ভোট চাই সুবিধা তাই সরাসরি ভোটারের হাতে
নির্বাচন আসছে। এটাই তার আগে শেষ বাজেট। পাড়ার হরি মুদিও জানতো সরকার এবার দাতা কর্ণ হবেন । পীযূষ গোয়েলের অন্তর্বর্তী, কিন্তু বহির্মুখী বাজেটে প্রস্তাবিত নানা সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিশ্রুতির ভিড় তাই আমাদের অবাক করে নি। ক্ষমতায় বিজেপি না হয়ে কংগ্রেস হলেও বাজেটের ভোটগন্ধী চরিত্রে কোনও ফারাক পড়তো না।
এই দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা একাশি কোটির অধিক। সংখ্যাটা পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে গোটা ইউরোপের সম্মিলিত জনসংখ্যার চাইতেও বেশি। এই বিশাল সংখ্যক মতদাতাদের একটি বাজেটের মাধ্যমে তুষ্ট করা কার্যত অসম্ভব। গোয়েল তাই বুদ্ধিমানের মতোই সে পথ মাড়াননি।
আজকাল একটা বিষয় ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। তা হলো সরকার-জনগণের আন্ত:সম্পর্কের রসায়নে বড়সড় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বড় বাজেটের বিকাশমুখি প্রকল্পের মাধ্যমে গণদেবতাকে সন্তুষ্ট করা যায় কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি এখন সত্যিই সন্ধিহান। উদাহরণ
নেওয়া যেতে পারে পরিকাঠামো উন্নয়নের। একটি রাজ্যে দশটি রাস্তা বা পাঁচটি সেতু বা একখানা এইমস স্থাপন করলেই ভোটদাতারা সুড়সুড় করে ইভিএমে বোতাম টিপে দেবেন এমনটা আর হচ্ছে না। অথচ বিকাশ বা উন্নয়ন বললে আমরা তো রাস্তাঘাট, সেতু, উড়ালপুল বিমানবন্দর ইত্যাদিই বুঝি। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ‘কালেক্টিভ গুড’ বা সম্মিলিত ভাবে ভোগ করা যায় এমন সামাজিক পণ্য। গ্রামে রাস্তা পাকা হল আর গ্রাম ঝেটিয়ে সবাই শাসক দলকে ভোট দিল। এমনটা আগে হতো। কিন্তু ক্রমেই মানুষ সমষ্টিগত উন্নয়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে ভোটের বেলা তার ব্যক্তিগত লাভালাভকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। আরও একটা উদাহরণ নিচ্ছি। পেট্রোল-ডিজেলের দাম যদি লিটার প্রতি এক টাকা কমে যায় তাতে গোটা দেশের মানুষই উপকৃত হন। যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় কমে যায়। তাতে পণ্য ও পরিষেবা দুই-ই সস্তা দামে পাওয়া যায়। আপাতভাবে সরকারকে কল্যাণকামী চেহারায়ও দেখা যায়। কিন্তু তাতে ভোটের বাক্সে খুব একটা লাভ হয় না। এর পরিবর্তে, রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির অংক যদি সিলিন্ডার প্রতি ২৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, ভোটাররা সরকার প্রদত্ত এই আর্থিক সুবিধাটি সহজেই চোখে দেখতে পারেন। কারণ ভর্তুকির টাকাটা যে সরাসরি ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা পড়ে যাচ্ছে।
বিজেপি দলটি বিকাশমুখী এমন একটি ধারণা সফল ভাবে তৈরি করা হয়েছে। সামনে বিকাশ, পিছনে হিন্দুত্বের মডেল নিয়ে বিগত পাঁচ বছরে বিজেপি যে ধরনের নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করেছে তা দেশের যে কোনও রাজনৈতিক দলের জন্যই অভূতপূর্ব। কিন্তু তা সত্বেও আসন্ন নির্বাচনের পটভূমিকায় দলটিকে ততটা শক্তিশালী দেখাচ্ছে না। বাইশ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা পড়তে এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট সময় নিয়েছেন পীযূষ গোয়েল। লিখিত ভাষ্যের বাইরে গিয়ে হিন্দিতে কথা বলেছেন বারংবার। দেহভঙ্গি ও শব্দপ্রয়োগ প্রায়শই নির্বাচনী সভা মনে করিয়ে দিয়েছে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উপর নির্মিত ‘উরি’ ছবির উল্লেখে যে ‘জোশ’ লোকসভা দেখেছে তা সাধারণত মেঠো বক্তৃতায় দেখা যায়। এসব কিছুর পেছনে ভোটারদের মন জয়ে শাসক দলের মরিয়া ভাবই ফুটে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটটি মনে রাখলে তবেই ষোড়শ লোকসভায় উত্থাপিত শেষ বাজেটটিকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে। রাহুল গান্ধী তাঁর চালে প্রাথমিকভাবে হেরে গেছেন। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের অর্থনৈতিক ভাবে দুর্গতদের জন্য ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত করবে এই চিৎকৃত ঘোষণাটি বাজেটের পরে করলেই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। মোদি সরকার এই বাজেটে কার্যত রাহুলের তাসটি চুরি করেই নিয়েছে। পিএম কিষান প্রকল্পে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জন্য বার্ষিক ছয় হাজার টাকার যে সংস্থান বাজেটে রয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি ভালো পদক্ষেপ। বারো কোটি চাষী পরিবার এই সুবিধের পরশ পাচ্ছে। যে কথাটা হচ্ছিল, এই ছয় বছরের প্রথম কিস্তির দু হাজার টাকা কিন্তু অবিলম্বে ব্যাংক একাউন্টে চলে যাবে। চিরাচরিত রেওয়াজের বাইরে গিয়েই চলতি আর্থিক বছরের জন্য এই খাতে কুড়ি হাজার কোটি টাকার পরিপূরক সংস্থান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ নির্বাচনের আগেই যেন প্রথম কিস্তির টাকা ভোটাররা হাতে পেয়ে যান । এও ‘এক ক্যাশ ফর ভোট’, কিন্তু সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে!
