'নাইন পিএম' ডিবেইট : টিভি স্টুডিও, না কলোসিয়াম?
খন লকডাউনে ঘরেই আছেন, তবে সাধারণত অফিসের কাজ সেরে বা সারাদিনে কর্মস্থল থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে যখন আপনি বাড়িতে আসলেন তখন একটু ফ্রেস হয়ে বিছানায় বা সোফায় বসে টিভিটা অন করেন। আগের মতো ভাঙা সাউন্ডের টিভি তেমন কেউ দেখেন না, উন্নতমানের ডিজিটাল সাউন্ডসিস্টেমের এলইডি টিভি অনেকেরই পছন্দ। সারাদিন গিন্নি সিরিয়েল, সিনেমা ও বাচ্ছাগুলো কার্টুন দেখলেও রাতের বেলা টিভির রিমোটটা আপনারই দখলে রাখেন। খবরের দিকে বেশ চোখ না রাখলেও চলার পথে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আপ টু ডেট থাকতে রাতের বেলা জাতীয় চ্যানেলে চলা নাইন পিএমের ডিবেইটগুলো অবশ্যই আপনার মিস হয়না।
হ্যা, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্কের দর্শক হওয়াটা যথেষ্ঠ জরুরী। গণতান্ত্রিক দেশে সচেতন নাগরিক হিসাবে আপনার গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হবে। দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত না থাকলে আপনি যেমন গণতন্ত্রের স্বাদ উপলব্দি করতে পারবেন না তেমনি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে পরিগণিত হবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটি করেছিলেন থমাস জেফারসন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ এখানে সংবাদপত্র বলতে সংবাদমাধ্যমের কথাই উল্লেখ করেছেন জেফারসন, তবে তিনি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথা বলেছিলেন। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যমকে আমরা অবহেলা করতে পারিনা, কারণ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একদা বলেছেন যে কোনো দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।
তবে আমাদের দেশের অধিকাংশের বেশি সংবাদমাধ্যম ও নাইন পিএমের ডিবেইটগুলো কি আদৌও থমাস জেফারসনের মতবাদের সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা পালন করছে? সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা একটি দেশের সমাজ ও জাতি গঠনে যে ভুমিকা নেয় তা অন্য কোন মাধ্যমের পক্ষে সম্ভবপর নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের রেঙ্কিং এ ১৪২ তম স্থানে চলে আসা ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ভুমিকা শুধুমাত্র নিরাশজনক নয়, চরম উদ্বেগজনক বটে। বর্তমান সময়ে নাইন পিএমের ডিবেইট গুলোকে এমনভাবে ফ্রেইম করা হচ্ছে যা আন্তর্জাতিক স্তরে হাসির খোরাক হিসাবে পর্যালোচিত হচ্ছে। একসময় টিভিতে হওয়া ডিবেইটগুলোর একটা মর্যাদা ছিল, বৌদ্ধিক মহলের জ্ঞানগর্ব তথ্যভিত্তিক আলোচনায় দেশের সামগ্রিক স্বার্থের অনেক কথা উঠে আসত। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার খোরাক জোগাতে এক বড় ভূমিকা নিতে দেখা যেত এসব মিডিয়া হাউসকে। ডিবেইটগুলোতে ভদ্রভাবে বসে বসে করা হত। আর এখন উচ্চ আওয়াজে চিৎকার দিয়ে বিতর্কের ট্রেন্ড শুরু হল, এবার তো এমনভাবে স্টুডিও বানানো হয়েছে যেখানে ডিবেইটের সময় লাফিয়ে উঠা ছাড়াও প্রয়োজনে দৌঁড়ানো যায়। এক প্রবক্তা অন্য প্রবক্তার গায়ে গ্লাস ছুঁড়ে জল ফেলছেন, কখনো প্রবক্তাদের মধ্যে শারীরিক লড়াই হচ্ছে, আবারও কখনও ভাষার সমস্ত সীমালঙ্ঘন করে চরম আপত্তিজনক ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে একে অন্যকে লাইভ হেনস্থা করছেন। একপক্ষীয় সাংবাদিকও যেমন অসভ্যতার সীমা ছেড়ে প্রবক্তাদের সঙ্গে আচরণ করেন, তেমনি প্রবক্তাও সাংবাদিকদের দালাল, বিএনডি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে ক্ষমা চাইতেও অস্বীকার করেন। গুরুত্বপূর্ণ বা দেশের হিতকর বিষয়গুলোকে চরম অগ্রাহ্য করে এমন কিছু বিষয় নাইন পিএমের বিতর্কের জন্য নির্বাচিত হয়, যা দর্শকদের রক্ত উত্তপ্ত করে, কাল্পনিক ভয় জাগ্রত করে, বিদ্বেষের স্পৃহা তীব্র করে। বর্তমান ভারতের এই নাইন পিএম ডিবেইট রোমের কলোসিয়ামের সেই ভয়াবহ লড়াইয়ের মতো হয়ে গেছে।
