Also read in

দীপঙ্কর সাহার ফুল বাগান ও টুকুন

দীপঙ্কর সাহার ফুল বাগান ও টুকুন

সকাল বেলা থেকে মনটা ভালো নেই। নাতিন টুকুনের কথা খুব মনে পড়ছে তার, হাসি হাসি মুখটা ভাসছে চোখে। না আজ মোবাইল এ ভিডিও কলে কথা বলবেন তিনি,ভিডিও কলে নাতিনের সঙ্গে কথা বললে মনটা ভালো হয়ে যায়। এইকথা ভাবতে ভাবতেই কেমন হয়ে গেলেন দীপঙ্কর সাহা। একটু আবেগিক চোখটা ছল ছল করে দু একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ফুল গাছে।

##
ছেলেটা তো বলতে পারতো, বাবা তুমি গ্রামের বাড়িতে আর যেওনা। কিন্তু তা বলেনি চিন্ময়। তিনি এখন ও পেনসন পান,নিজের খরচা নিজেই চালান। ফুল বাগান করা খুবই শখ তার। শুধু ভাবেন যদি মানুষ ফুলের মতন ত্যাগী হতো, তা হলে সংসারে এই অনর্থ হতো না। এতো ভেদভাব দ্বন্দ্ব সংঘাত দেখে খুব কষ্ট পান তিনি। ফুলের মাঝে শিউলি ফুল তার প্রিয় ফুল ।শিউলি তো ভোর বেলা ঝরে পড়ে, অন্যকে গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে স্বাগত জানায়। মানুষের মানব ধর্ম অন্যকে সেবা করা, সেই ধর্ম থেকে দূরে সরে গেছে মানুষ। এই ভাবতে ভাবতেই নিজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। নিজে বিড় বিড় করতে করতে ফুল বাগানে হাঁটেন, যেন সব কিছু বুঝতে পারে ফুলগুলি,একাকীত্বের সঙ্গী, যেন তার। প্রাতঃভ্রমণ সেরে ঘন্টা দুই ফুলের সঙ্গে যেন কথা বলেন তিনি। ফুল বাগানে কিছু সময় অবশ্যই থাকা চাই। এইটি তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।

##
তাঁর বুড়ো বড় পিসিমা চা জলখাবার আজকাল বাগানেই নিয়ে আসেন।সেখানেই ফুলের সাথে যেন মিশে যান বড় পিসিমা ও দীপঙ্কর বাবু। ফুলও প্রকৃতির সঙ্গে। বুঝতে পারেন বড় পিসিমা, ছেলে ও বউমার দুর্ব্যবহারে প্রায় বাধ্য হয়ে চলে এসেছে দীপু অর্থাৎ দীপঙ্কর, বড় আঘাত পেয়েছে সে। তার স্বামী এক্সিডেন্টে মা’রা যাবার পর দাদার বাড়িতে আসে। সেই থেকে আজ অব্দি রয়েছে। কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। দীপঙ্করের মনটা চেনেন পিসিমা।

##
দীপঙ্করের অবসর নেবার হয়ে গেছে প্রায় দশ বছর, ভারত সরকারের গোয়ান্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন। তাই শরীর সম্পর্কে তার যত্ন একটু বেশি, তিনি বিশ্বাস করেন প্রাতঃভ্রমণ সকলেরই করা উচিত,স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে তা অবশ্যই করা উচিত। যোগ ব্যায়াম করা হলেও হাঁটার বিকল্প নেই।

তিনি প্রথম জীবনে একজন ফুটবলার ছিলেন, তার খেলা দেখে তৎসময়ের আসাম পুলিশ কমিশনার জে, রাউত তাকে ডেকে চাকুরিতে নিয়োগ করেন,তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।জীবনের নানা ঝুঁকি নিয়ে বড়ো বড়ো সন্ত্রাসবাদী লোককে ধরেছেন। আবার অনেককে জীবনের মূল স্রোতে নিয়েও এসেছেন, পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও।একমাত্র ছেলে দিল্লিতে বউ নাতিন নিয়ে আছে।সাত বছরের নাতিন রিয়া ছটফটে, দিল্লি পাবলিক স্কুলের মেধাবী ছাত্রী। অবসর নেবার পর তার স্ত্রী তপতী মারা গেলে দিল্লিতে ছিলেন দীপঙ্কর বাবু। তপতী মারা যাবার বড় একাকীত্বে ভুগছিলেন।কিন্তু সেই বাড়ি ছেড়ে দিল্লিতে চলে আসা একদম পছন্দ করেনি ছেলে চিন্ময় ও বউমা। নাতিন টুকুন তো খুশি, সুযোগ পেলেই দাদুর কাছে এসে সেই গোয়েন্দা জীবনের গল্প শুনেতে চায়। তিনিও রসিয়ে কসিয়ে বলেন। একদিন তো ছেলে চিন্ময় বলেই ফেললো তুমি টুকুনকে কী চোর ছোচ্চুরের গল্প বলো, এডভেঞ্চারের গল্পতো বলতেই পারতে।

