সুপারির ছই
অফিসের কাজে গৌহাটি যাচ্ছিলাম । এইসময়ে কিছুতেই যাবার ইচ্ছে ছিল না । চারিদিকে একটা আতঙ্ক, প্রতিদিন সংখ্যাটি যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কার কাছ থেকে যে কে কিভাবে সংক্রামিত হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাড়িতে প্রচন্ড আপত্তি, সেটাই স্বাভাবিক । আমার নিজেরও খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু অফিস বলে কথা! এখন না গেলে ফাণ্ড পাওয়া খুব কঠিন । যাওয়াটা ভীষণই জরুরি। নাইট সুপার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে বটে। ইচ্ছে করলেই যাওয়া যেত। লোক তো যাচ্ছেই। কিন্তু বাড়িতে কিছুতেই মেনে নিতে রাজি নয়,মা মেয়ের সাথে সেই নিয়েও একচোট হুলুস্থুল।পাবলিক বাসে গেলে নাকি ইনফেকশন হবার চান্স খুব বেশি। অগত্যা পনেরো হাজার টাকা দিয়ে একটা ইনোভা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। অফিস থেকে পুরো টাকা দেবে না জানি, তবু আমি নিরুপায়। আমাকে নিয়ে যাবে, পরদিন সারাদিনে কাজ সেরে, তারপর দিন আমাকে নিয়ে ফিরে আসবে। ড্রাইভারের থাকা, খাওয়া সবটাই অতিরিক্ত। প্রথমে ভেবেছিলাম শিলং হয়ে যাই,খরচ কম হতে পারে,কিন্তু মেঘালয় পুলিশের ভীষণ রকম কড়াকড়ির খবর পেয়ে হাফলং হয়ে যাওয়াটাই স্থির করেছি। হাফলং’য়ে মাইলেজ একটুবেশি, তাই ভাড়াটাও স্বভাবতই সেইমত হবে ।
সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পরেছি আমরা। আরো একটু পরে বেরোলেও চলতো, কিন্তু আম্ফান পরবর্তী সময়ে আজ দুদিন ধরে এদিকটাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছে । প্রচণ্ড বললেও ভুল বলা হবে না । তাই কোন ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে বলে মনে হলো না । গাড়িতে আমরা দুজন মাত্র যাত্রী । আমি আর জীবন । জীবন আমার গাড়ির ড্রাইভার, ওই চালাচ্ছে, আমি পাশে বসা। বাড়ি থেকে আমার স্ত্রী খুব যত্ন নিয়ে আমাদের দুজনের জন্যে দুবেলার পরিমাণে অনেকটা খাবার প্যাক করে দিয়েছেন। সাথে এক কার্টুন মিনারেল ওয়াটার । আর অবশ্যই সেনিটাইজার ও বেশ কিছু মাস্ক।
এমনিতেই লকডাউনের জন্যে গাড়ি চলাচল খুব কম। তার উপর বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ভারি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। আকাশের যা অবস্থা তাতে থামবার কোন লক্ষণ নেই।খালি রাস্তায় জীবন গাড়ি চালাচ্ছে উদ্দাম গতিতে। ওর উপর আমার আস্থা আছে । স্টিয়ারিংএ তার নির্ভুল নিয়ন্ত্রণ। তবু অভ্যাসবশতঃই বার দুয়েক সাবধান করলাম ওকে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। গাড়ির কাচ তুলে হালকা করে হিটার দেওয়া । নইলে ভেতর ঘেমে যায়। আবার গরমও লাগে । একটু খুলি আবার বন্ধ করি এই করেই চলছি। একটা সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই। ডলু হাসপাতাল ছেড়ে একটু এগিয়েই মহালক্ষ্মী রিসোর্ট। জীবনকে বললাম, একটু দাঁড়া, এককাপ চা খেতে হবে। বৃষ্টি একটু হালকা হয়েছে, তবে আকাশ এখনও ঘন কালো। আরো বৃষ্টি আছে ।
