ফোনে গান শুনিয়ে করোনা আক্রান্তদের মনোবল বৃদ্ধি করছেন বিক্রমজিত বাউলিয়া, সুস্থ হলেন অনেকেই
করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অনেক লোকেই। নিয়ম অনুযায়ী তারা অন্যদের থেকে দূরে থাকবেন এবং একা থাকবেন। একাকিত্ব অনেকের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সম্প্রতি শিলচরে একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধ হোম আইসোলেশন আত্মহত্যা করেছেন। যেসব রোগীরা বাড়িতে থেকে কিছুটা অবসাদগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের মন ভালো করতে অত্যন্ত সুন্দর একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন শিলচরের প্রতিভাবান গায়ক বিক্রমজিত বাউলিয়া। তিনি সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পোস্ট করে বলেন, “যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে রয়েছেন এবং নিজেকে একা মনে করছেন, আমাকে ফোন করতে পারেন, আমি আপনাদের গান শোনাবো।” সঙ্গে তার ফোন নম্বর দিয়ে দেন বিক্রমজিত। এতেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের, তিন দিনে ২১৭ জন মানুষকে তিনি গান শুনিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
বরাক বুলেটিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বিক্রমজিত বাউলিয়া জানান, নিজে একসময় একাকিত্ব এবং খানিকটা মানসিক যন্ত্রনায় ভুগেছেন। তিনি জানেন একজন মানুষ একা হলে তার মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে তার নিজের অনুভূতি হচ্ছে যেকোনও অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে হলে গান শোনা উচিত। সম্প্রতি গায়ক লোপামুদ্রা মিত্রের একটি পোস্ট দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন এবং সিদ্ধান্ত নেন যারা ফোন করবেন তাদের গান শোনাবেন। তবে একটা ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এত লোকের সঙ্গে কথা হবে সেটা নিজেও ভাবতে পারেননি।
তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত ২১৭ জন লোক আমাকে ফোন করেছেন। শুধুমাত্র শিলচর শহর বা আমার পরিচিত মহলের লোকেরা নয়, লামডিং, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, রামকৃষ্ণ নগর, কলকাতা, মেদিনীপুর, গুজরাট, রায়পুর, দিল্লি, পুনে, ছত্তিসগড় থেকে অজানা অচেনা লোকেরা ফোন করছেন। কেউ বাংলা গান শুনতে চাইছেন, আবার কেউ কেউ অন্য ভাষায় গানের অনুরোধ রাখছেন। তবে শুধুমাত্র গান শোনা নয়, তারা আসলে নিজেদের অনুভূতিটুকু আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছেন। গান শোনানোর পর অনেকে কথা বলতে চান। হাইলাকান্দির প্রায় ৮০ বছর বয়সের এক মহিলা রোজ সকালে আমাকে ফোন করেন, তাকে দুটো গান শুনাই, বাকিটা গল্প করে কাটে। আজ সকালে তিনি ফোন করে জানালেন, তার রেজাল্ট নেগেটিভ হয়েছে। সঙ্গে বললেন, তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। গান শোনার পর তার মনে বেঁচে থাকার আশা আরেকটু বেশি হয়েছে, ফলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছেন। অবশ্যই এটা তার মানসিক জোর। তবে এই ঘটনায় আমি নিজে অত্যন্ত আপ্লুত। উনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি।”
বিক্রমজিত বাউলিয়া, আসল নাম বিক্রমজিত কর, ছোটবেলা থেকেই গান ভালবাসেন। একসময় জি-বাংলা সারেগামাপায় অডিশন দিয়েছেন। ভালো গান গাওয়ার পরেও তিনি সেরা দশে স্থান করে নিতে পারেননি। এতে তার মনোবল একেবারেই ভেঙে যায় নি, কেননা তিনি আদতে গানকে ভালোবাসেন। যেকোনও অনুষ্ঠানে তিনি আপন-মনে গান ধরেন এবং তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে আনন্দময়। শিলচর শহরে ঘরে ঘরে বিক্রমজিত বাউলিয়া বহুদিন ধরে পরিচিত নাম। তবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মনোবল বৃদ্ধি করতে তার এই পদক্ষেপ এখন সারাদেশে বহুচর্চিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর পেয়ে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন।
গান ভালোবেসে গান করলেও শিলচর শহরে দাঁড়িয়ে গানের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা কঠিন। তাই বাবার মেডিসিন ফার্মেসিতে বসে ঘরের ব্যবসায় সহযোগিতা করেন বিক্রম। আবার এর মধ্যেও তিনি করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কাজের ফাঁকে মুখে ডাবল মাস্ক লাগিয়ে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের গেটে পৌঁছে দিচ্ছেন ঔষধপত্র। অনেকে সঙ্গে আবার খাবার দাবার সহ অন্যান্য জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছেন। তারা অনলাইনে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন এবং সেই টাকা দিয়ে খাবার সহ ঔষধ বাড়ির গেটে পৌঁছে দিচ্ছেন বিক্রমজিত বাউলিয়া।
এব্যাপারে তিনি বলেন, “আমি দেখেছি কলকাতা বা দিল্লির মত শহরে তরুণ প্রজন্ম কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমি চাই আমার শহরেও এভাবেই প্রত্যেকে একে অন্যের পাশে দাঁড়ান। তবে এই কথা অন্যদের বলার আগে আমি নিজে কাজটি করে দেখাতে চাইছি। খুব একটা বেশি কষ্ট না হলেও যখন কাউকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌছে দিচ্ছি, তাদের মনের শান্তিই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি হয়ে উঠছে। শুধু শিলচরে নয় শহরের বাইরে সোনাই ইত্যাদি এলাকায় পর্যন্ত ওষুধপত্র এবং খাবার-দাবার পৌঁছে দিয়েছি আমি, অবশ্যই সেটা নীরবে। এই দুঃসময় আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছে, একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর। এই সুযোগে আমরা প্রত্যেকে সমাজের দায়িত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারি।
তবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে কোনও ভাল কাজ করলেও ট্রল হতে হয়, এটাই আজকের সমাজে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সুন্দর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরেও বিক্রমজিত বাউলিয়াকে শুনতে হয়েছে, তিনি নাকি পাবলিসিটি স্টান্ট করছেন। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “মেন্টাল হেলথ ব্যাপারটা এখনও অনেকে বুঝে উঠতে পারেননি। কঠিন পরিস্থিতিতে একে-অন্যের মনোবল বৃদ্ধি করা কতটুকু জরুরি, সেটা বোঝা এখন প্রত্যেকের দরকার। তবে যারা নিন্দা করবেন তাদের মুখে মুখে উত্তর দিয়ে তো লাভ নেই। আমি স্বচ্ছ মনে কাজ করছি এবং এই কাজের মাধ্যমে নিজে আনন্দ পাচ্ছি এটাই সবথেকে বড় কথা।”
Comments are closed.