কালার ব্লাইন্ড হওয়া দুর্বলতা নয়, বরং আমার শক্তি: ফটোগ্রাফার হিজল চৌধুরী
আমি ফটোগ্রাফিকে নির্বাচন করিনি, ফটোগ্রাফি আমাকে নির্বাচন করেছে, বললেন হিজল চৌধুরী- শিলচরের একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠার যাত্রাপথের বর্ণনা দেওয়ার সময় তার মুখে শোনা গেল কথাটা।
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ফটো জার্নালগুলোতে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর এবারে অটোমোবাইলের অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম পেজে হিজল চৌধুরীর সম্প্রতি একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ‘ইয়ামাহা মোটরস’ এর অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম পেজে সাম্প্রতিক একটি ছবি “INFUSE YOUR LIFE WITH HOPE & WONDER” ক্যাপশন সহ প্রকাশিত হয়েছে। অল্প বয়সেই ইতিমধ্যে বরাক উপত্যকায় হিজল চৌধুরী ক্যামেরার পেছনে নিজের নামকে অনন্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
এই যুবা প্রতিভাকে ঘিরে সবচেয়ে আশ্চর্য জনক ঘটনা হচ্ছে, হিজল চৌধুরী একজন বর্ণান্ধ বা কালার ব্লাইন্ড। কিন্তু ফটোগ্রাফির সঙ্গে তার অদম্য প্রেমের পথে তিনি কখনও এটিকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি, বরং তার এই দুর্বলতাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন।
সুপরিচিত শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী তথা সংবাদপত্রের কর্ণধার তৈমুর রাজা চৌধুরীর পুত্র হিজল চৌধুরী শিলচরে একটি আর্ট স্টুডিও খুলতে চান। বরাক বুলেটিনের জ্ঞানেন্দ্র দাসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে হিজল চৌধুরী ক্যামেরাকে সঙ্গী করে তার চলার পথের কাহিনী, পাশাপাশি তার অন্য এক প্রতিভা ড্রাম বাজানো এবং আরো অনেক ব্যাপারে কথা বলেছেন।
তারই সম্পাদিত অংশ এখানে দেওয়া হল
তোমার সম্প্রতি একটি ক্লিক বা ছবি ‘ইয়ামাহা মোটরস’ এর অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রামে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে, এ বিষয়ে তোমার এরপর অনুভূতি কেমন ছিলো?
ফিচারটি দেখে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমার ফটোগ্রাফগুলোর মধ্যে এটি এমন একটি ছবি যা কিনা অপরিকল্পিতভাবে তোলা হয়েছিল। ফটোশুট করার ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছিলাম এবং একজন মডেলকে এই ফটো শুটের জন্য ঠিকও করেছিলাম। তারপর আমরা শুটিংয়ের জন্য একটি সুন্দর জায়গার খোঁজ করছিলাম। মডেল আসতে দেরি করছিল বলে আমি উলুবাড়ি (গুয়াহাটি) ফ্লাইওভারের কাছে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করেই দেখলাম দেওয়ালের মজাদার ছবিটি। এরপরই সে তার স্কুটারে করে এল এবং আমরা ওইখানেই ফটো শুটটা সারলাম।
তুমি একজন এই অঞ্চলের সুপরিচিত ফটোগ্রাফার। কিন্তু আমরা শুনতে চাই কিভাবে এর সূচনা হয়ে ছিল? তোমাকে ক্যামেরা হাতে নিতে কি অনুপ্রাণিত করল?
