"হাজারো স্মৃতি বহন করা শিলচর এখনো আমার প্রাণের শহর", বলছেন 'পরবাসী' সুলেখা, নীলাক্ষী
“হাজারো স্মৃতি বহন করা শিলচর এখনো আমার প্রাণের শহর”, বলছেন ‘পরবাসী’ সুলেখা, নীলাক্ষী
শিলচর। চার অক্ষরে সমৃদ্ধ। একটি শহরের নাম। কিন্তু আমাদের কাছে শিলচর শুধু নিছক একটি শহর নয়। এক আকাশ ভালোবাসা। এক বুক অভিমান। গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যাওয়া। যারা শিলচরে থাকেন তাদের জন্য এটি ‘আমার শহর’। কিন্তু যারা শহর থেকে অনেক দূরে প্রবাসে থাকেন তাদের হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে এই শহর শিলচর। আসলে কর্মসূত্রে কিংবা আরও বিভিন্ন কারণে প্রবাসে থাকলেও জড়টাতো রয়ে গেছে শিলচরেই।শহরটা আজও অস্তিত্বের অনেকটা জুড়ে আছে।
সেই পুরোনো দিনের গল্প, শহর ঘিরে অফুরান স্মৃতি, সুখে দুঃখের অফুরন্ত কথা যাতে করে ভাষা খুঁজে পায়, তাই যারা শহর থেকে দূরে অন্য শহরে কিংবা অন্য দেশে থাকেন তাদের কথা ভেবেই আমাদের এই নতুন কলাম। এখানে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি অন্যান্যরাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাদের স্মৃতি, শহর ঘিরে অনুভূতি, ভালোলাগা, হারিয়ে যাওয়া কথা আমাদেরকে মেইলের মাধ্যমে লিখে পাঠাতে পারেন।
সুলেখা ভট্টাচার্য্য
গৃহবধূ
বেঙ্গালুরু
অনেকদিন আগেই লেখার কথা ছিল কিন্তু বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা শিলচরকে ঘিরে অনুভূতি ভালোবাসা সুখ-দুঃখ লিখতে গিয়ে আমি অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম…. আবার সাহস করেও উঠতে পারিছিলাম না, কি লিখতে কি লিখে বসি…… আমার মত যারা শিলচরকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসেন তারা বুঝতে পারবেন, যখন কোন কিছুর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা থাকে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করাটাও সহজসাধ্য নয়। এ ভালোবাসা আসলে শিলচরের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে…. তা লিখে প্রকাশ করা চাট্টিখানি কথা নয়। আসলে অদ্ভুত একটি জাদু আছে আমাদের শিলচরের মাটির….।
শিলচরের প্রতি প্রেম,অনুভূতিটা বলে বুঝাতে পারব না। আমার পরিবার এবং আমার শিলচর হচ্ছে আমার প্রথম প্রেম এবং শেষ প্রেমও। শিলচরের কোনো দোষ, ত্রুটি থাকতে পারে আমার মন কেন জানি না সেটা মানতে চায় না। আর দোষ থাকলেই বা কি… তাই বলে আমার মাতৃভূমিকে নিয়ে কোনো নৈরাশ্যবাদী কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না।
প্রিয় শহর থেকে দূরে থাকায় কারোর ফোন এলেও আমি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে দেই,
শিলচরের কি খবর? ওয়েদার কেমন? কারেন্ট আছে কিনা? প্রেমতলায় এখন কেমন ভিড়? পুজোর জন্য বাজার স্বভাবতঃই গরম, এখন তো শুরু হয় আরো বাড়তি প্রশ্নের বাহার, পুজোর বাজারে ভিড় কেমন? পুজোর বাজার কেমন জমল? এখন কেমন চলছে প্যান্ডেলের কাজ? কি কি থিম এবার পুজোয়? এত শুনে শুনে মা তো সেদিন বলেই বসলেন, সাথে করে শিলচরকে নিয়ে গেলি না কেন? হা হা হা……কি মজা হতো তাহলে!!
