Also read in

পুজো শপিং : শিলচরে অফলাইন স্টোরগুলোর জন্য মহামারী কাল হয়ে উঠলেও অনলাইন বুটিকগুলো অর্ডার পাচ্ছে প্রত্যাশা অনুযায়ী

দুর্গাপূজার মানে যেমন মা দুর্গার মর্ত্যে আগমন, মায়ের পূজায় আনন্দে ভেসে যাওয়া, তেমনি দুর্গাপূজায় আমরা নেশায় মাতি নতুন কাপড়ের গন্ধে, নতুন পোশাকের কেনাকাটায়। নতুন শাড়ির খসখস শব্দ আমাদের খুব পরিচিত এবং প্রিয়। ধনী-দরিদ্র, লম্বা-খাটো, নারী-পুরুষ, জাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্যই দুর্গাপূজায় যেন কিছু একটা অপেক্ষা করে থাকে। এটি এমন একটি উৎসব যা সবাইকে একটা সূত্রে বেঁধে রাখে এবং একই সঙ্গে অনেকের জন্য উপার্জনের পথও খোলে দেয়।

পুজোর আর মাত্র আট দিন বাকি। অন্য বছরে এই সময়ে রাস্তাগুলোতে ভিড়ে পথ চলা মুশকিল হয়ে ওঠে, যানজটে একাকার থাকে রাস্তাঘাট। তবে সালটা যে ২০২০। এ বছরটা যে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বছর নয়। তাই বাস্তবে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবে স্বাভাবিক জীবনে এমন একটা ব্যাঘাত ঘটেছে যা বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা ছিল না।

আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গতকাল তার প্রেস বিবৃতি দেওয়ার সময় জানিয়েছেন, প্রথমবারের মতো রাজ্যে করোনা পজিটিভের হার কমতে শুরু করেছে। এদিকে তার বিভাগ দ্বারা পরিচালিত গাইডলাইনগুলো অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসায় আঘাত হেনেছে।

এই কঠিন সময় অনেকের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাপড়ের দোকানের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরা এই মরশুমের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। কারণ এটাই একমাত্র সময় যখন তারা সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করেন। বাঙালির এক ঐতিহ্য হিসেবে পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনরা পুজোর সময় একে অন্যকে পোশাক উপহার দেন। এক্ষেত্রে দূর্গাপূজার জন্য কেনাকাটা যেন নিজেই একটা উৎসব হয়ে উঠে। যে উৎসবে আগ্রহ আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার।

এবার সে উৎসবের কি হলো? যদি ক্রেতার সংখ্যার কথা বলতে হয়, তাহলে এখন পর্যন্ত আমরা গত বছর যে হারে ব্যবসা করেছি এ বছর তার ৩০% ব্যবসা হয়েছে।’ সারদামণি স্টোরের স্বত্বাধিকারী আশীষ কুমার রায় জানালেন। “তবে আমরা এখনো আশা ছাড়িনি। ইংরেজিতে যেমন বলে “ফিঙ্গার ক্রসড”, আমাদেরও তাই।’ জানালেন রায়।

শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সারদামণি স্টোর শিলচরে বলা চলে এক বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড। তবুও রায় মনে করেন, লোকেরা ভয় পেয়েছে, তাই এমন অবস্থা। রায় আমাদের জানালেন, ‘ আমরা থার্মাল স্ক্যানার ব্যবহার করছি, সেখানে স্যানিটাইজার রাখা রয়েছে। তবুও লোকেরা দোকানে এসে বিক্রেতার কাছ থেকে কাপড় কিনতে দ্বিধা বোধ করছেন। আমরা কিছু আকর্ষণীয় ছাড়ের ঘোষণাও করেছি।’

এই স্টোর বেনারস, মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লি থেকে কাপড় সংগ্রহ করে। রায় জানালেন, স্ট্রেটকাট কুর্তির সঙ্গে মিলিয়ে ফর্মাল প্যান্ট বা সারারা এ বছরের ফ্যাশনে এগিয়ে রয়েছে।

গ্রাহকদের আচরণের বিষয়টি নিয়ে যখন বলতে হয় তখন বলা উচিত এক আমূল পরিবর্তন দেখা গেছে। যারা নিজেদের পছন্দের দোকানে এসে নিজে কাপড় দেখে, সেই কাপড় পরে পোশাক পছন্দ করতেন, তারা কিন্তু এখন অনলাইন অর্ডার করতে বেশি পছন্দ করছেন।

যেখানে সারাদামানি স্টোর গত বছরের তুলনায় মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যবসা করেছে, সেখানে তরুণ উদ্যোক্তা জারা কালেকশনের স্বত্বাধিকারী সারা শবনম বলেছেন , তার বুটিক গত বছরের তুলনায় ৮০% বিক্রি করতে পেরেছে।