এর গোড়াপত্তন হয়ে গিয়েছিল শৈশবেই। সবসময়ই ক্যামেরা হাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি আমি এবং ভালোবাসি আশপাশকে ক্যামেরাবন্দি করতে। কিন্তু যখন আমি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসুয়াল আর্টস নিয়ে স্নাতক শ্রেণীতে পড়ি, আমার কোর্সের অংশ হিসেবে ফটোগ্রাফির ক্লাসও ছিল। ওই সময় আমি শিখেছিলাম ফিল্ম রোল ডেভলপ করা, আলোকচিত্র প্রেরণ অথবা ফটোগ্রাম ইত্যাদি। এগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল, আর সেগুলোই আমাকে ফটোগ্রাফিতে আরো বেশি উৎসাহী করে তুলল। তখন আমার নিজস্ব কোনও ক্যামেরা ছিলনা, আমি আমার মায়ের পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা ব্যবহার করতাম। এটি আমার লেসনের জন্যও ব্যবহার করেছি। আমার এখনো মনে আছে, প্রথম যে ফটোটা তুলেছিলাম সেটি হচ্ছে ডালের একটি দানার ছবি। ফটো তোলার ব্যাপারে তখন আমার কোন অভিজ্ঞতাই ছিলো না। আমি ক্যামেরাকে শুধু ম্যাক্রো মুডে রেখে ফটোটা তুলেছিলাম। ছবিটা এখন যখন দেখি তখন মনে হয় সত্যিই আমি একজন দারুন ফটোগ্রাফার (হাসতে হাসতে)।
তুমি যে ক্যামেরাটা ব্যবহার করো তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তাই একজন বলতেই পারে, আমাদেরও যদি তিন লক্ষ টাকা দামের ক্যামেরা থাকতো তাহলে আমরাও ভালো ছবি তুলতে পারতাম। তাহলে কি বলতে হয় যে, তোমার দামি ক্যামেরা তোমাকে ফটোগ্রাফার বানিয়েছে?
না, মোটেই নয়। আমার ইনস্টাগ্রামের অনুগামীরা আমার কাছে অবিরত জানতে চান, ছবিতে আমি কি ধরনের আলো কিংবা সরঞ্জাম ব্যবহার করেছি এবং ছবি তোলা শুরু করার জন্য তাদের কি কেনা উচিত। কিন্তু আমি যা বুঝতে পারি তা হচ্ছে, এমনকি যদি খুব সস্তাদরের ক্যামেরাও চলবে, তবে যন্ত্রের জ্ঞান, আলোর বিন্যাস কিংবা কম্পোজিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফটো তোলার সরঞ্জাম এক্ষেত্রে অবশ্যই পার্থক্য আনতে পারে। এটি আমাদের কাজকে সহজ করে তোলে, তবে একজনকে ফটো বা কম্পোজিশনের ‘লেওভার’ অবশ্যই জানতে হবে।
তুমি কোথা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছ? ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বাছার পেছনে কি কোন ব্যক্তির অনুপ্রেরণা রয়েছে?
বেশিরভাগ সময় আমি নিজের কাছ থেকেই শিখি এবং ভিডিও গুলো আমাকে এ ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। একজন সুপরিচিত ফটোগ্রাফার পিটার ম্যাককিনন, যার ইউটিউব টিউটোরিয়ালগুলো ফটোগ্রাফিকে বুঝতে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
তাছাড়া, আরো কয়েকজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রয়েছেন আমাদের অঞ্চলে, যার মধ্যে দেবরাজ চক্রবর্তী যাকে আমি দেবরাজদা বলি, তিনি হচ্ছেন একজন চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফার। উনি আমাকে প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। উনার কাজ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
তোমার বাবা এ অঞ্চলের একজন বিখ্যাত শিল্পপতি ও সমাজকর্মী। তার ব্যবসাতে যোগদান করা অনায়াসে সহজ ছিল, তার পরিবর্তে তুমি বেছে নিয়েছো বিবাহের ছবি গুলো ক্লিক করাকে, যেখানে মানুষ তোমাকে ক্যামেরাম্যান হিসেবে সম্বোধন করে বলতেও পারে, এখানে এসে ফটো উঠাও কিংবা ওইখানে যাও…….
