জীবনের লড়াইয়েও প্রত্যয়ী রাজ্য দলের প্রাক্তন ফুটবলার বাবু, জানিয়ে দিলেন 'ক্যানসারকে হারিয়ে মাঠে ফিরবই'
একজন ফুটবলার অথবা একজন কোচ হিসেবে মাঠে তার উপস্থিতি যেন গোটা দলকে চাঙ্গা করে দিত। তিন কাঠির নিচে দাঁড়ালে দলকে টানা মোটিভেট করে যেতেন। আর কোচ হিসাবে ডাগআউটে থাকলে টানা চিৎকার করে খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতেন। একজন গোলকিপার হিসেবে নিজের ক্লাব, জেলা এমনকি রাজ্য দলের হয়েও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব সামলেছেন। তিনি রাজ্য দলের প্রাক্তন ফুটবলার বাবু সিং। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে নিজের জীবনের জন্যই লড়াই করতে হচ্ছে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। তবে এখানেও কিন্তু বিনা লড়াইয়ে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজি নন চনমনে স্বভাবের বাবু। ফুটবল মাঠে যেমন, জীবনের লড়াইয়েও ঠিক একই মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন শিলচরের এই প্রাক্তন ফুটবলার।
অনেকের কাছে ক্যান্সার নামটাই এক আতঙ্ক। ক্যান্সার কাবু করার আগে এর আতঙ্কেই অনেকে কাবু হয়ে যান। মনের দিক থেকে ভেঙ্গে পড়েন। লড়াই ছেড়ে দেন। তবে বাবু এমন বান্দা নন। তিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ও বুক চিতিয়ে লড়াই করছেন। একজন গোলকিপার হিসেবে যেভাবে একের পর এক দর্শনীয় সেভ করতেন, ঠিক সেইভাবে জীবনের ক্ষেত্রেও লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৯৩-৯৪ মরশুমে একজন বল বয় হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল বাবুর। টাউন ক্লাবের সিনিয়র দলের প্রাক্টিস সেশনে একজন বল বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। পেছনে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের হাতে বল তুলে দেওয়াই ছিল তার কাজ। এভাবেই একদিন টাউন ক্লাবের তৎকালীন কোচ প্রয়াতঃ অমৃতলাল দেবের নজরে পড়েন বাবু। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বাবুকে একজোড়া বুট কিনে দেন তিনি। এরপর টাউন ক্লাবের সিনিয়র দলের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতেন বাবু। ৯৪ সালে বিবেকানন্দ স্পোর্টিংয়ের হয়ে প্রথমবার দ্বিতীয় ডিভিশন ফুটবল খেলতে নামেন তিনি। সে ছিল তার সফরের শুরু।
প্রতিযোগিতায় বাবু এত ভালো পারফরম্যান্স করেন যে তার ডাক আসে সাব-জুনিয়র জেলা দলে। সেই শিলচর দলের কোচ ছিলেন ফকর উদ্দিন লস্কর। ম্যানেজার ছিলেন অসিত ধর। সেবার আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং দ্বিতীয় রাউন্ডে টাইব্রেকারে জয়লাভ করে শিলচর দল। টানা দুই ম্যাচে দুরন্ত পারফর্ম করে দলকে জয় এনে দেন বাবু। ফলে একজন গোলকিপার হিসেবে জেলা দলে তার এই পারফরম্যান্স রাজ্য দলের নির্বাচকদের বিশেষ নজর কেড়ে নেয়। ডাক আসে রাজ্য দলের ট্রায়াল ক্যাম্পেও। সেখান থেকে রাজ্য দলের মূল স্কোয়াডে জায়গা করে নেন বাবু। এরপর নিয়মিতভাবে অনূর্ধ্ব ১৬ ও অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগে রাজ্য দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জুনিয়র স্তরে ভালো পারফরমেন্স এর সুবাদে সন্তোষ ট্রফির জন্য সিনিয়র দলের ট্রায়ালও ডাক পান শিলচরের তারকা গোলকিপার। তবে দুবার সিনিয়র দলে ডাক পেলেও মূল দলে জায়গা পাননি।
খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে খুবই ভোকাল বাবু। একটা মিনিটও যেমন চুপ করে থাকতে পারেন না। তবে সেই লোকটার আজ কথা বলতে সমস্যা হয়। ফোনে খুবই আস্তে কথা বলেন। কদিন আগে তো সেটাও হচ্ছিল না। তবে এখন কিছুটা হলেও গলায় জোর এসেছে বাবুর। যদিও এখনো কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে। এবছর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার গলায় কিছু সমস্যা অনুভব করেন তিনি। প্রথমে বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে সমস্যা বাড়তে থাকায় চিকিৎসা করান। তবে