বউমা টিপ্পনি কাটলো ছি! বাবা কি যে করেন! বউমা দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে প্রচ্ছন্ন কৌতুক করলে,যদি তার মেয়ে হতো তাহলে গালে একটা চড় কষাতেন,কিন্তু এযে একমাত্র ছেলের বউ, তাছাড়া ছেলে চিন্ময় তো প্রতিবাদ করলে না। তিনি রাগটাকে সংযত করলেন খুব কষ্টে।

##
বউমার কথাগুলো ভুলতে পারেন না।ছেলেটা কেমন পর হয়ে গেল, সব সময় ব্যস্ততা দেখায়, কথা বলার সময় নেই। অভিমান করে চলে এসেছেন। আসার সময় ছেলেকে বলেছিলেন খোকা যাচ্ছিরে ভালো থাকিস্। চিন্ময় শুধু তার দিকে তাকিয়ে ছিল, বলেনি কিচ্ছু, বাবা এই বয়সে গ্রামে যাওয়া কি ঠিক? ছেলে প্রণাম করলে, তখন টুকুন চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো বললো আমি যাবো দাদুর সঙ্গে, সেই সময় ভ্যানে উঠতে উঠতে দীপঙ্কর সাহা নাতিনের দিকে তাকিয়ে বললো আগামী সামারে নিয়ে যাবো। ঠিক তো নেবে দাদু বললো, টুকুন তার দাদুর দিকে তাকিয়ে। তখন যন্ত্রণায় বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো টুকুনের দাদু দীপঙ্কর সাহারও । বউমা ‘টেলিফোন এসেছে’ এই বলে একটা ছল করে চলে গেল ভেতর , সঙ্গে টেনে নিয়ে গেল টুকুনকে। টুকুন চিৎকার করে বললো বাপ্পির দিকে তাকিয়ে ‘দাদুর না গেলে কি হয়না’!

##
সেইদৃশ্য সিনেমার পর্দার মত প্রতি দিন ভাসে তাঁর চোখে। আজ সকাল থেকেই পরপর দৃশ্যপটে ভাসছে সেই সব ঘটনাবলির কথাও। দীপঙ্কর সাহাকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। চারাগাছে আর জল দিতে পারছিলেন না, হাত কাঁপছে, ঘামছিলেন। ডাকলেন, পিসিমা! ‘কি রে দীপু?’ বলে দৌঁড়ে ছুটে এলেন ‘কি হয়েছে তোর?দীপঙ্করের চোখে সেই ছবি! আবার পিসিমা ডাকলেন, ‘কি হয়েছে? সব সময় উদাস থাকিস্ কেন? নাতিন টুকুন ও ছেলের কথা খুব মনে পড়ছে, বললে দীপঙ্কর। পিসিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ও…..।

##
খুব ভোরে উঠে দীপঙ্কর তার পুরনো অভ্যাস মতো দৌড়ঝাঁপ করে ভোরের রোদ্দুর গায়ে মেখে হাঁটতেন। ছেলে ও ছেলের বউ মিতা সকালবেলা উঠে বাবার এইসব কান্ড কারখানা একেবারে পছন্দ করতো না। একটি দৈনিক সাময়িকীর প্রধান সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছে তার পুত্র, চিন্ময় সাহা। রাত্তির করে বাড়ি ফিরতে হয়,চিন্ময়ের সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে অনেক শত্রু ছিলো,তাই খাওয়ার টেবিলে অনেক বার বলেছে সে দীপঙ্কর বাবুকে, ‘বাবা তুমি এতো কাকভোরে উঠে প্রাতঃভ্রমণ করতে যেও না, বয়স হয়েছে। তা ছাড়া একটু দেরি করে যেতে পারো তো!’

ছেলের এই সব কথা শুনে হাসতেন তিনি। তাবড় তাবড় সন্ত্রাস বাদীকে ধরেছেন। শরীরের যত্ন করেন বলেই তা এখনও ঠিক রয়েছে। হেসে হেসে ছেলে ও বউমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কিচ্ছু চিন্তা করোনা। আমি ঠিক আছি,আমার কিছু হবেনা।’
‘বাপি, দাদু ঠিকই বলেছেন,দাদু দি গ্রেট’ নাতিন টুকুন তার বাপি চিন্ময়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললে। তখন প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে তার মা বললো, ‘চুপ টুকাই! সব সময় ইঁচড়ে পাকামি করোনা’ বলে ধমকালে। তখন কাঁদতে কাঁদতে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে দৌঁড়ে চলে গেল টুকুন। খুব বিরক্ত হলেন দীপঙ্কর বাবু। তিনি নাতিনকে খুব ভালো বাসেন। বলা যায় হৃদয়ের টুকরো, সেই নাতনীকে শুধু তার জন্য ধমক খেতে হলো, বউমার উদ্ধত ব্যবহারের কোন প্রতিবাদ করেনি ছেলে চিন্ময়। না, এখানে আর থাকার তার একটুকু ইচ্ছে নেই।