রক্ত-পিপাসু রোম সম্রাটদের বিকৃত আনন্দের খোরাক যোগাতে গিয়ে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে কলোসিয়াম বধ্যভূমিতে, ইতিহাস তার সঠিক হিসাব রাখেনি। শুধু মানুষই নয়, কলোসিয়ামের মাটিতে অজস্র বন্য জীবজন্তুর রক্তও মিশে আছে।সম্রাটদের নির্দেশে রাজকোষের অর্থে সেই সময় এক বিশেষ খেলার জন্য উত্তর আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদানি করা হতো হাজার হাজার হাতি, গন্ডার এবং সিংহ। ভল্লুকের সঙ্গে হাতি, হাতির সঙ্গে বুনো মহিষ বা গন্ডারের সঙ্গে হাতির লড়াই দেখত হাজারো বিশ্ব সম্ভ্রান্তরা। এই লড়াই লাগিয়ে রোম সম্রাটরা একদিকে বিকৃত আনন্দ লাভ করলেও অন্যদিকে তারা জনগণের প্রতি থাকা সমস্ত দায়বদ্ধতার জবাবদিহি থেকে রক্ষা পেয়ে যেত। জনগণ শুধু লড়াই, বিকৃত আনন্দ, ভয় ও বিদ্বেষ নিয়েই উন্মাদ হয়ে থাকত। আমাদের টিভির পর্দার নাইন পিএমের ডিবেইটগুলোর স্টুডিও আজ সেই বধ্যভুমি কলোসিয়াম হয়ে গেছে। এখানে প্রাণীর রক্ত না ঝরলেও প্রতিনিয়ত বৌদ্ধিক স্খলন ও গণতন্ত্রের দুর্বল অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে। একাংশ মিডিয়া হাউসের স্টুডিওতে অত্যন্ত সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অপ্রাসঙ্গিক ও ধর্মীয় বিষয় নির্বাচিত করা হয় ও বিভিন্ন ট্যাগের প্রবক্তা বাচাই করে স্টুডিওতে বসানো হয়। তারপর সেখানে কলোসিয়ামের মতো প্রবক্তাদের দিয়ে লড়াই চালোনা হয়। দর্শকদের সাইকোলজি স্টাডি করে এমনভাবে বিষয়গুলোর উপস্থাপন করানো হয় যাতে কেউ মিডিয়া হাউসের সেই নীচ কুঅভিসন্ধি বুঝতে না পারে। এভাবেই চতুর্থস্তম্ভের মানরক্ষার নামে প্রতিনিয়ত আমজনতার ব্রেইনওয়াশ করা হচ্ছে।
নিজ দেশের অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক বা সার্বভৌম অবস্থানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠকের কাছে নিউ ইয়র্ক টাইমস আর ওয়াশিংটন পোস্টের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। সিএনএনের বিশ্বাসযোগ্যতাও মানুষের কাছে যথেষ্ট ভালো। ব্রিটেনে গার্ডিয়ানে কিছু প্রকাশিত হলে তা মানুষ বিশ্বাস করে। বিবিসি আর চ্যানেল ফোরের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনো ভালো। কোনো গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এখনো এই বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো কাজ করে না, বা নিজের দেশের জনগণের সঙ্গে এতো বেশি প্রতারণায় লিপ্ত হয় না।
যুগ যুগ ধরে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। তবে দেশের জনগণ সময়ের চলমানে সবকিছু বুঝতে সক্ষম, এজন্যই থমাস জেফারসনের মন্তব্যের ঠিক প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর।’ আর এই বক্তব্যের আরও একদাপ এগিয়ে ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস জোয়েল বলেছিলেন, “If people in the media cannot decide whether they are in the business of reporting news or manufacturing propaganda, it is all the more important that the public understand that difference, and choose their news sources accordingly.” মানে সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যে তারা সংবাদ প্রচার না সংবাদ তৈরি করার কাজে নিয়োজিত তখন জনতা সেই পার্থক্যকে বুঝতে সক্ষম হয়। যেকোন ধর্ম বা আদর্শেরই মানুষ চিরদিন বোকা থাকে না, আর উন্নত প্রযুক্তির যুগে সংবাদ পেয়েই তা গিলে ফেলতে রাজী নয় একাংশ দর্শক। ‘পাব্লিক আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট ডিফারেন্স’ অর্থ্যাৎ সংবাদের নামে উগ্রতা, বিনোদন ও স্বৈরাচারী কে বা কারা করছে বা কারা দেশের সামগ্রীক স্বার্থে সাংবাদিকতার কাজে নিয়োজিত আছে একদিন তা সব স্পষ্ট হবে। তবে তা অনেক দেরী হয়ে যাবে, তার আগে এই কলোসিয়ামের পাপের সাজায় দেশবাসী দহন হতে হবে, পরিণাম ভোগতে হবে।
এই নিবন্ধের লেখক জাহিদ ইসলাম বড়ভূইয়া একজন শিক্ষক । নিবন্ধে উনার ব্যক্তিগত মতামত প্রতিফলিত হয়েছে।
Comments are closed.