নন্দিনী
নন্দিনী। আমার স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগে আমার কাছে আবদার করে গেল, অনেকদিন ধরে বেড়াতে যাওয়া হয়নি তাই কোথাও বেড়াতে যেতে হবে। নন্দিনী যদি বায়না ধরে, বিশেষত আমার কাছে তবে সেটা চাই-ই-চাই।
নন্দিনী সবার থেকে একটু আলাদা। অন্যরকম। নন্দিনী চাঁদনী রাতে আমার হাত ধরে হাঁটতে ভালোবাসে। জ্যোৎস্নায় স্নান করতে করতে আমার বুকে মাথা রেখে খলখলিয়ে হেসে উঠতে ভালবাসে। হঠাৎ করে কোথাও হারিয়ে যেতে ভালবাসে। আসলে নন্দিনী জীবনটাকে দারুণভাবে ভালোবাসে। আর ভালোবাসে বেড়াতে। নন্দিনীর এই এক শখ! বেড়ানো। কিছুদিন যদি সেটা না হয়ে ওঠে তবেই হাঁপিয়ে ওঠে। অথচ আজ পর্যন্ত আমাদের দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
নন্দিনী হঠাৎ করে একদিন বলে বসবে, ‘চলো আমরা আজ হারিয়ে যাই দুজনে’। সেই হারানোটা কখনো হেঁটে। কখনো রিক্সায়। কখনো বাসে। কদাচিৎ ট্যাক্সিতে। কোন একদিন হয়তো হঠাৎ করে বলবে ‘আজ ঘরে উনুন জ্বলবে না’। অর্থাৎ আজ বাইরে কোথাও যেতে হবে। পুরোটা দিন হইচই। খাওয়া-দাওয়া। পরিবারের অনেকেই এসব খুব ভালো চোখে দেখে না। কথা শোনায় নানারকম। অথচ আমি? আশ্চর্য নন্দিনীর কথা কিছুতেই ফেলতে পারি না। তবে সব বায়না যে ওর মেটাতে পারি তা নয়। কিন্তু এসব নিয়ে কোন অভিযোগ নেই ওর। আসলে নন্দিনী সবকিছু খুব সহজভাবে নিতে পারে। সেবার ব্যাপারটা নন্দিনী যত সহজ ভাবে নিয়েছিল, আমি কিন্তু খুব সহজে নিতে পারিনি। এখন ভাবলে নিজেকেই ছোট মনে হয়।
দু’জনের সংসার। তবুও অভাব প্রায়ই মাসের শেষে উঁকি দিত। আমার বেতন আহামরি কিছু ছিল না। তার উপর ঘর ভাড়াতেই বেতনের মোটা অংশ চলে যেত। তাছাড়া ঘোরাফেরা, বাইরে খাওয়া দাওয়া। অনেকটাই বাড়তি খরচ হত। নন্দিনীকে না ভাবালেও আমাকে ভাবতে বাধ্য করতো। এই অবস্থায় দুজনই বুঝতে পারছিলাম নন্দিনীর একটা চাকরির খুব প্রয়োজন। আর বলতে গেলে হঠাৎ করে একটা সুযোগ এল। ডাক এল একটা মৌখিক পরীক্ষার জন্য। আর সৌভাগ্যক্রমে সেই ডিপার্টমেন্টের বড়কর্তা আমার খুবই জানাশোনা। কাছের মানুষ। ব্যাপারটা তার কাছে খুলে বলতে, উনি বললেন যতটুকু সম্ভব উনি তো করবেনই, তবে অনেক সময় তাদের উপর সবকিছু নির্ভর করে না। তাই কিছু টাকা কড়ি জোগাড় করে রাখতে উপদেশ দিলেন। তারপর থেকে সত্যিই আমি টাকা জোগাড়ে লেগে পড়লাম। যদিও ব্যাপারটাতে মন ততটা সায় দিচ্ছিলো না, কিন্তু উপায় ছিলনা। নন্দিনীর চাকরিটা হলে একটু ভালোভাবে থাকা যাবে। অভাব আর হুট করে সংসারে ঢুকে পড়ার সুযোগ পাবেনা। নন্দিনীকে বললাম “এবার থেকে কিছুদিন তোমার এসব উটকো খরচ বন্ধ”। নন্দিনী নাক ফুলিয়ে অভিমান দেখিয়ে চলে গেল। মুখে কিছু বলল না।
কিছুদিন পর ইন্টারভিউয়ের তারিখ আসতেই আমার ব্যস্ততা শুরু হলো সকাল থেকেই। কিন্তু আশ্চর্য! নন্দিনীর কোন তাড়া নেই। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “কি হলো নন্দিনী, তাড়াতাড়ি করো। ইন্টারভিউ দিতে যাবে না?