গাড়ি পার্কিং করে একছুটে রিসোর্টের সেডে হাজির । আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি, তাই এককাপ চা সাথে টমেটো চিলি স্যুপ আর ক্রুটনস। জীবনের জন্য একপ্লেট ছোলাবাটুরী, ডাবল ডিমের ওমলেট সাথে চা। আমি চা শেষ করে জমিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। জীবনের একটু সময় লাগবে। ক্যামেরা না এনে ভুল করছি মনে হচ্ছে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উপভোগ করার মত। বৃষ্টি দেখেই ক্যামেরাটা আনতে সাহস করি নি। এখন মনে হচ্ছে আনলে ভালো হতো ।
একখানা আস্ত পান আর আধখানা সুপুরী মুখে পুরে জীবন গাড়িতে স্টার্ট দিতেই গাড়ি আবার আপন গতিতে। রাস্তা মোটেই ভালো না। খারাপ জেনেই এসেছিলাম কিন্তু এতটা খারাপ আশা করি নি। জীবন খুব সাবধানে ভাঙা, গর্ত এড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি একটু নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিলাম। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, খুব বেশি দূর দেখা যায় না। গাড়িতে হালকা সুরে চলছে হিটস অব মুকেশ। জীবনের রুচি আছে বটে। সবকটি গানই আমার জানা ছবি থেকে। বেশির ভাগ মনোজ কুমার, রাজেশ খান্নার ছবি। গানগুলো শুনতে শুনতে আমি আমার কলেজ জীবনে চলে গিয়েছিলাম। কলেজ পালিয়ে ষাট পয়সায় সেকেন্ড ক্লাস টিকিটে সিনেমা দেখা। সে একদিন গেছে সত্যি! কলেজ পালিয়ে সিনেমা, গান্ধীবাগের ব্রেঞ্চে বসে এক সিগারেট তিনজনে ভাগ করে খাওয়া, কান ঢাকা রাজেশ খান্না কাটিং চুল, বলবেটম প্যান্টের সাথে কাঠের উঁচু হিলের জুতো আর পম্পা, টুম্পি, রুমির সাথে পায়েল কখন বাড়ি ফিরবে তারই অপেক্ষায় কাঠের গুদামে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করা। সত্যি, মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি তেমন ব্যবস্থা থাকতো তবে পৃথিবীর অর্ধেক লোকই আবার শৈশবে ফিরে যেতে চাইতো।
বালাছড়া ছাড়িয়ে টিবংছড়া খাসিয়াপুঞ্জির পাশ দিয়ে যাচ্ছি । একপাশে খাঁড়া পাহাড়, অন্যপাশে গভীর খাদ । আশেপাশে কোন বাড়িঘরের চিহ্ন নেই। রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। কচ্চিত্ উল্টোদিক থেকে একটা বা দুটো গাড়ি আসছে। শুধু আমাদের সামনে একটা নীল ওয়াগনার। ওদেরও নিশ্চয়ই যাওয়াটা জরুরি, তাই এই দুর্যোগের মধ্যেও যাচ্ছে । হঠাৎই নজরে পড়ল বৃষ্টিতে আম জাতীয় একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটা বুড়ি লিফট চাইছে। সমস্ত শরীর একটা কাঁথা জাতীয় কিছু দিয়ে ঢাকা। মুখটুকু শুধু দেখা যাচ্ছে। তাতে বয়স ষাটও হতে পারে, আশিও হতে পারে। বোঝা মুশকিল। পাহাড়িদের