আয়কর এর ক্ষেত্রে মোক্ষম পদক্ষেপ আছে এই বাজেটে। পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ের বেলা সম্পূর্ণ কর- রেহাই ঘোষণা করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আয়করের স্ল্যাবে কিন্তু কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। এবং, ফলে, সর্বস্তরের করদাতারা এখানে উপকৃত হচ্ছেন না। যাঁদের আয় ধরা যাক পুরো পাঁচ লক্ষ টাকা তারা এই মুহূর্তে কর দিচ্ছেন চার শতাংশ সারচার্জ মিলিয়ে ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু প্রস্তাবিত আয়কর ব্যবস্থায় তাদের কোনও কর দিতে হবে না। কিন্তু যাঁর বার্ষিক আয় পাঁচ লক্ষ এক টাকা (তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল) তাঁকে পুরনো হারেই মোট ১৩,০০০ টাকা আয়কর গুনতে হবে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো এই, পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সবাই এবার পীযূষ গোয়েলের বাজেটে উপকৃত হচ্ছেন। সংখ্যাটা বলা হয়েছে তিন কোটি মধ্যবিত্ত। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে ১৮,৫০০ কোটি টাকার মতো। তার মানে, গড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা বা এর কম আয়ের যাঁরা রয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকে বছরে এখন ৬০০০ টাকার সুবিধা পাচ্ছেন। সর্বোচ্চ সুবিধা অবশ্য যেমনটা বলা হয়েছে, তেরো হাজার টাকা হবে।
এবার যদি আমরা কত টাকা ব্যয়বরাদ্দের মাধ্যমে কতজন ভোটার থুড়ি দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করা গেল, এই হিসাবটা কষে নিতে চাই তাহলে দেখব, পরিবার প্রতি মাসে পাঁচশ টাকার বাড়তি সংস্থান করা হয়েছে গরীব চাষি ও মধ্যবিত্ত মিলিয়ে মোট পনেরো কোটি পরিবারের জন্য। একটি পরিবারের গড়ে তিনজন ভোটার থাকলে মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ কোটি ভোটারের কাছে কিন্তু এই বাজেট প্রত্যক্ষ ভাবে পৌঁছে যাবে। এতে রাজকোষে বাড়তি চাপ পড়ছে ১,১৩,৫০০ কোটি টাকার। এবারের বাজেটে মোট ব্যয় বরাদ্দের বহর হচ্ছে ২৭,৮৪,২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটের ৪ শতাংশের সামান্য বেশি খরচা করলেই পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে পঞ্চাশ শতাংশ ভোটারের কাছে। জনধন-আধার-মোবাইল এই ত্রয়ী কি সাধে এতো গুরুত্ব পেয়েছে নরেন্দ্র মোদির কাছে! আপাতভাবে মনে হতে পারে এই বাজেটে যথেচ্ছভাবে খরচের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাতে রাজকোষে ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। প্রস্তাবিত ঘাটতিকে বেঁধে রাখা হয়েছে ৩.১ শতাংশে। চলতি আর্থিক বছরের ঘাটতিও মাত্র ০.১ শতাংশই বেড়েছে। এতোসব ‘অসম্ভব’ সম্ভব করতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ নিযুক্তি প্রকল্প কিংবা প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো বড় প্রকল্পে গত বছরের তুলনায় মঞ্জুরী কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সব কিছুর পরও দুটো সমস্ত থেকেই গেল। এক কৃষকের সমস্যা বুঝলেও কৃষির রোগ ধরা গেল না। রোগ না রোগী কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা গেল না। দুই, ৬.১ শতাংশ যেখানে কর্মহীনতার হার, সেখানে বাজেট কার্যত নীরব। নাকি ‘মোদি মোদি’ উৎরোলে চাপাই পড়ে গেল কর্মহীনদের আর্তনাদ!
This story was first published in Samayik Prasanga Newspaper
Comments are closed.