রাত্তিরে কিচ্ছু খাননি,অনেক বার বলেছে, চিন্ময়। বাবার দিকে তাকিয়ে আবারও বললে, রাত্তিরে কিচ্ছু না খেলে শরীর খারাপ করবে।মুখে কিচ্ছু বলেন নি, শুধু তাকিয়ে ছিলেন তার গিন্নি কিরণমালার ছবির দিকে। সারারাত্তির পায়চারি করে কাটিয়ে দিলেন একসময়ের জাদরেল গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার দীপঙ্কর সাহা। এক সময়ে তার ভয়ে বাঘে গরুতে জলখেতো,অর্থাৎ সবাই চুপ থাকতো, আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বউমাকে তোয়াজ করে চলতে হবে, ভাবতেই লজ্জা হচ্ছে। এই ছিল শেষ পর্যন্ত!, এখনও শরীর ভাঙেনি,শরীর সুস্থ থাকা সত্বেও নানা অজুহাতে তার সঙ্গে তাদের চিন্তার ব্যবধান ঘটে যাচ্ছে। গোয়েন্দার চোখ বলছে এতো ভালো নয়, এখন সম্মান থাকতে থাকতে চলে যাওয়া ভালো।

পরদিন ব্যায়ামের একটা ম্যাসিন নিয়ে এলো চিন্ময়, দীপঙ্কর ভাবলে, গেল রাত্তিরের ঘটনায় অনুতপ্ত ছিল চিন্ময়। ব্যায়ামের ম্যাসিন দেখেই প্রায় অগ্নিশর্মা হয়ে গেল বউমা, কী! দীঘা যাবার টাকা কড়ি নেই! কত বললে মাসী-মেসোরা, কতবার টেলিফোনে তোমাকে যেতে বললে তখন তুমি রাজি হলে না, কাজের নানা অজুহাত দেখালে। আজ বাবার জন্য ব্যায়ামের ম্যাসিন নিয়ে এলে, কি দারুণ বুদ্ধি! সব শুনছিলেন, দীপঙ্কর বাবু। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ির কাছে আসলেন। তার ছেলে চিন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে। পিসিমা বড় একা, তিনি আমাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছেন,তাছাড়া তার আবার ইদানীং শরীর ভালো যাচ্ছেনা। ঐ জিনিসটা ফেরৎ দিয়ে আয় চিন্ময়। আমি তো কেবল প্রাতঃভ্রমনে হাঁটি, অন্যকিছু ব্যবহার করিনা। চিন্ময় তার ছেলে একজন সংবাদপত্রের সম্পাদক, যা বুঝার সে বুঝে নিয়েছে। বাবা বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছেন।

###
সেই দৃশ্য তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। দীপঙ্কর সাহা ফুল বাগানে এই সব ভাবছিলেন। ‘কি ভাবছিস রে দীপু’ বলে পিসিমা ছেলেবেলার হাতবুলিয়ে দেবার মতো হাত দিয়ে পরম মমতায় বললেন,
‘দীপু জল খেয়ে নে।’

দীপঙ্কর পিসিমার দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বললে, ‘ছেলে চিন্ময় ও নাতিন টুকুনদের কথা খুব মনে পড়ছে। পিসিমা আজ টুকুনের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে চাই। পিসিমা হাসলে, ‘এযে রক্তের টান!’ তিনি সব বুঝতে পারেন। কাছেই ছিল বাগানের টেবিলে মোবাইল। মোবাইলটা তুলে নিলেন হাতে। মোবাইলে ভিডিও কলে চিৎকার করে প্রায় ডাকতে লাগলো টুকুন, ‘দাদু, দাদু তোমার শরীর ভালো তো? আমাদের এখানে লক ডাউন, আমরা সবাই বাসাতে, বাপ্পি মাম্মিও। স্কুল বন্ধ। তুমি বাড়িতে থাকবে। কোথাও যাবেনা কিন্তু!’ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছে, এক ফাঁকে দিদার কথা জিঞ্জেস করেছে। দিদাকেও দেখবে। ‘ঠিক আছে সোনা,ঠিক আছে।পিসিমাও হাসতে হাসতে বললে, ‘এখানে ও লকডাউন গো সোনামনি! দীপঙ্কর বাবু হাসছেন,টুকুনের বাবা হাসছে,হাসছে তার মাও,সবাই হাসছে। মোবাইল ভিডিওতে সব দেখা যাচ্ছে।

###
ফুল বাগানে অসংখ্য নানান ফুল ফুটেছে।নানান রঙে ভরে ওঠেছে বাগান।চুড়ুই, টুনটুনিও নাচছে এদিক ওদিক। দু’ একটা প্রজাপতি উড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার রং। রোদের টুকরো গুলো পড়েছে পিসিমা ও দীপঙ্করের হাসিভরা ঠোঁটে। হাসছে তখন সমস্ত পৃথিবী।

লেখক আশুতোষ দাস মূলত গল্প, কবিতা ও নাটক লিখে থাকেন। মৌলিক সাহিত্য চর্চার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অনেকগুলো পুরস্কার অর্জন করেছেন। দীর্ঘদিন থেকে বেলাভূমি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করছেন। তার গল্পের উপর ভিত্তি করে অনেকগুলো টেলিফিল্ম তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে লেখকের অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Comments are closed.