চেহারাই এমনি। মুখের ভাঁজ দেখে বয়স অনুমান করা খুব কঠিন। সবটাই ভিজে একশা। গাছটা তেমন কোন বড় গাছ নয়, বেচারির ভিজে একদম খুব খারাপ অবস্থা। এখানে দাঁড়ানোর মত জুতসই জায়গা দেখতে পেলাম না। লিফট নিতে হলে বৃষ্টি ভিজেই দাঁড়াতে হবে, আর বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে। আমার আগের গাড়িটাকেও সিগন্যাল দিয়েছিলেন কিন্তু দাঁড়ায় নি। আমার জীবনও দাঁড়াতে চাইছিল না। আমি ধমকে উঠলাম । বললাম, গাড়ি ব্যাক করো।
— কিন্তু অচেনা রাস্তায় এভাবে দাঁড়াতে নেই স্যার। দেখলেন না আগের গাড়িটা —।
— কে কি করছে সেটা দেখে তোমার লাভ নেই । আমি যা বলছি সেটাই তুমি করো।আমি রীতিমতো ওকে আদেশ করলাম।
পুরো গাড়িটি খালি যাচ্ছে, একটা লোক যদি এই দুর্দিনে লিফট পায় ক্ষতি কি? বয়ষ্ক বৃৃদ্ধাটি ঠান্ডায় কাঁপছে। আমার কেন জানি না খুব মায়া লাগলো। আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁহা জানা হ্যায়।
— লামডিং ।
— অন্দর আজাও।
— ভাড়া কিতনা হোগা ।
আমি হেসে বললাম, কুছ নেহি চাহিয়ে ।
বৃদ্ধাটি খানিকটা ইতস্তত করে একছুটে গাড়ির ভেতর এসে বসলো ।
মহিলাটির কাপড় চোপড় প্রচণ্ড নোংরা। কেনার পর বোধহয় আর সাবান লাগানো হয়নি ।গায়েও তেমনি বিশ্রি গন্ধ। স্নান করে না বোধহয়। জীবন চট করে নাকে মাস্ক লাগিয়ে নিল। আমিও দেখাদেখি তাই করলাম। কিন্তু তাতেও গন্ধ যাচ্ছে না। জীবন খুব বিরক্ত। বললে স্যার, গ্লাস খুলে দেবো কি ?
আমি বললাম, না প্রয়োজন নেই, তুমি বরং একটু স্প্রে চালিয়ে দাও।
স্প্রে দেওয়াতে কিছুটা কমলো বটে কিন্তু পুরোপুরি কাটলো না ।
কারো মুখে কোন কথা নেই । গাড়ি ছুটছে । আমি দ্বিধাগ্রস্ত, কাজটা ঠিক করলাম কিনা। চুপচাপ আনমনে গান শুনছি আর ভাবছি।
— আপলোগকা পাশ একঠো চাদর হোগা। তক্ষুণি মনে হলো সত্যিতো, আমার অনেক আগেই একটা চাদর অফার করা উচিত ছিল। ইশ্,বেচারি এতক্ষণ ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছেন।বললাম, এক মিনিট।
জীবন আমার মতলব বুঝতে পেরে আস্তে করে বললে, স্যার কি দরকার !
আমি বললাম , আছে তো এক্সট্রা, টেনশন নিচ্ছো কেন ?
মনে মনে ভাবলাম, গৌহাটিতে একটা নতুন চাদর কিনে নেবো না হয়, তবু মানুষটা একটু আরাম পাক।
ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে দিলাম।
আবার সবাই চুপচাপ। বৃদ্ধাটি গাড়িতে চড়ার পর থেকেই যেন গাড়ির আবাহাওয়া পাল্টে গেছে। জীবনের মুড অফ। ওর চালানোটা আমার এই মুহূর্তে খুব রাফ লাগছে , ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আমিও চুপচাপ।
একটু পরে সেই বৃদ্ধাটি আবার পেছন থেকে বললে, আপলোগকা পাশ কুছ খানা হোগা ।
জীবন হেসে বলল, নিন, এবার ঠেলা সামলান । তারপর নিজেই পিছন ফিরে বলল, নেহি হ্যায়, চুপচাপ বইঠে রহো, নেইতো উতার দেয়গা।
আমি ওকে থামিয়ে বললাম, আহা ওমন করছো কেন ?