ভাবলেশহীন নন্দিনী উত্তর দিল “না, ভেবে দেখলাম ইন্টারভিউ দিয়ে লাভ নেই। তাই দিচ্ছি না।”
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। সব বারের মতো এবারও নন্দিনীর কাছে পরাস্ত হলাম। কিন্তু দুদিন ওর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পারলাম না। নন্দিনীও ঘাটাল না আমাকে। সব বুঝে কেমন আলগাভাবে রইল। সময় একসময় আমাদের পরিবেশটাকে সহজ করে তুলল। আস্তে আস্তে আমাদের দু’ঘরের বাড়িটা আবার আগের পরিবেশে ফিরে এল। যদিও পরে নন্দিনীর এভাবে হুট করে ইন্টারভিউ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভেবেছি অনেক। কিছু একটা আন্দাজ করে ভয়ে আঁতকে উঠেছি বারবার। তারপর থেকে চাকরি নিয়ে নন্দিনীকে আর কিছু বলতে পারতাম না। হয়তোবা লজ্জায়। কিন্তু নন্দিনীর এভাবে ঘনঘন ঘোরাফেরা, বাইরে খাওয়া-দাওয়া সব কিছু আমাকে ভাবিয়ে তুলল। অথচ কিছু বলে লাভ নেই। কারণ কিছুতেই কিছু শুনবে না মেয়েটি।
এরকমই একদিন হঠাৎ করেই বায়না ধরল রাতের খাবারটা বাইরেই হবে। মাসের শেষ। ব্যাপারটা আদৌ ভালো লাগছিলো না। কিন্তু ভালো না লাগলেও কিছু করার ছিলনা। তবে ঠিক হলো, এবারের টাকাটা নন্দিনী দেবে।ওর কাছে প্রায়ই কিছু টাকা জমে। প্রয়োজনে কখনো আমিও চেয়ে নেই।আমি প্রস্তাবটাতে রাজী হয়ে গেলাম। যারা বউয়ের টাকায় খেতে-পড়তে লজ্জা পায়, আমি ওদের দলে নেই। আমাদের মধ্যে কখনো এসব ঢুকেনি। যার কাছেই থাকুক, টাকাটা সব সময় আমাদের দুজনেরই। তবে খেতে বসে নন্দিনী আমার বিরক্তির রেশ টেনে বললো, “তুমি দিনদিন কৃপণ হয়ে যাচ্ছ।”
” কিরকম?”
হয়তো কপালটা কিঞ্চিৎ কুঁচকে উঠেছিল। নন্দিনী সেটার দিকে লক্ষ্য করেই বললো, “কথাটা যে সত্যি বলেছি, তারই প্রমাণ হচ্ছে তোমার কপালটা। কেমন কুঁচকে উঠেছে দেখো! ”
সেটা আবার কি?”
“যদি মিথ্যে হতো কথাটা, তাহলে তুমি হেসে উড়িয়ে দিতে। একটু থেমে আবার বলল, “বউকে খাওয়ানোর বেলায় বুঝি কিপটামো করতে হয়!”
আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললাম, “মাসের শেষে এটা কারোরই পছন্দ হবেনা। আর এভাবে ঘনঘন—–”
“বা-রে কতদিন আর খাই মাসে? সীমার বর ওর জন্য কত কি করে! কত জায়গায় ওরা বেড়াতে যায়! বিয়ের পরে পরেই ওকে ফ্রিজ আর কালার টিভি একসঙ্গে কিনে দিয়েছিল”।
আমি নন্দিনীকে অবাক চোখে দেখছিলাম। ও থামতেই বললাম, “তুমি জান, সীমার বর কিসে চাকরি করে আর কিভাবে ফ্রিজ, কালার টিভি আসে ওদের বাড়িতে?”
