"সায়ন দাসের রিপোর্ট ডেথ অডিট বোর্ডে পাঠানোই হয়নি," চেয়ারম্যান; "স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন বাইরে থেকে আসা মৃতদেহের রিপোর্ট কোভিড বোর্ডে না পাঠাতে," ডাঃ স্বামী
বিলপাড়ের ২৬ বছর বয়সী যুবক সায়ন দাসের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, এখনও শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা গুয়াহাটির ডেথ অডিট বোর্ড তার মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট করে জানায়নি। বরাক বুলেটিনের পক্ষ থেকে বোর্ডের চেয়ারম্যান ডাঃ একে বর্মনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “সায়ন দাসের রিপোর্ট গুয়াহাটি পাঠানোই হয়নি। যেহেতু সরকারি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়নি, ফলে আপাতত তার মৃত্যুকে অডিট বোর্ড কোনভাবেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে না।”
অথচ মৃত্যুর পর শরীরে করোনা সংক্রমণ রয়েছে বলে কোভিড প্রটোকল মেনে সায়ন দাসের শেষকৃত্য করা হয়। তার পরিবারের সদস্যদের এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। এব্যাপারে তিনি বলেন, “এটা স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব, কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর পর যদি শরীরে সংক্রমণ থাকার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন এভাবেই শেষকৃত্য করতে হবে। তবে মৃত্যুর অডিট তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে সেটা বোর্ডের কাছে পাঠাতে হয়। তবে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মৃতদেহ বাইরে থেকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল ফলে তারা এর দায়িত্ব নিচ্ছেন না।”
উল্লেখ্য, নরসিংপুর এলাকার ৮৫ বছর বয়সী শান্তিবালা নাথের মৃত্যুর পর এলাকায় তার শেষকৃত্য করা হয় এবং পরে রিপোর্ট আসে তিনি পজিটিভ ছিলেন। তার মৃতদেহ শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বা অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়নি অথচ অডিট বোর্ড তাকে মৃত্যুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। পরবর্তীতে কিভাবে আরও নাম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? তবে সায়ন দাসের ক্ষেত্রে আলাদা মনোভাব কেন? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অডিট বোর্ডের কাছে নেই।
শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার অভিজিৎ স্বামী বৃহস্পতিবার জেলাশাসক কার্যালয়ে এক বৈঠকে যোগ দেন। তাকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা সম্প্রতি একটি ভিডিও কনফারেন্সে আমাদের বলেছিলেন, বাইরে থেকে কোন মৃতদেহ এলে সেই ব্যক্তির নাম ডেথ অডিট বোর্ডের কাছে না পাঠাতে। সায়ন দাসকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। রাত ২টো বেজে ২মিনিটে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, চিকিৎসকরা প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের স্যাম্পল পরীক্ষা হয়, একজন সদস্য পজিটিভ হন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতোই আমরা তার রিপোর্ট অডিট বোর্ডের কাছে পাঠাই নি।”
তার মৃত্যুর পর হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হচ্ছে। পরবর্তীতে সেই বয়ান পাল্টে যায় এবং বলা হয় ময়নাতদন্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুর কোনও পরিষ্কার কারণ জানানো হয়নি। এব্যাপারে হাসপাতাল সুপার বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী কোন মৃতদেহ বাইরে থেকে এলে তার ময়নাতদন্ত হবে এবং মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে হাসপাতালকে নির্দেশ দিতে হবে। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা কাজ। এখন পর্যন্ত দুই ব্যক্তির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে, তবে সায়ন দাসের ময়না তদন্ত হয়নি। হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী তার মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। তবে এই নিউমোনিয়ার বিশেষ একটা ধরন রয়েছে। কোন বিষাক্ত ঔষধ খেলেও নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তার মৃত্যুতে করোনা ভাইরাসের কতটা যোগদান ছিল সেটা জানা যায়নি।”
সায়ন দাসের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং গুয়াহাটির ডেথ অডিট বোর্ড নিজের মত করে সাফাই গাইলেও নানান প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। শিলচর সিভিল হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সেখানেই তাকে মৃত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপরও এম্বুলেন্সে মৃতদেহ শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরিবারের বয়ান অনুযায়ী রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ সিভিল হাসপাতাল থেকে তারা শিলচর মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অথচ মেডিক্যালের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাকে রাত দুটোয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিভিল হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল যেতে রাতের বেলা রাস্তায় আড়াই ঘন্টা সময় লাগেনা। কেন কর্তৃপক্ষের এক আধিকারিকের সঙ্গে অন্য আধিকারিকের বয়ান মিলছে না?