“গত মাস অবধি আমি ভেবেছিলাম এই পুজোতে লোকেরা নিজেদের সাজিয়ে তুলতে পছন্দ করবেন কিনা। এমনকি একটা সময় আমি ভেবেছিলাম যে লোকেরা হয়তো নতুন পোশাক কিনতেও না পারেন এবং এটা আমাকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হয়েছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা এই উৎসবটি সম্পর্কে আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছেন”, জানালেন শবনম।

নিজেদের সাজিয়ে তোলার জন্য আর মাত্র একটা সপ্তাহ রয়েছে। তবুও শবনম বলছেন, তিনি এখনও নতুন অর্ডার পাচ্ছেন। “আমার এখনো অনেকগুলো কাজ শেষ করা বাকি রয়েছে।” এই বছরের পুজোর শপিং বাজেটের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো যোগ করেন, এবছর সাধারণ মানুষ অনেক দিক দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সে কারণে আমরা সেই অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করেছি।”

এক্ষেত্রে শবনমের মূল্যায়ন অনুযায়ী, এই কঠিন সময়ে তার এই সাফল্যের পেছনে যা কাজ করেছে তা হচ্ছে অনলাইন শপিং পদ্ধতি। ‘সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজন নেই, এ কারণেই হয়তো এ বছর লোকেরা এর প্রতি বেশি ঝুঁকেছেন’ তিনি উল্লেখ করেন।

এই নতুন উদ্যোক্তা এবছরের স্টাইল নিয়ে বলতে গিয়ে জানান, এবছরের ট্রেন্ড হচ্ছে, পাকিস্তানি সুট, যা কিনা টিভি শো গুলোতে আজকাল খুব বেশি দেখা যায়।

ফ্যাশন ডিজাইনার প্রিয়া রায় বর্মন তার নিজস্ব বুটিক ‘নব্যা’র পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী জানালেন, এ বছরে পুজোর শপিংয়ের সেই সুর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে বাচ্চাদের উৎসাহ যেন হারিয়ে গেছে। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের তাদের মা-বাবা বাইরে বেরোতে দিচ্ছেন না, যাতে কোভিড নাইনটিন সংক্রমনের সংস্পর্শে তারা না আসে। প্রিয়া রায় বর্মন আরও বলেন,” তারা সেই ‘শপিং ক্রেজ’ উপভোগ করতে পারছে না এবং সেই মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলছে।”

‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বিক্রি অবশ্যই তেমনভাবে হয়নি। গত ১০-১৫ দিন ধরে আমরা হঠাৎ করেই অর্ডার পেতে শুরু করি। সাধারনত আমরা দেখেছি, দু তিন মাস আগে থেকে অর্ডার আসা শুরু হয়। কিন্তু এ বছরের মহামারীর কারণে অর্ডারগুলো দেরিতে আসা শুরু হয়। এভাবে হঠাৎ করে শেষ সময়ে অনেকগুলো অর্ডার আসায় আমাদের এখনো কাজ বাকি।’ জানালেন প্রিয়া।

এই শেষ সময়ের ভিড়ের কারণে প্রিয়া মনে করেন, তিনি তার প্রত্যাশার ৮০ শতাংশ পূরণ করতে পারবেন। ফ্যাশন সম্পর্কে তিনি বলেন, পুজোর দিনগুলোতে দিনের বেলা অনেককে ঐতিহ্যবাহী শাড়ি পড়তে দেখা যায়। রাতের বেলায় ইন্দো-ওয়েস্টার্ন সাজসজ্জা বেশি পছন্দ করেন সবাই। শাড়ির সঙ্গে শ্রাগ, সিগারেট প্যান্ট সহ সালোয়ার, এক রঙের সিল্ক শাড়ির সঙ্গে ডিজাইন করা ফুল তোলা সিল্কের ব্লাউজ এ বছরের পুজোর ট্রেন্ড হতে চলেছে বলে প্রিয়া মনে করেন।

ঐতিহ্যবাহী স্টোর থেকে শুরু করে নতুন এই বুটিকগুলো সর্বত্রই যেন করোনাভাইরাসের ক্রোধ স্পষ্ট। তবে এটাও স্পষ্ট যে অনলাইনের তুলনায় যে ব্যবসায়ীরা দোকানে বসে ব্যবসা করছেন তাদের জন্য সময়টা বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে। সারদামণি, আনন্দময়ী, নাহাটা এবং অন্যান্য দোকানগুলোর জন্য যখন এ ব্যবসা উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে, তখন অনলাইন শপিংয়ের রমরমা ব্যবসা চলছে। গ্রাহকদের এই অনলাইন শপিংয়ের প্রতি ঝোঁকটা যদি বাড়তে থাকে এবং অনলাইন শপিং যদি তাদের বিশেষ পছন্দের হয়ে উঠে, তাহলে অবশ্যই খুচরো বিক্রেতাদের জন্য মহামারী চলে যাওয়ার পরও সময়টা কঠিনই থেকে যাবে।

Comments are closed.