আমি বোধহয় একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। নন্দিনী মিষ্টি হেসে টেবিলে রাখা আমার হাতের উপর হাত রাখল।।একটু চাপ দিয়ে বলল, ‘এই জন্যই তো তোমাকে এত ভালোবাসি।আর তুমি?’
আমার ভেতরটা শান্ত হল। বুকের মধ্যেখানে এক টুকরো সুখের স্পর্শ। নন্দিনী মিষ্টি সুরে বলল, “জান- কেন তোমার প্রপোজালে চট করে হ্যাঁ করেছিলাম?”
জানি। নন্দিনীই বলেছে। সবাই যখন বাতাসের তালে তালে দৌড়াচ্ছে তখন নন্দিনী নাকি দেখেছিল একটা ছেলেকে উল্টো দিকে দৌড়োতে। অহংকারী বাতাস ওকে ব্যঙ্গ করছে। উল্টে ফেলে দিতে চাইছে। তবুও নিজেকে সামলাতে সামলাতে ছেলেটা প্রাণপণে দৌড়োচ্ছে। প্রথম দেখায়ই ভালো লেগে গিয়েছিল। কিন্তু নন্দিনী যদি জানতে পারে সেই অহংকারী বাতাস অবিরল চেষ্টা চালাচ্ছে ছেলেটাকে ওর দিকে টানতে। আর হয়ত বা বাতাস কিছুটা সফলও। নয়ত—-ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে উঠলাম।
নন্দিনী আমার হাতে আরেকটু চাপ দিল, “এ- ই, কি ভাবছ?”
আমি সম্বিত ফিরে পেলাম।
“আচ্ছা বাবা এবার থেকে এসব একদম কমিয়ে দেব। কেমন? এবার রাগ পড়ল সাহেবের?”
আমার ইচ্ছে হলো বলি, ‘না নন্দিনী, তুমি তোমার মত করেই থাক।’ কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। নন্দিনী কিছু পরেই এসব ভুলে গেল। আবার আগের মতই হাসতে হাসতে আমাকে হাসাতে হাসাতে বাড়ি ফিরল।
আরও কিছুদিন একইভাবে কাটল। একদিন সকালবেলা নন্দিনীর ঠেলাঠেলিতে ঘুম ভাঙলো। ঘুম চোখেই প্রশ্ন করলাম, ‘কি ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি ডাকাডাকি করছ?’
” লক্ষীটি, আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠ না গো,” নন্দিনী আবদারের সুরে বলল।
‘আচ্ছা বেশ উঠলাম। কিন্তু কেন?’ আমি উঠার বদলে এক হেঁচকা টানে ওকেই আমার পাশে বসিয়ে দিলাম।
“আহ্। ইয়ার্কি করো না। ওঠ। আজ আমাকে একটু বেরোতে হবে।’
‘কোথায় যাবেন রানী সাহেবা?
‘একটা ইন্টারভিউ আছে।’
‘ ইন্টারভিউ! আর আমাকে বলোনি কেন?’
‘এসব আগে থেকে বলে কি হবে?’ ‘কয়েকদিন আগে যে রিটেন দিয়েছিলে এটার ওরেল নাকি?’
‘ হ্যাঁগো- হ্যাঁ-এখন ওঠ প্লিজ!’
আমার স্ত্রী ইন্টারভিউ দেবে আর আমি শুয়ে থাকতে পারি?