তারপর নিজের ব্যাগ থেকে দুটো রুটি কিছুটা সব্জি দিলাম, খুব তৃপ্তি করে খেলেন।
জীবনকে চোখের ইশারায় একটুখানি নজর রাখতে বলে শরীরটা সিটের পিঠেই এলিয়ে দিলাম।চোখটা লেগে গিয়েছিল, আমরা সম্ভবত হাফলং সবেমাত্র পেরিয়েছি।
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলছে গাড়ি।খুব সাবধানে। আঁকা বাঁকা পথ তার উপর ভাঙা। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু গুমোট ভাবটা এখনো আছে। হঠাৎই জঙ্গলের মধ্যেই বৃদ্ধাটি গাড়ি থামাতে বললেন ।
এই ঘন জঙ্গলে, এখানে !
একটা ভীষণ অদ্ভুত জায়গা, চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা, তার মধ্যেই একটা সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে। একটা নাম না জানা পাখি কাছেই কোথাও ডেকে উঠলো। আওয়াজটা অদ্ভুত করুণ। নিস্তব্ধ এই পরিবেশে শুধু এই একটি আওয়াজ বারবার এদিক থেকে ওদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। যেন আমাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল, এখানেও প্রাণ আছে। একটা গা ছমছম করা পরিবেশ।
আমি বললাম, কুছ কাম হ্যায় বুড়িমা ?
— হ্যা ।
আমি জীবনকে ইশারাতে গাড়ি থামাতে বললাম । মনে হলো হয়তো প্রাকৃতিক কোন কাজে থামাতে বলেছেন ।নইলে এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গাতে কি কাজ থাকতে পারে উনার।
বৃদ্ধাটি গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশের ঝোপ ঝাড় থেকে কিছু ফুল তুলতে লাগলেন। আমি ভাবছি এ আবার বুড়ির কি পাগলামি শুরু হলো। আমাকে অবাক করে বুড়ি একটা ফুলের তোড়া তৈরি করলেন। তারপর সেই তোড়া নিয়ে পাশেই একটু জঙ্গল মতো জায়গাতে হাটু গেড়ে বসে পড়লেন। কি আশ্চর্য, অবাক হয়ে ভাবছি, আচ্ছা ঝামেলায় ফেঁসেছি তো। এই জঙ্গলে বুড়িটি আবার কি করছে এইসব। এদিকে আমাদের অনেকটাই দেরি হয়ে যাচ্ছে । বুড়িটা দেখছি উঠতেই চাইছে না। সেই নীল ওয়াগনারটি হয়তো খাওয়া দাওয়ার জন্য হাফলংয়ে দাঁড়িয়েছিল খানিকটা, এইবার এইটাও এসে পেছন থেকে হর্ণ দিচ্ছে।জীবনকে বললাম, যা, দেখতো কি করছেন । এত সময় লাগছে কেন ?