বেশ কয়েক জন চিকিৎসককে দেখিয়েও তেমন লাভ হয়নি। অবশেষে ডাক্তার সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যর পরামর্শে গুয়াহাটি নাইটেঙ্গেল হাসপাতালে যান। সেখানে তার সার্জারি হয়। এরপর বায়োপসি রিপোর্টে ধরা পড়ে ক্যান্সারের বিষয়টা। তারপর থেকে কাছাড় ক্যান্সার হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। গত সপ্তাহে তার রেডিয়েশন শেষ হয়েছে। প্রথমে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর বাবুর মনে হয়েছিল, তার সঙ্গেই কেন এমনটা হল? তবে এরপরই নিজেকে সামলে নেন রাজ্য দলের প্রাক্তন গোলকিপার। সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। লড়াই করতে হবে। লড়াই করে মাঠে ফিরতে হবে।
জেলা দলের জার্সি গায়ে টানা প্রতিনিধিত্ব করেছেন শিলচর ইটখোলার ছেলে বাবু। তার বাবা চন্দন সিংও রাজ্য দলের প্রাক্তন ফুটবলার। আন্তঃজেলা সিনিয়র ফুটবলে তিন তিনটি রানারআপ দলের সদস্য বাবু। খেলেছেন স্কুল ফুটবলেও। শিলচরের ঘরোয়া ফুটবলে টাউন ক্লাব, পি ডব্লু ডি, ইন্ডিয়া ক্লাব, পিএইচ ই আরসি, গ্রীন হর্নেট, পুলিশ এসি, ইউনাইটেড ক্লাব, শিলচর স্পোর্টিং এবং অরুণাচল এস এসে খেলেছেন তিনি। শিলচরের অন্যতম সফল ফুটবলার বাবু। শুধু ফুটবলার হিসেবে নয়, একজন কোচ হিসেবেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। ২০০৮ সালে তার কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। এএফসির সি লাইসেন্স কোচ তিনি। একজন কোচ হিসেবেও ভালো রেকর্ড রয়েছে তার। সন্তোষ ট্রফিতে আসাম দলের সহকারী কোচ ছিলেন বাবু। তার কোচিংয়ে আন্তঃজেলা অনূর্ধ্ব ১৯ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় শিলচর দল। তার কোচিংয়ে একবার শিলচর মহিলা অনূর্ধ্ব ১৯ দল রানারআপ হয়েছিল। এছাড়া আসাম অলিম্পিকে শিলচর মহিলা দল তার কোচিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
গলায় সমস্যা দেখা দেওয়ার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে একবার বাইরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাবু। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা দেশে লক ডাউনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। এবার উন্নত চিকিৎসার জন্য আগামী ৪ আগস্ট মুম্বাইয়ের টাটা হাসপাতাল যাচ্ছেন রাজ্য দলের এই প্রাক্তন ফুটবলার। ক্যান্সারের মত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শুধু মানসিকভাবে জোর থাকলেই হয় না, আর্থিক ভাবেও সেভাবে শক্তিশালী হতে হয়। এখানেই আসল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বাবু। ১৯৯৫ সালে স্পোর্টস কটায় পি ডব্লু ডি তে একজন ক্যাজুয়েল কর্মী হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন। তবে আজ পর্যন্ত ক্যাজুয়েল কর্মী হিসেবেই থেকে গেছেন। চাকরিটা আর স্থায়ী হয়নি। কাজেই খুবই সীমিত বেতন পেয়ে থাকেন বাবু। চাকরিটা যাতে স্থায়ী হয়ে যায়, সেজন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেকেই তাকে সাহায্য করছেন। তবে চিকিৎসার জন্য আরও অনেক দরকার।
প্রাক্তন এই ফুটবলারের সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে প্রতিটা বার তাকে খুবই চনমনে মনে হয়েছে। সব সময়ই তিনি ফুটবল নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। স্পোর্টস নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। তাই তো ইটখোলায় তার বাড়িতে বসে যখন কথা হচ্ছিল বারবার উঠে আসছিল ফুটবল প্রসঙ্গ। খেলাধুলা প্রসঙ্গ। সবশেষে বাবু একটা কথাই বললেন, ‘আমি খেলা ভালোবাসি। ফুটবল ভালোবাসি। দেখবেন, একদিন ঠিক মাঠে ফিরব। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে, তবে ফিরবই।’ এই কথাগুলো বলার সময় বাবুর চোখে মুখে ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। ঠিক যেমন মাঠে গোলপোস্টের নিচে তাকে দেখা যেত, সেই একই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।
Comments are closed.