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই কেউ একজন এসে নন্দিনীকে ভেতরে নিয়ে গেলো। খুব সম্ভব ইন্টারভিউ স্থলে। যাবার আগে নন্দিনী বলে গেল, আমি যেন অফিসে চলে যাই। ও একাই যেতে পারবে। আমিও সেটাই ভালো ভেবে এগুচ্ছি হঠাৎ অনিমেষকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। ওদিকে একটা ঘরে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। অনিমেষ আমার ছোটবেলার বন্ধু। বয়সে একটু বড় হলেও এক ক্লাবে খেলার সুবাদে বন্ধুত্বটা ভালোই হয়েছিল। এতদিন পর অনিমেষকে দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। এখানে? অনিমেষ? চাকরি করে বুঝি? ধরতে পারলাম না। বরাবরের ভাল ছাত্র অনিমেষ পড়া শেষ করে ভালো চাকরি পেয়েছে শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় বা কি চাকরি তা জানার সুযোগ হয়নি। বেশ খুশি মনে ওর দিকে এগুলাম। বারান্দায় কিছু একটা টাঙ্গানো ছিল। আর সেটা পড়ার জন্যই জটপাকানো ভিড়। লোকগুলোকে কাটিয়ে ঘরে ঢুকে অনিমেষকে দেখতে পেলাম না। অন্য এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘উনি তো ইন্টারভিউ নিতে ঢুকে পড়েছেন।’
‘ইন্টারভিউ নিতে!’ বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না।
‘উনি ইন্টারভিউ বোর্ডে রয়েছেন।’ভদ্রলোক উত্তর করলেন।
হঠাৎ যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গটাকে পেয়ে গেলাম।চোখের সামনে অ্যাপয়নমেন্ট লেটার ঝুলতে লাগলো।
আমি নন্দিনীর মুখ, আশেপাশের সব কিছু ভুলে কেমন যেন হয়ে গেলাম।
ইন্টারভিউ শেষ হতে হতে দু আড়াই ঘন্টা লাগবে জেনে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে অনিমেষের সঙ্গে দেখা করতে আবার যখন অফিসে ঢুকলাম তখন আগের মত আর ভিড় নেই।বেশ ফাঁকা। আগের ভদ্রলোকের কাছে যেতেই তিনি জানালেন, ‘অনিমেষবাবু ইন্টারভিউ শেষ হবার পরে পরেই বেরিয়ে গেছেন।কি এক জরুরি কাজে।’
চোখের সামনে হঠাৎ অন্ধকার নেমে এল। নিজেকে সামলে নিতে কতক্ষণ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করলাম।
বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখলাম নন্দিনী কি সব কাজে ব্যস্ত।আমি আসতেই অন্যদিনের মতো খাবার দিল, গল্প করল, কিন্তু ইন্টারভিউ-এর কোন উল্লেখ নেই। আশ্চর্য হলাম। ইন্টারভিউ খারাপ হয়েছে ভেবে প্রসঙ্গটা আর পাড়লাম না। হয়তো দুঃখ পাবে। এভাবে বিকেল সন্ধ্যে কাটলো। রাতে শুতে গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বললাম, ‘তোমার ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে?’
নন্দিনী সহজভাবে উত্তর দিল, ‘ভালোই হয়েছে’।
আমার ভীষণ রাগ হল। এত বড় কথা, কোনও গুরুত্ব নেই। অন্য কেউ হলে আসতেই বলত।
আমি রেগেমেগে গলাটা বেশ উঁচুতে তুলে বললাম, ‘ভালো হয়েছে মানে কি? ভালোর অনেক রকমফের আছে।
‘ ভালো হয়েছে মানে ভালো হয়েছে। তবে চাকরিটা পাব কিনা জানিনা।’ একটু সময় কি যেন ভাবলো, তারপরই মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘না পেলে বয়েই গেল। আমাদের যে রকম চলছে সে রকমই চলবে। কি বলো?’
আমি কোন উত্তর করলাম না।মনে মনে ভাবলাম, সংসারটাতো আমাকেই চালাতে হয়!
আবার বলল, ‘জানো সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছিল কোনও হোপ আছে কি না। কোথাও টাকা দিয়েছি কিংবা কাউকে অনুরোধ—–! আমি বলে দিয়েছি, আমার হোপ আমার ইন্টারভিউই।’ হঠাৎ নন্দিনীকে খুব বড় মনে হলো। নিজেকে তুলনায় ভীষণ ছোট।আমি কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পর আমার পিঠে আঙ্গুল দিয়ে ইকিবিকি কাটতে কাটতে বলল, ‘চাকরিটা পেলে মন্দ হয় না। না গো? একটু ভালোভাবে থাকা যাবে। টাকা জমিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যাবে। কি বল?’