আমি জীবনে যা করেছি কিংবা যা-ই নির্বাচন করেছি অভিভাবকরা সব সময় আমাকে সমর্থন করেছেন। আমি যখন স্নাতক স্তরে আমার স্ট্রিম নির্বাচন করেছি এবং যখন অন্য বাচ্চারা মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে, তখন আমার বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি জীবনে কি করতে চাই? আমি ভিসুয়াল আর্টসকে নির্বাচন করে আমার স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। যা অবশেষে আমাকে ফটোগ্রাফিতে নিয়ে এলো। একটা কথা আছে, তুমি তোমার বাবার ছেলে কিন্তু তোমার জীবনের লক্ষ্যটা স্থির করতে হবে তোমার নিজের জন্যই। এবং আমি মনে করি, আমি ফটোগ্রাফিকে নির্বাচন করিনি, এটি আমাকে নির্বাচন করেছে। আমি বিবাহ বাসরে ফটো তুলতে ভালবাসি এবং আমাকে যদি কেউ ক্যামেরাম্যান বলে ডাকে তাতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।
ফটোগ্রাফি এমনিতেই খুব চ্যালেঞ্জিং হয় এবং যখন বিশেষভাবে রং শনাক্ত করা তোমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাই তোমার এই বর্ণান্ধতা কি কখনো বাধা হয়ে এসেছে ফটোগ্রাফির রাস্তায়?
হ্যাঁ অবশ্যই, (জোরে হেসে)। কিন্তু ইতিমধ্যেই বলেছি, আমি ফটোগ্রাফিকে পছন্দ করিনি, ফটোগ্রাফি আমাকে পছন্দ করেছে। হ্যাঁ, আমি কালার ব্লাইণ্ড এবং হালকা রংগুলো আমি আলাদা করে চিনতে পারি না। যেমন ধরুন কমলা এবং সবুজের সেডগুলো। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, এখন অনেক উন্নত মানের সফটওয়্যার রয়েছে, রয়েছে উন্নত মানের ‘সিস্টেম’ এবং ‘হিস্টোগ্রাম’, যা কিনা বর্ণান্ধ মানুষদের রঙ চিনতে সাহায্য করে। কিন্তু আমি যখন নিজের কাজ করি, আমি অবশ্যই এমন ভাবে সম্পাদনা করি, যেভাবে আমি পৃথিবীটাকে দেখতে চাই। তাছাড়া আমার অনুরাগীরা সব সময়ই আমার সম্পাদনার প্রশংসা করে, যা আসলে আমার
কালার ব্লাইণ্ড হওয়ার কারণে ঘটছে। তাই এটি আমার দু্র্বলতা নয়, বরং এটি আমার শক্তি।
লোকেরা যখন তোমার এই ত্রুটির কথা জানতে পারে, তখন কিভাবে প্রতিক্রিয়া থাকে তাদের? এ ধরনের অযাচিত সহানুভূতি সামলে নেওয়া তোমার জন্য সত্যি কঠিন?
ভাগ্যক্রমে, কেহ আমার প্রতি সহানুভূতি দেখায় না। উল্টো সবাই বলে, আমার এডিটিং সম্পূর্ণ আলাদা এবং আবার বলতেই হয়, এটি আমার কালার ব্লাইন্ড হওয়ার কারণেই হচ্ছে।
আজ তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানে তোমার একাডেমিক জ্ঞান কতটা সাহায্য করেছে?
ইতিমধ্যেই বলেছি, আমি বেশিরভাগ নিজে নিজেই শিখেছি, তবুও ফটোগ্রাফির মূল উপাদান হচ্ছে, ক্যামেরা আলোকে ধরে – ইমেজকে নয়। আমার একাডেমিক জ্ঞান আমাকে সাহায্য করেছে বুঝতে ফটোগ্রাফিতে আলো কিভাবে কাজ করে। আমার স্নাতক ডিগ্রি লাভের দিনগুলোতে আমি শিখি, কিভাবে আলোকে কাজে লাগাতে হয়, তাই ফটোগ্রাফি ক্লাসগুলোকে বিশেষ ধন্যবাদ। আমার ডিপার্টমেন্টের অনেক শিক্ষকই আমাকে সাহায্য করেছেন ফটোগ্রাফি শেখাতে, কিন্তু এখানে একজন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে আমার আজকের সাফল্যের পেছনে। তিনি হচ্ছেন শিক্ষক আলফারিদ হোসেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন ধরনের আলো কিভাবে কাজ করে এবং ‘থ্রি পয়েন্ট লাইটিং সিস্টেম’ বুঝতে সাহায্য করেছেন।
শুধু কি ফটোগ্রাফি? না সিনেম্যাটোগ্রাফিতেও নিজের দক্ষতা প্রদর্শনে চেষ্টা করতে চাও?
