
শিলচর তো বটেই, গোটা বরাক উপত্যকার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় প্রকাশ ভগত। একটা সময় গোটা রাজ্যের মধ্যে সেরা বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন শিলচর ইটখোলার ছেলে প্রকাশ। দেশের শীর্ষ টুর্নামেন্ট রনজি ট্রফিতে একাধিকবার রাজ্য দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জুনিয়র স্তরে রাজ্য দলেও টানা খেলেছেন। আজও রাজ্যের প্রাক্তন ও বর্তমান ক্রিকেটাররা প্রকাশের গুণগান গেয়ে থাকেন। তবে এমন প্রোফাইল থাকা একজন ক্রিকেটার আজ আর্থিক অভাবে ভুগছেন। খুবই কষ্টে দিন কাটছে প্রকাশের। সংসারের অভাব মেটাতে ইটখোলাতে বৃদ্ধা মা-র সঙ্গে ডালপুরির দোকান চালাচ্ছেন।
আমাদের দেশে ক্রিকেট সম্পর্কে একটা ধারণা হচ্ছে, ক্রিকেট খেললেই কেরিয়ার বনে যায়। প্রচুর টাকা ক্রিকেটে। আইপিএলের যুগে এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এটাই একমাত্র বাস্তব নয়। বরাক উপত্যকার ক্রিকেটে তার সবচেয়ে বড় উদাহরন হলেন প্রকাশ ভগত। অথচ তার প্রোফাইল টা একবার দেখুন।
২০০৩ সালে আসামের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে (এন সি এ) ডাক পেয়েছিলেন প্রকাশ। সেবার অনূর্ধ্ব ১৭ বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে আসামের জার্সি গায়ে দুর্দান্ত প্রদর্শন করেছিলেন শিলচরের বাঁহাতি তারকা। বিহারের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে শিকার করেছিলেন ৭ উইকেট। সঙ্গে ছিল হ্যাটট্রিক ও। মূলত বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির দুরন্ত প্রদর্শনের জন্যই এন সি এতে ডাক পেয়েছিলেন প্রকাশ। সেই সময় ভারতীয় দল নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিউই স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে খেলার জন্য নেটে বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সৌরভ। কিন্তু সিরিজের ঠিক আগে চোটের জন্য ছিটকে যান বাঁহাতি স্পিনার মুরলি কার্তিক। ফলে ভারতীয় দলের নেট সেশনে ডাক পড়ে শিলচরের বাঁহাতি স্পিনার প্রকাশের। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রকাশ বলেন, ‘সেটা কখনো ভোলার নয়। আজও মনে আছে, নেটে সৌরভ গাঙ্গুলী আমায় দুটি বিশাল ছক্কা মেরেছিলেন।’ শুধু দাদা নন, ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ঈশ্বর’ শচীন তেন্ডুলকর থেকে শুরু করে বীরেন্দর শেওয়াগ, হরভজন সিং এবং ভিভিএস লক্ষণের মতো কিংবদন্তিদের নেট সেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রকাশ। সৌরভের কাছ থেকে টিপস ও পেয়েছিলেন।
প্রকাশের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত অনূর্ধ্ব ১৩ আন্তঃক্লাব ক্রিকেট দিয়ে। সেই টুর্ণামেন্টে সবার বিশেষ নজর কেড়েছিলেন শান্ত স্বভাবের প্রকাশ। সেই প্রদর্শনের সুবাদে তিনি ডাক পেয়ে যান অনূর্ধ্ব ১৩ জেলা দলে। জেলা দলেও প্রকাশের নজরকাড়া পারফরম্যান্স ছিল। যার ফলে তাকে পরের বছর অনূর্ধ্ব ১৪ রাজ্য দলে ডেকে নেয় আসাম ক্রিকেট সংস্থা (এ সি এ)। সে ছিল রাজ্য দলে প্রকাশের সফরের শুরু।
এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজ্য দলের বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক দলে টানা খেলে গেছেন প্রকাশ। অনূর্ধ্ব ১৬, অনূর্ধ্ব ১৭, অনূর্ধ্ব ১৯ এবং অনূর্ধ্ব ২২ রাজ্য দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন শিলচরের বাঁহাতি তারকা। রাজ্য দলের জার্সি গায়ে বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক টুর্ণামেন্টে ধারাবাহিক পারফর্মার ছিলেন তিনি। ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ মরশুমে টানা দু’বছর রনজি ট্রফিতে আসামের প্রতিনিধিত্ব করেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মোস্তাক আলী ট্রফিতে ও আসামের স্কোয়াডে ছিলেন।
