল্পী হিসেবে পেয়েছিলাম রত্না মিত্র ও অমিত রায়কে। এ বছরও বাংলাদেশ ও কলকাতার শিল্পীরা অনুষ্ঠানে ভিন্ন মাত্রা এনে দেবেন এ প্রত্যাশা রাখি।
আমাদের আবৃত্তি বিষয়ক মুখপত্র ‘ সুরম্য’ প্রকাশিত হয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। আমরা আগামী বছর বহু ভাষা ভাষি বাচিক শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনায় রয়েছি। এবছর শিলচর বঙ্গভবনে ২১ মার্চ, বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ব কবিতা দিবসে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আসুন কবিতার হাত ধরে প্রাণের মিলন ঘটিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়াই।
ইতিমধ্যে সুরম্য আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটকের সিডি আত্মপ্রকাশ করেছে, আকাশবাণী শিলচর কেন্দ্রে কবিতার অনুষ্ঠান করেছে, বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রিত হয়ে সমবেত কবিতার অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও নানা অনুষ্ঠান করবার ডাক এসেছে । সব মিলে মিশে সুরম্য ছন্দবাসরের কর্মীরা বরাক উপত্যকায় বাক্ শিল্পের ভাবনায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে সকলের সহযোগিতা নিয়ে।
দ্রষ্টব্যঃ এই প্রবন্ধটি লিখেছেন সুরম্য ছন্দবাসর এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়. আপনারাও যদি আপনাদের কোন উদ্যোগ জানাতে চান তাহলে লিখুন: editorial@barakbulletin.com এ.
Comments are closed.