উনিশে মে, যা আমাদের শহরের অহংকার, সেই দিনটিতে শিলচরের কথা বড় বেশি মনে পড়ছিল। ভীষণভাবে মন ভারি হলো। সকালে উঠে প্রত্যেক বছর শিলচর মহাশ্মশানে যেতাম একাদশ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে…. পুরো শহর এই দিনটি আসার আগে ১৫ দিনব্যাপী এক অদ্ভুত প্রস্তুতি নিত, তা এবার দেখতে পেলাম না।
মন খারাপের পালা শুরু হলো রং খেলা থেকে, তারপর নববর্ষ, ঈদ, মনসা পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো একে একে তালিকাটা বড় হচ্ছিল। কিন্তু মহালয়ার কথা এই মুহুর্তে মনে আসতেই কেমন জানি হয়ে গেলাম। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই আমরা সকালে বেরিয়ে পড়তাম রাস্তায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী শোনা মাত্র…….. সত্যি বোধ হতো মা দুর্গা আসছেন। পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে, সেটা পুরো পরিবেশ বলে দিত। সেই ছোটবেলা থেকে বাবাকে নিয়ম করে তর্পণ করতে দেখতাম, পুজোর তিনদিন বাবার কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার সৌভাগ্য, পুজোর চারদিন পরিবার, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে চুটিয়ে মজা করা, রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো আর সুস্বাদু খিচুড়ি…… সবটাই আজ মন খারাপের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, সবই আজ ফিরে দেখতে হচ্ছে। কারণ বিবাহ সূত্রে ৭-৮ মাস হল আমি শিলচর থেকে দূরে প্রবাসে রয়েছি।
আর একটা জিনিস যা আমি খুব মিস করছি সেটা হচ্ছে শিলচরের ফুচকা……. আহারে, লিখতে লিখতে জিভে জল এসে পড়ল…… সেই আমার প্রিয় প্রেমতলার ফুচকা…… গোলদীঘির মল এর বিপরীতে…… সেরার সেরা ফুচকা……ঝালফুচকা…. আহা!!!!
আমি মিস করি শিলচরের অটো চলাকেও…..আমার সবচেয়ে প্রিয় যানবাহন। ঘর থেকে বেরুলেই আমার অটো চাই। সেটার আরাম আমি গাড়িতেও পাই না।
“দাদা যাইবায় নি?” এই কথাটা আর বলা হয়ে ওঠেনা আজকাল। এখন ঘর থেকে বেরুলেই সিলেটি কথাও শুনি না। সিলেটি কথাও সত্যি খুব মিস করি…।
বরাক নদী, গান্ধীমেলা,দেবদূতের সেই বিখ্যাত চাট হাউস, চৈত্র সেল ……..খুঁটিনাটি অনেক কিছুরই প্রতিনিয়ত মনের ঘরে আনাগোনা। তাই বলতে পারি,শহর থেকে দূরে প্রবাসে বসেও আমার প্রিয় শহরটাকে মনের আয়নায় দেখতে পাই প্রতিনিয়ত।
নীলাক্ষী (পুরকায়স্থ)ভট্টাচার্য্য
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত
কলকাতা
শিলচর।এ নামটাতেই প্রচণ্ড টান রয়েছে। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জুড়ে আছে শিলচরের সঙ্গে। পুজো প্রায় দোরগোড়ায়। তাই হয়ত আজকাল শিলচরের কথা বেশি মনে পড়ছে। আমি ছোটবেলায় যেখানে থাকতাম, তার কাছাকাছি ‘কৃষ্টিবিবেক সাংস্কৃতিক সংস্থা’ ক্লাবের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িত ছিলাম। সেখানে দুর্গাপূজা হত।তাই পুজোর আগে মায়ের আগমনী অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিজয়া সম্মেলনী পর্যন্ত সে যে কি ব্যস্ততা! প্রচণ্ড হুলুস্থুল করতাম চাঁদমারীর কৃষ্টিবিবেকের পুজোয়। আজও খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা।