২০০৭ সালে নুরুদ্দিন ট্রফি আন্তঃজেলা সিনিয়র ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল শিলচর। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন প্রকাশ। জেলা দলের অন্যতম সফল ক্রিকেটারের সঙ্গে একজন সফল অধিনায়ক ও ছিলেন তিনি। প্রকাশ এর নেতৃত্বে মোট চারবার আন্তঃজেলা সিনিয়র ক্রিকেটের ফাইনাল খেলেছে শিলচর দল। যা এক রেকর্ড। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, পরিবারের আর্থিক সমস্যার জন্য জেলা দল থেকে অবসর নিতে হয় প্রকাশকে। যদিও ক্লাব ক্রিকেটে এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
২০১১ সালে তার বাবা মারা যান। খুবই সাধারণ পরিবারের ছেলে প্রকাশ। তার বড় ভাইয়ের একটি চাটের এর দোকান রয়েছে। তবে গত দু’বছর থেকে করোনার জেরে সেটা বন্ধ। তারমধ্যে গত ছয় মাস থেকে তার বড় ভাইয়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় ইটখোলা তে প্রকাশ একটি ডালপুরির দোকান খোলেন। তাকে সাহায্য করছেন বৃদ্ধা মা। মাঝেমধ্যে বড় ভাইও সাহায্য করে থাকেন। তবে এ দিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটছে ভগত পরিবারের। আয় এর অধিকাংশই চলে যাচ্ছে ঘর ভাড়াতে। প্রকাশ বলেন, ‘কি আর বলব দাদা, সত্যি কথা বললে খুবই কষ্টে আছি। দোকান থেকে যা আয় হয়, সেটা দিয়ে কোনরকম দুবেলার খাবার জোটে।’
কয়েক বছর আগে প্রকাশ এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চার বছর সেখানে চাকরি করেছিলেন। সেটা দিয়েই ঘুরে দাঁড়াবার লড়াই করছিল ভগত পরিবার। কিন্তু তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহামারী করোনা। প্রকাশ বলেন, ‘একে তো প্রাইভেট চাকরি, তারমধ্যে করোনা। ফলে চাপ অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। কোম্পানির যা প্রত্যাশা ছিল, সেটা কোনভাবেই আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিল না। তাই একরকম বাধ্য হয়েই চাকরিটা ছেড়ে দেই।’ একরাশ হতাশা নিয়ে প্রকাশ বলেন, ‘এতটা বছর রাজ্য দলের হয়ে খেললাম, সুনাম অর্জন করলাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না। একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলাম না। অথচ, আমার সঙ্গে যারা রাজ্য দলের হয়ে খেলেছিল তাদের অধিকাংশই কিন্তু আজ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। ভালো সরকারি চাকরি করছে।’
শিলচরের বাঁহাতি তারকা জানান, রাজ্য দলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পর তাকে জেলা উপায়ুক্ত এর কার্যালয় থেকে একবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তখন কাছাড়ের জেলাশাসক ছিলেন গৌতম গাঙ্গুলী। তারপর তিনি জেলাশাসকের কার্যালয় সহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রকাশ মনে করেন, পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকলে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরও দীর্ঘ হতে পারত। আরও অনেক কিছু অর্জন করতে পারতেন। তবে তিনি মনে করেন যতটুকু অর্জন করেছেন, তার পেছনে দুজন ব্যক্তির বিশেষ অবদান রয়েছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে এই দুই ব্যক্তি এগিয়ে না এলে আজ প্রকাশ ভগত কে কেউ চিনত না। তারা হলেন, জেলা দলের দুই প্রাক্তন তারকা বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং ও সঞ্জীব রায়।
সত্যি, এমন একটা প্রোফাইল থাকার পরও আজ প্রকাশের এমন অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। গুয়াহাটিতে থাকলে হয়তো আজ প্রকাশ ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতেন। এটা কি আমাদের ক্রীড়া সংগঠকদের ব্যর্থতা নয়?
Comments are closed.