জীবনের তাড়াটা একটু বেশিই। বললে, স্যার, চলুন গাড়ি স্টার্ট দিই। যদি দেখে ফেলে চলে যাচ্ছি , তখন নিজে থেকেই ছুটে আসবে ।
বললাম, ছিঃ , এইটা ঠিক না । আফটার অল একজন বিপদে আমাদের সাহায্য চাইছেন, তার সাথে এইসব করা ঠিক না।
জীবন কাছেই গেল না, দূর থেকেই বুড়িটাকে তাড়া দিতে লাগল। বুড়িটা একবার কটমট করে ফিরে তাকিয়ে আবার একইভাবে বসে আছে। বুঝলাম ওর দ্বারা হবে না। বললাম, তুমি ওয়াগনারটাকে পাস দাও, আমি ওইদিকটা দেখছি।
আস্তে আস্তে বুড়িটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি বুড়িটা একটা খুব সাদামাটা কবরের সামনে বসা, প্রার্থনা করছেন। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। মনটা উদাস হয়ে গেল। নিশ্চয়ই খুব প্রিয় বা কাছের কোন মানুষ। এদিকে আমাদেরও যে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আস্তে করে বললাম, বুড়ি মা, অব চলিয়ে।
জীবনের এত হাঁক ডাকেও যিনি উত্তর দেননি, আমার আস্তে ডাকই কিন্তু ঠিক শুনতে পেলেন। বসা অবস্থাতেই আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখি, বুড়িটা কাঁদছে।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মনে হল, কি আশ্চর্য মানুষের মন। আমরা তিনটে লোক একসাথে একটা গাড়িতে চলেছি অথচ তিনজনের ভিতরে তিনটে ভাবনা কাজ করছে।
বাবার কাছে ছোট বেলা শুনেছিলাম, প্রত্যেকটি মানুষই নাকি এক একটা আলাদা সত্ত্বা। শরীর তো অবশ্যই, মনের দিক থেকেও প্রত্যেকেই নাকি আলাদা হয়, ভাবনায়, চিন্তায়। আর এই যে আমাদের যূথবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা সে আমাদের নিজেদের স্বার্থে একটা সমঝোতা মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। এক একবার মনে হয় হয়তো বাবাই সত্যি, আবার মনে হয় তবে এই যে নিঃস্বার্থ দয়া মায়া ভালবাসা এগুলো তাহলে কি ?
এমনি সব এলোমেলো ভাবনায় ডুবেছিলাম, দেখি বুড়িটা আর বেশি দেরি না করে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসেছেন। আমিও চুপচাপ। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে।
দূরে দেখা যাচ্ছে নীল ওয়াগনারটা আমাদের আগে আগে ছুটছে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে এক একবার নজরে আসে আবার হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আড়ালে। এভাবেই লুকোচুরি খেলতে খেলতে আমরা এগিয়ে চলেছি।
কতটা সময় হবে সঠিক ভাবে জানি না, বড়জোর মিনিট দশেক, হঠাৎই মনে হলো উপরে পাহাড়ে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে। কিছু একটা পড়ার আওয়াজ বা ওই জাতীয় কিছু একটা শব্দ। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই বুড়িমাটি চিৎকার করে উঠল, মন্টু রুক্ যা। একটা আচমকা প্রচণ্ড কর্কশ চিৎকার। মনে হচ্ছিল যেন কানের পর্দা ফেটে যাবে।
গাড়িটা ডাউনে যাচ্ছিল তাই তৎক্ষণাৎ শক্ত ব্রেক সত্বেও বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। আর প্রায় তক্ষুণি একটা বিশাল পাথরের চাঁই পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তায় পড়ে তীব্র গতিতে পাশের খাদে গিয়ে পড়ল। জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখলাম পাথরটি ক্রমশ নীচের দিকে নেমেই চলছে। আমার বা-পাশে যে এত গভীর একটা খাদ, আমার ধারণাই ছিল না। একটুকুর জন্য আমরা তিন তিনটা মানুষ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলাম।
জীবনের মুখ শুকিয়ে কাঠ। মুখে কোন কথা নেই। আমারও বুকটা ধকধক করে কাঁপছে। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। বুড়িটা এভাবে চিৎকার না দিলে আমরা কেউই বাঁচতাম না। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পিছন ফিরে দেখি বুড়ি ফিকফিক করে হাসছে।
ধীরে ধীরে আমার ভিতরেও সাহস ফিরে এলো। সামনে তাকিয়ে দেখি সেই ওয়াগনারটির সামনের দিক ধ্বসের নীচে চলে গেছে। পেছনের দরজা খুলে একজন একজন করে লোক নামছেন। রাস্তা পুরো বন্ধ।
জীবনকে বললাম, গাড়ি ঘোরা। এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। আমি ওদের গাড়িটা একটু দেখে আসি। জীবনও গাড়ি ঘুরিয়ে আমার পিছনে পিছনে এলো। দেখলাম ওদের গাড়িটা বের করা যাবে না। রিস্ক আছে। ওয়াগনারের যাত্রী কারোরই তেমন কিছু হয় নি। তবে এতটাই ঘাবড়ে গেছেন যে রাস্তার উপরেই বসে পড়েছেন তারা। জিজ্ঞেস করলাম, কি করতে চান ?
ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। বুঝতে পারি ওদের মাথায় কাজ করছে না। জীবনকে ইশারায় ওয়াগনার থেকে মালপত্র আমাদের গাড়িতে তুলতে বললাম। ওরা নীরবে গাড়ির চাবিটা জীবনের হাতে তুলে দিলেন। সবকিছু গুছিয়ে ওদের গাড়িটা লক করে যখন আমরা আমাদের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, দেখি সেই বুড়িটা গাড়িতে নেই। জীবনকে বললাম, আশেপাশে কোথাও খুঁজে দেখ। আছে হয়তো এখানেই কোথাও।
আমি নিজেও খুঁজলাম, কিন্তু না। পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, বুড়িটা যে কোথায় গেল! বেশ কিছুক্ষণ বুড়িমা বুড়িমা বলে চিৎকার করে ডাকাডাকিও করলাম। কিন্তু না, কোন সাড়াশব্দ নেই। জীবন বিরক্ত হয়ে বললে, স্যার চলুন, এখানে আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।
আমি বুঝতে পারছি সব । কিন্তু মন মানছিল না। বললাম, দেখো, এই বুড়িটার জন্যেই আমরা আজ বেঁচে গেছি। ওকে ফেলে আমরা কি করে যাই বলোতো ?
আমার কথা শুনে জীবন এবার রেগে ফেটে পড়লো। বললে, ওর জন্যেই আমরা আজ মরতে বসেছিলাম স্যার —।
—বাজে কথা একদমই বলবে না, আমি নিজে দেখেছি। তুমি ভুল ভাবছো, বেঁচে গেছো। ওখানে আমাদের দেরি না হলে, আমাদের উপরই আজ ধ্বস নামতো তুমি জানো ?
— কিন্তু স্যার, আপনি কি সারাদিন এখানে বসে বুড়িটার জন্যে অপেক্ষা করতে বলছেন আমাদের ?
আমি ওর কাছে একটু সময় চাইলাম।
জীবন আর কথা বাড়ালো না। আমিও চুপ। কিন্তু বুড়িমাতো ফিরছে না।
অগত্যা প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করে বুড়িটাকে ছাড়াই আমাদের গাড়ি ছাড়লো।
মনটা খারাপ হয়ে গেছে। প্রথমতঃ একেবারে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরছি, দ্বিতীয়ত যে কাজে বেরিয়েছিলাম, পরিশ্রমটাই মাঠে মারা গেছে। তার উপরে যার জন্য প্রাণে বাঁচা তাকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলেই ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছি, কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করছিলাম, মনে। এই ফেলে আসাটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিলাম না। চুপচাপ বসে আছি গাড়িতে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। আমি শুধু ভাবছিলাম সেই বুড়িটার কথা।
প্রায় মিনিট দশেক গাড়ি চালানোর পর আমরা আবার ফিরে এলাম সেই কবরটির কাছাকাছি। আমি জীবনকে ইশারায় গাড়ি থামাতে বললাম।
আমি নামতেই জীবনও দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বললাম, কিছু ফুল তুলে একটা তোড়া বানিয়ে দাও।
— স্যার আপনি পারেনও বটে।
— যা বলেছি, সেইটুকুই করো, কথা বাড়িও না।
আমার ভেতরে একটা অনুশোচনা কাজ করছে।
জীবনের কাছ থেকে তোড়াটা নিয়ে আলতো করে সেই কবরটাতে চড়িয়ে দিলাম। হাত জোড় করে মনে মনে প্রার্থনা করে বললাম, আপনি বুড়িমার কি হন আমি জানি না, তবে বুড়িমার জন্যেই আজ আমরা প্রাণে বেঁচে ফিরে যাচ্ছি। উনি গাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন, আমাদের জানা নেই। যদি ফিরে আসেন আমাদের প্রণাম জানাবেন।
মনে মনে এইটুকু বলে ফিরে আসছিলাম, হঠাৎই মনে হলো কবরটা যেন সেই আমার দেওয়া চাদরটা দিয়েই কেউ ঢেকে রেখেছে। আঁতকে উঠলাম আমি। এখানে এই চাদরটা এলো কি করে ? চিৎকার করে ডাকলাম, জীবন !