আমি আর পিছু ফিরে থাকতে পারলাম না। ওর দিকে ফিরে বললাম, ‘চাকরিটা না পেলেও আমরা বেড়াতে যাব। কিছুদিন দেরি হবে হয়ত।’
বাচ্চা মেয়ের মতো সহজ খুশি প্রকাশে নন্দিনী বলল, ‘আমরা অনেক দূরে বেড়াতে যাব। অ-নে-ক দূ-রে।’
আশ্চর্য হলেও নন্দিনীর চাকরিটা সত্যি সত্যি হয়ে গেল। নন্দিনী চাকরিতে জয়েন করলো। ঘরের কাজ আর রান্নার জন্য বিশুর মা’কে রাখা হল। অভাবও হুট করে ঢুকতে পারছিল না সংসারে। কিন্তু আমরা যেন আগের মত আর চট করে বের হতে পারছিলাম না। বাইরে বিশেষ খেতেও যাওয়া হচ্ছিল না। বিশুর মা যা রাধে তাই খাই। নন্দিনীও আর তেমন বায়না ধরছিল না।তবে আমরা দুজনেই টাকা জমানোতে খুব মন দিয়েছিলাম। কিছু টাকা জমে গেলে আমরা বেরিয়ে পড়ব। এতদিনে নন্দিনীর আশা মিটবে।
মাসটা ছিল সেপ্টেম্বর। ঠিক হলো পুজোর পরেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। প্রথমে ট্রেন ধরে কলকাতা, তারপর আশে পাশে যেখানে যেখানে যাওয়া যায়। সবকিছু প্রায় ঠিক। মাসের প্রথমেই টিকিট কাটা হবে। আমরা দুজনেই বেজায় খুশি। সামনের মাসেই আমরা কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাব।এমনই এক সন্ধ্যায় বেশ আমেজে অফিস থেকে ফিরেছি। নন্দিনী আগেই ফিরেছে। বরাবর এরকমই হয়। চা খেতে খেতে আমি কাগজ পড়ছি আর মাঝেমধ্যে নন্দিনীকে দেখছি। অন্য দিনের তুলনায় একটু অন্যরকম। আপন মনে কাজ করে চলেছে। নন্দিনীকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। ভাবলাম, হতেই পারে। সব দিন সমান থাকে না। হয়ত শরীরটরির ভালো লাগছে না।আমি আর ঘাটালাম না।
রাতে শুতে গিয়ে আদৌ ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। একটা বই চোখের সামনে নিয়ে শুয়েছি। হঠাৎ মনে হলো, তাহলে আমরা সামনের মাসে যাচ্ছি। মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল মনটা। বইটা বুকের উপর রেখে নন্দিনীকে বললাম, “তাহলে নন্দিনী, শেষ পর্যন্ত আমরা যাচ্ছি!”
উত্তর পেলাম না। অবাক হলাম। যার জন্য এত আয়োজন সে–ই–! নন্দিনীর দিকে ঘুরলাম, ‘কি হল, কথা বলছো না যে?’
‘না, আমরা যাচ্ছি না!’ নন্দিনীর কণ্ঠস্বর গম্ভীর।
‘কি বলছ নন্দিনী?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি!’
‘মানে?’
‘যে টাকাগুলো আমরা জমিয়েছিলাম,এগুলো আমি বিশুর মাকে দিয়ে দিয়েছি!’
‘বিশ হাজার টাকা তুমি বিশুর মাকে দিয়ে দিয়েছ? আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল।
‘জানো বিশুর মা খুব ভদ্র ঘরের মেয়ে। কেবল অভাবের জন্য——।’
নন্দিনীকে হঠাৎ বদ্ধ পাগল মনে হল আমার। ইচ্ছে হলো বিছানা থেকে টেনে ফেলে দিই। শক্তভাবে বললাম, ‘এটা কি করেছ তুমি?’
