Also read in

“ কবিতা – আবৃত্তিতেই হয় ছবি তা”

‘আবৃত্তি’ নিয়ে কিছু কথা বলতে গেলেই, অন্তত: আমার চোখের সামনে, রবীন্দ্র কবিতাগুলি জ্বলজ্বল করে ওঠে।সকল কবিকে আমার শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি রবীন্দ্রকবিতা আমার কাছে একটু বেশি প্রাধান্য পায়। এর জন্য দায়ী কি রবীন্দ্রনাথ নিজে? যিনি বিশ্বাস করতেন কবিতা শুধু নিঃশব্দে পাঠ করার জিনিস নয়, পাঠ বা আবৃত্তির মাধ্যমেই তার প্রকাশ ঘটে | শুধু নিজস্ব ধারনা নয়, তাঁর কবিতাগুলিও সেভাবেই রচিত, কণ্ঠস্বর যেন সেগুলিতে খাপে খাপে বসে যায়। কবিগুরুর ভাবনা কোনও এক সময় তাঁরই বক্তব্যে ডানা মেলেছিল – “ফুল যেমন গাছের শাখায়, তেমনি কবিতাও আবৃত্তিকারের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়া তাহাকে বিশেষ সম্পদ দান করে।“

         বোঝা গেল কবিতা আর আবৃত্তিকারের নিবিড় সম্পর্ক সেই সুদূর অতীতেই তৈরী হয়েছিল। হ্যাঁ, হয়েছিল তো বটেই, নাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বা কখনো সখনো ‘ আবৃত্তিকার’ রবীন্দ্রনাথ হতে যাবেন কেন? ‘কবিকণ্ঠ’ শুনলে- একটা তথাকথিত ধারণা অর্থাৎ আবৃত্তিকারের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর হতেই হবে, ওটি ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। কী অসাধারণ তাঁর উচ্চারণ, কী দুরন্ত কণ্ঠস্বরের বৈচিত্রে কবিতার যতি চিহ্নের ব্যবহার! এসব তো একজন আবৃত্তিকারের কাছে পরম সম্পদ।

    রবীন্দ্র পরবর্তী অনেক কবি- সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা যেমন নিজ কবিতা নিজেরাই আবৃত্তি করেছেন, তেমনি অভিনেতারাও তখন আবৃত্তি করতেন (আজও অনেকেই করেন)। শিশিরকুমার ভাদুড়ী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কিংবদন্তী অভিনেতারা আবৃত্তির জগৎও শাসন করতেন- ইতিহাস তার প্রমাণ।

         এছাড়াও শুধুই আবৃত্তিকার হিসেবে বৃহত্তর বঙ্গ-সংস্কৃতির মান বাড়িয়েছেন যাঁরা – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র,শম্ভু মিত্র, কাজী সব্যসাচী, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নিলাদ্রী শেখর বসু, পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়রা আমাদের ‘আবৃত্তি ভালোলাগার’ পরিসরকে আরো এবং আরো বিস্তৃত করেছেন।

        এইখানে এসে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধে। বলতে দ্বিধা নেই যত অনায়াসে উপরোক্ত নামগুলো এক নিশ্বাসে বলতে পারছি তত সহজে আজকের প্রজন্মের আবৃত্তিকারদের নাম মনে আসছে না । সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভন সুন্দর বসু বা মেধা বন্দ্যোপাধ্যায় বাদ দিলে আর আর নাম বলতে স্মৃতি হাতড়াতে হয় – কেন?