আমার চিৎকারে জীবন ছুটে এলো।
— কি হয়েছে স্যার !
— ওই দেখো, আমার চাদরটা এখানে পড়ে আছে। বুড়িমা নিশ্চয়ই এখানে কোথাও আছে। আমি আঙুল তুলে চাদরটা দেখিয়ে দিলাম।
— কোথায় চাদর স্যার ?
— আরে ঐ-ই-তো, কবরটার ওপরে বিছানো। দেখতে পাচ্ছো না নাকি ?
— কোথায় স্যার, ওটা তো একটা সুপারির ছই।
বলেই একটানে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল। আমি চট করে ওর হাতটা টেনে ধরলাম। বললাম, থাক, চল, ফেরা যাক।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
গাড়িতে আমরা পাঁচটি প্রাণী, আমরা দুজন আর সেই ওয়াগনারের তিনজন। সবাই চুপচাপ। গাড়িতে গান অনেক আগেই বন্ধ করা হয়েছিল। এখনো বন্ধ। কারো মুখেই কথা নেই। গাড়ি তার আপন গতিতে এগিয়ে চলছে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই আমি জীবনকে প্রশ্ন করলাম, জীবন, পাথরটা গড়িয়ে পড়ার আগের মুহূর্তটা তোমার মনে আছে ? বুড়িটা কি বলে চিৎকার করে উঠেছিল বলতো ?
— হ্যাঁ স্যার, মন্টু গাড়ি থামা !
— ঠিক তাই । কিন্তু এই মন্টুটি কে ?
— ওটা আমার ডাক নাম স্যার, বাড়িতে মা বাবা ওই নামেতেই ডাকে।
আমি চমকে উঠলাম, তাহলে এই বুড়িটা তোমার নাম জানালো কি করে ?
— আমিও তো সেই থেকে সেটাই ভাবছি স্যার। তাছাড়া আপনি দেখলেন কবরের উপরে চাদর বিছানো, আমি দেখলাম ছই। কিন্তু ওখানে তো সুপারী গাছ ছিল না, তাহলে সেটাই বা এলো কি করে ?
আমার তক্ষুণি মনে পড়লো, তাইতো ওখানে তো কোন সুপারি গাছ নেই। তবে কি …..? কি জানি।
আমার মুখে কথা সরছিল না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। মুখের রক্ত যেন এক নিমেষে বুকে এসে জমায়েত। শরীরটা ঝিমঝিম করছে। মাথাটা সিটে হেলান দিয়ে জীবনকে অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার চালাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ?
লেখক পরিচিতি: লেখক সুপ্রদীপ দত্তরায় পেশায় একজন পেনশনভোগী ব্যাঙ্ক কর্মী। লেখকের শখের মধ্যে রয়েছে ফটো তোলা, ছবি আঁকা, গিটার বাজানো এবং ঘুরে বেড়ানো। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে কবিতাও লেখেন। তাঁর কবিতা বরাক উপত্যকার অনেক শিল্পীর কন্ঠে আবৃত্তি হয়ে উঠেছে। ইউটিউবে ‘ইতি সুপ্রদীপ ‘ নামে তাঁর একটি চ্যানেল রয়েছে।
Comments are closed.