আমি সিনেম্যাটোগ্রাফি খুবই ভালোবাসি, কিন্তু এতে আমার অভিজ্ঞতা খুবই নগণ্য। আমি যখনই সিনেমাটোগ্রাফিতে কোনও সুযোগ পাই, আমার খুবই ভালো বন্ধু অভিষেক গোস্বামীর সাহায্য নিয়ে উতরে যাই। সবারই নিজস্ব উৎকর্ষ থাকে, কিন্তু আমি সিনেমাটোগ্রাফি এখন শিখছি। ইদানিংকালে এটি নিয়ে চর্চাও করছি।
আগামী দুবছরে কী অর্জন করতে চাইবে, যা তোমাকে সুখী করে তুলবে?
আমার ক্লায়েন্ট এবং অনুগামীরা যদি খুশি থাকেন, তাহলেই আমি খুশি। এখানে আমি একটা জিনিস যোগ করতে চাই, বরাক উপত্যকায় এক অত্যাধুনিক আর্ট ইনডোর ফটোগ্রাফি স্টুডিও খুলছি। এটিতে অত্যাধুনিক আলোর সাজসরঞ্জাম ছাড়াও ব্যাক ড্রপ, রিয়েল টাইম ইমেজ মনিটরিং এবং পোট্রেট ক্যাপচার করার ব্যবস্থা থাকবে। এটি এপ্রিলের মধ্যে শুরু হবে। আরো বেশি সৃজনশীল আলো এবং উন্নত মানের সেটের সাহায্যে শুটিংয়েরও সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া আমি একটি কর্মশালা করারও পরিকল্পনা করছি, যদি আগ্রহী ব্যক্তিদের কয়েকজনকেও পাই, তাহলে তা আমি অতিসত্বর শুরু করতে চাই।
ফটোগ্রাফি এবং সিনেম্যাটোগ্রাফি ছাড়াও তুমি মিউজিকে রয়েছো, তাই এবার সে বিষয়ে আমাদের কিছু বল
মিউজিক আমার জীবনে ফটোগ্রাফিরও অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল। আমি ড্রাম বাজানো শিখি। ১৩ বছর ধরে আমি ড্রাম বাজাচ্ছি। এখন আমি রবিবারে ড্রাম বাজানো শেখাই।
অবসর সময়ে কি করতে ভালোবাসো?
আমি ভিডিও গেম খেলতে ভালোবাসি। আমার যে নিজস্ব সময় সেটাতে ভিডিও গেম খেলতে সবচেয়ে ভালোবাসি। ভিডিও গেম সেট আপ এর জন্য অনেক ব্যয়ও করেছি। আমি ফটোগ্রাফির জন্য ঘুরতে খুব ভালোবাসি। যখনই ট্রাভেলিং করি, জনগণের সংস্পর্শে আসতে এবং বিভিন্ন লোকেশনে শুটিং করতে চেষ্টা করি।
উঠতি ফটোগ্রাফারদের তুমি কি বার্তা দিতে চাইবে?
আমি বলব, যদি আপনি দেখতে পান যে একজন ফটোগ্রাফার আপনার থেকে অনেক বেশি দক্ষ, তাহলে হতাশ হবেন না। আপনার চেষ্টা এবং আপনার কাজের উপর মনোযোগ নিবদ্ধ রাখুন। ফটোগ্রাফি হচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা, তাতে ভুল ভ্রান্তি থাকতেই পারে। টাকা রোজগারের কথা ভেবেই শুধু ফটোগ্রাফি করতে হবে এমন কোন কথা নয়। যাই হোক না কেন, আপনার ‘প্যাশন’কে অনুসরণ করতে হবে।
Check out Hizol Choudhury photography skills on his Instagram page here
Comments are closed.