সায়ন দাসের মৃত্যুর পর তার ভাই সম্রাট দাস জানান, ৩০ জুলাই দিনের বেলা খানিকটা জ্বর ছিল। রাত নয়টা নাগাদ হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং মাথা ঘোরায়। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তাকে সিভিল হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। সে নিজে থেকে তৈরি হয় এবং অটোতে উঠে হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। রাস্তায় তার স্বাস্থ্যের অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। সিভিলে আধঘন্টা অপেক্ষার পর অ্যাম্বুলেন্সে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে এক গেট থেকে আরেক গেটে চিকিৎসার জন্য ঘুরতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। অনেক ঘুরাঘুরির পর চিকিৎসকদের দেখা মিললেও তারা চিকিৎসা করেননি। একটা ঘরে সায়নের অচেতন দেহটি রেখে দিয়ে পরিবারের সদস্যদের তার কাছাকাছি না যেতে বলা হয়। এর কিছুক্ষণ পর জানানো হয়, সায়ন দাস আর বেঁচে নেই এবং তার শরীরে করোনা সংক্রমণ রয়েছে। পরিবারের প্রত্যেকের পরীক্ষা করতে হবে। মায়ের শরীরের অবস্থা ভালো না থাকায় শেষ রাতে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে জানানো হয় মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করা হবে। সন্ধ্যেবেলা কোভিড প্রটোকল মেনে মৃতদেহ শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
অসুস্থ অবস্থায় প্রথমে সায়ন দাসকে সিভিল হাসপাতালে এবং পরে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মেডিক্যালের মতই সিভিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলেন সেখানে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সিভিল হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে কেন অ্যাম্বুলেন্সে করে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলো? এর উত্তরে সিভিলের সুপার জিতেন সিং বলেন, “তাঁর মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা করার অধিকার শুধুমাত্র শিলচর মেডিক্যাল কলেজের রয়েছে, তাই তাকে সেখানেই পাঠানো হয়েছে।” এতে আরো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যেমন, সিভিল হাসপাতালে কেউ মারা গেলে তার মৃত্যু হয়েছে ঘোষণার জন্য মেডিক্যালে পাঠানোর কোনও নিয়ম আছে কি? যদি মৃতদেহই পাঠানো হতো তাহলে অ্যাম্বুলেন্স কেন? শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা চিকিৎসার নামে কেন বসিয়ে রাখা হলো?
প্রাক্তন পুরকমিশনার রঞ্জন রায় পুরো ঘটনায় সায়ন দাসের পরিবারের পাশে ছিলেন। এব্যপারে তার প্রশ্ন “সায়নের মৃত্যুর পর সেদিন রাতেই পরিবারের সদস্যদের বলে দেওয়া হয়েছিল ময়নাতদন্ত হচ্ছে। এবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। তাহলে আমরা জানতে চাই, তার মৃত্যু কোথায় হয়েছিল? বাইরে থেকে মৃত অবস্থায় কোনও ব্যক্তিকে নিয়ে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে ময়নাতদন্ত হয়। যদি সায়নের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত না হয়ে থাকে, তবে কি তার মৃত্যু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হয়েছিল? যদি এমনটা হয় তাহলে, প্রমাণিত হচ্ছে হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়নি এবং এতেই প্রাণ গেছে। এমনটা হলে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য বিভাগকে এই মৃত্যুর দায় নিতে হবে।”
Comments are closed.