    

Manoj Kanti Dev

 বৃহত্তর বঙ্গ সংস্কৃতির জগৎ থেকে চোখ ফেরাই ঈশাণ বাংলা অর্থাৎ বরাক উপত্যকায়। এখানেও সুনীল রায় চৌধুরী, সানু ভৌমিকদের মতো অনেক মঞ্চ অভিনেতাদের আবৃত্তি করতে দেখেছি। বড় হয়েছি নীলু ( নীলু সেনগুপ্ত) , দীলু ( দীলু ধর ), পলুর ( মৃণাল কান্তি দত্ত বিশ্বাস ) আবৃত্তি শুনে শুনে। পরবর্তীতে পাই অসিত চক্রবর্তী, অলক পাল চৌধুরী, প্রদীপ দাস(বাবুল ), অমিত সিকিদার, দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী পুরকায়স্হ দের। এছাড়াও বিশ্বতোষ চৌধুরী, সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য (চৌধুরী), অজন্তা দাস, হাসনা আরা শেলী, অরুনিমা দেব (ভট্টাচার্য) রা এক সময় এ অঞ্চলের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।

       তারপরেই একধরনের শূণ্যতা। এখানেও। আর এই ধূসরতায় এক হয়ে গেছে বরাক-পশ্চিমবঙ্গ। একটা কথা এখানে বলা দরকার। অনুষ্ঠানে গানের ফাঁকে একটি কবিতা গুঁজে দেবার সেকেলে প্রথা আজকেও পাল্টায়নি। আর এ ক্ষেত্রেও অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই বরাক আর বৃহত্তর বঙ্গে। “অনেকক্ষণ গান শুনলেন এবারে একটু স্বাদ পাল্টাই ……….” জাতীয় মঞ্চ ঘোষণা আজকেও আকছার শোনা যায়। এই নিয়েই তো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিলেন সবাই। কিন্তু সেখানেও যে একধরনের অনিশ্চয়তা।

       বরাকের কথাই ধরি। এখানে আবৃত্তি বা নাটকে উচ্চারণ এবং ভাষার ক্ষেত্রে বাড়তি যত্ন নিতে হয়; তার কারণ আমরা যে ভাষায় কথা বলি তা মান্য বাংলা নয়। প্রশ্নগুলো উঁকি মারতে শুরু করে এসব ক্ষেত্রে। তবে কি এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে কিছুটা অনীহা কাজ করছে? কারণ নাটক ব্যাপারটাই দলগত। প্রয়োজনে স্হানীয় ভাষায় রচিত নাটক মঞ্চস্হ করা যায় অনায়াসে। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। বিশেষ দু একটি ক্ষেত্র বাদ দিলে সব কবিতাই রচিত মান্য বাংলায়। ফলে আবৃত্তিকারকে ভাষা এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে সনিষ্ঠ হতেই হবে।

       এতো বরাকের সমস্যা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ? তাদের তো এ সমস্যা নয়। তবে কি বোধ আর বুদ্ধির চিরকালীন ‘কাজিয়া’ (লড়াই) এখানে প্রকট? বোধ দিয়ে যদি লাগাল নাহি পাই্ / বুদ্ধি দিয়ে হৃদয় ছুঁতে চাই। আরেকটি সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। আগে নাটকে সংলাপ বলার জন্য উদাত্ত আবৃত্তির প্রয়োজন হতো। আজকাল নাটকের সংলাপগুলো পট পরিবর্তন করেছে। তাই ‘শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা’র প্রয়োজন কমে আসছে? পাশাপাশি কবিতাও গতি পরিবর্তন করছে –শব্দ অতি আধুনিক (সব নয়)। তাই আবৃত্তিযোগ্য কবিতা বাছতে কালঘাম বেরিয়ে যায় অনেকের। ঘুরেফিরে সেই রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দ। আর হ্যাঁ-মঞ্চের আকর্ষণ। নিজেকে তৈরী নয়- তৈরী মঞ্চে নিজেকে দাঁড় করানোর প্রয়াস।

 

                                              সব মিলিয়ে আবৃত্তি জগতের স্বাস্হ্য – ভালো নয়।  

এই নিবন্ধের লেখক মনোজ দেব নিজে একজন সুদক্ষ এবং সুপরিচিত আবৃত্তিকার। উনার কাজ এক্ষেত্রে উনাকে যেমন জনপ্রিয় করে তুলেছে, তেমনি উনার কলমের ছোঁয়ায় নিবন্ধে বর্ণিত আবৃত্তির অবস্থান সবাইকে ভাবিয়ে তুলবে । লেখকের এই অবদানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

 

Comments are closed.