‘আমার কথা শোনো আগে। বিশুর খুব অসুখ। বিশুর গলায় টিউমার। আর বিশুর চিকিৎসা করানোর জন্যই তো ওর মা কাজ নিয়েছে। হঠাৎ অসুখটা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ছেলেটা হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ডাক্তার বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করাতে।বিশুর মা আজ এত কান্নাকাটি করল যে আমি পারলাম না। দিয়ে দিলাম টাকাটা।’
আমি অবাক চোখে নন্দিনীকে দেখছি। নন্দিনী বলেই চলেছে, ‘আমাদের টাকায় যদি বিশু সুস্থ হয়ে উঠে,আমার আর কোনদুঃখ থাকবে না।’
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। রাগে-দুঃখে নিজের মাথায় মারতে ইচ্ছে করলো। নন্দিনী চুপ করে বসে রইল কতক্ষণ। অল্প পরে আমার পাশে সরে এল। হাত ধরে বলল, ‘রাগ করেছ?’
আমি উত্তর করলাম না।
‘আমাদেরতো সারাটা জীবনই পড়ে রয়েছে দেখার জন্য। একটা বাচ্চা ছেলের যে জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে!’
নন্দিনীকে কেন জানি মানুষ মনে হচ্ছিল না। অন্যকিছু। কোন গল্পের নায়িকা কিংবা কোন লেখকের সৃষ্ট উপন্যাসের কোন চরিত্র। নন্দিনী আরও একটু কাছে সরে এল। নিবিড় হয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আসলে আজ এই কাজটা না করলে নিজের কাছে তো বটেই, এমনকি আমাদের ঘরে যে নতুন একজন আসছে ওর কাছেও ছোট হয়ে যেতাম। সারা জীবন ধরে ব্যাপারটা আমাকে কুড়ে কুড়ে খেতো।’
এতটা কথা শোনার পর হঠাৎ আমার কানে আবার বেজে উঠলো আমাদের ঘরে যে নতুন একজন——–। মুহূর্তের চিন্তার ফসলে বোধগম্য হলো। আমি স্প্রিংয়ের মতো নন্দিনীর দিকে ঘুরলাম। চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘আমাদের ঘরে নতুন একজন?’
নন্দিনী হাসল। লাজুক অথচ মিষ্টি হাসি। আমি ওর দু কাঁধ ঝাকিয়ে বললাম, ‘সত্যি নন্দিনী?’
ও ছোট্ট আর মিষ্টি করে বলল, ‘হ্যাঁ গো’!
মুহূর্তে আমার রাগ খোলা বাতাসে রাখা কর্পূরের মতো কোথায় উড়ে গেল। মন খুশিতে কানায় কানায় ভরে উঠলো। এই আনন্দের কাছে অন্য সব আনন্দ তুচ্ছ হয়ে গেল। আমি আলতো করে নন্দিনীর গাল টিপে দিয়ে বললাম, ‘এখন একটাই প্রার্থনা ভগবানের কাছে, আমাদের যেন মেয়ে হয় নন্দিনী। আর মেয়েটা যেন হয় তোমার মত।’ নন্দিনী হাসল। আমি ওর চিবুকটা একটু তুলে ধরে বললাম, ‘আর ভেবো না। তুমি দেখো, আমরা কোনও একদিন নিশ্চয়ই বেড়াতে যাব। দূরে কোথাও——– অনেক দূরে——–।’
এমন অনেক পাঠক রয়েছেন যারা নিউজ, সাক্ষাৎকার এসবের পাশাপাশি সাহিত্যেরও অনুরাগী। গল্প, কবিতা, উপন্যাস তাদেরকে আকর্ষণ করে চুম্বকের মত। সেই পাঠকদেরকে সম্মান জানাতে আজ থেকে শুরু হলো আমাদের “রবিবারের আড্ডা”।বরাক উপত্যকার বিভিন্ন লেখকের লেখনীকে সম্বল করে জমে উঠবে আড্ডা, আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে রবিবার।
Comments are closed.