আমি কলকাতার এক জনবহুল ও প্রখ্যাত এলাকায় থাকি। সেখানে পুরোপুরি বাঙালি পরিবেশ। কিন্তু তাও যেন কিছুর অভাব সব সময়ই বোধ করি।কোথায় একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে। আজও শিলচর থেকে দূরে থাকলেও যদি কখনো শিলচরের প্রসঙ্গ উঠে মন মেজাজ স্বাভাবিকভাবেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। শিলচরকে ভীষনভাবে মনে হয় বিভিন্ন পরবে। যেমন মহালয়ার সে কাক ভোরে উঠে বরাক ব্রিজে জড়ো হওয়া। বিশেষভাবে দুর্গাপূজার চারদিন খুবই বেশি মনে পড়ে। কলকাতার পুজো বিশ্বখ্যাত। কিন্তু তার মধ্যেও যেন মনটা ছটফট করতে থাকে জন্মস্থানের টানে। একই ভাবে মনে হয় ঝুলন পূর্ণিমার কথা। সবাই মিলে উঠোনে বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে ঝুলন পূর্ণিমা পালন করা ছিল আমাদের খুব প্রিয়। এই পর্ব গুলো খুবই মিস্ করি। বিভিন্ন কারণে বিগত চার বছর ধরে আমার পুজোর সময় শিলচর যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাই যেন আরো বেশি মনে পড়ে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, সবার সঙ্গে মিলে পুজো ঘুরে দেখা, বাইরে খাওয়া দাওয়া। সবচেয়ে অমূল্য ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের খিচুড়ি। সে যে কত সুমধুর অভিজ্ঞতা। আমরা পাগল থাকতাম মিশনের খিচুড়ি খাওয়ার জন্য।
খাবার প্রসঙ্গ উঠতেই মনে পড়ে গেল, ঝালুপাড়ার মমো। আহা…… মনে করলে এখনো জিভে জল এসে যায়। তখন ফাস্টফুড বলতে আমরা এটাই বুঝতাম। থ্যাংক ইউ চাট, কল্পনা’র রাধাবল্লভী, অমৃত সুইটস এর সিঙ্গারা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দই, পরোটা পট্টির পরোটা, গান্ধী মেলার জিলাপি ও চাট। আরো যে কত সুস্বাদু খাবার!!তালিকা হয়ত শেষই হবে না।
সবার উপরে আমি মিস করি আমাদের শিলচরের মানুষের আন্তরিকতা। যা বর্তমান মেট্রো সিটি লাইফে দুষ্প্রাপ্য। তাও আজকাল ডিজিটাল মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক সময় বন্ধুদের কাছ থেকে শিলচরে বিভিন্ন খবর অনায়াসেই পেয়ে যাই।
অনেক সময় যখন কলকাতার রাস্তায় চলার পথে হঠাৎ করে শুনতে পাই সেই আমার নিজস্ব ভাষা সিলেটি, তখন নিজেকে আটকাতে পারি না। যেচে কথা বলে ফেলি। কি আনন্দ যে অনুভব করি তা ব্যক্ত করা দুরূহ।
একবার কলকাতার বইমেলা দেখে বেরুনোর সময় হঠাৎ শুনতে পাই দোহারের গান। তখন রাত ৯.৩০ বা দশটা হবে। দেরি হয়ে গেলেও সেই বহুমূল্য মুহূর্তকে এমনি যেতে দিতে চাইনি। তাই কোনার একখানা সিট জোগাড় করে বসে প্রসাদের গান উপভোগ করলাম ও মনে মনে গর্ব বোধ করলাম, যে কালিকাপ্রসাদ আমাদের শিলচরের ই ছেলে। লেখার যে কোনো শেষ নেই।কলম থামতেই চাইছে না। কারণ কলম যে এবার আমার প্রিয় শহর শিলচরের কথা ভাষায় ফুঁটিয়ে তুলতে সাহায্য করছে।
Comments are closed.